সাহাবাগণ (রা) কি একে অপরকে সত্যের মাপকাঠি বা মানদন্ড হিসাবে মানতেন, না কি শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা) কে সত্যের মাপকাঠি/মানদন্ড হিসাবে মানতেন:
------------------------------------------
সাহাবাগণ (রা) সত্যের মাপকাঠি হলে তাঁরা কখনোই কোন বিষয়ে বিরোধ করতেন না! কারণ সবাই সত্যের মাপকাঠি বিরোধ হবে কার সাথে? আর বিরোধ করলেও তারা তার সমাধানের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট যেতেন না।
কারণ তারাই তো সত্যের মাপকাঠি বা মানদন্ড, তাঁদের নিজ নিজ মতামত নির্ভুল কি না তা পরিমাপ করতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট যেতেন না।
.
কিন্তু যারা আহলে ইলম তারা সবাই জানেন যে, কোন বিষয়ে তাঁদের মতের অমিল হলে নিজ নিজ মতামত পরিমাপ করতে (সমাধানের জন্য) সাহাবাগণ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিটক যেতেন এবং তিনি যে সমাধান দিতেন তা তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মেনে নিতেন! যেমনঃ-
.
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ الْأَحْزَابِ لَا يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الْعَصْرَ إِلَّا فِيْ بَنِيْ قُرَيْظَةَ فَأَدْرَكَ بَعْضُهُمْ الْعَصْرَ فِي الطَّرِيْقِ فَقَالَ بَعْضُهُمْ لَا نُصَلِّيْ حَتَّى نَأْتِيَهَا وَقَالَ بَعْضُهُمْ بَلْ نُصَلِّيْ لَمْ يُرِدْ مِنَّا ذَلِكَ فَذُكِرَ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمْ يُعَنِّفْ وَاحِدًا مِنْهُمْ.
.
ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহযাব যুদ্ধের দিন (যুদ্ধ শেষে) বললেন, বনূ কুরাইযায় না পৌঁছে কেউ ‘আসরের সালাত আদায় করবে না। তাদের একাংশের পথিমধ্যে আসরের সালাতের সময় হয়ে গেলে কেউ কেউ বললেন, আমরা সেখানে পৌঁছার আগে সালাত আদায় করব না। আবার কেউ কেউ বললেন, আমরা এখনই সালাত আদায় করব, সময় হলেও রাস্তায় সালাত আদায় করা যাবে না উদ্দেশ্য তা নয়। বিষয়টি নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বলা হলে তিনি তাদের কোন দলের প্রতিই অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেননি। (সহীহ বুখারী হাঃ৪১১৯ আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৮১৩, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৮১৬)
এ হাদীস থেকে জানা গেল সাহাবাগণ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) আর কাউকে সত্যের মাপকাঠি বা মানদন্ড মানতেন না। তাঁরা নিজেদের সত্যের মাপকাঠি মানে করলে তাঁদের মতামত নির্ভুল কি না তা পরিমাপ করতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট যেতেন না।
.
এছাড়া নিম্নের হাদীসটিতে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করা হয়েছে:
عَنْ عَلِىٍّ قَالَ بَعَثَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- سَرِيَّةً وَاسْتَعْمَلَ عَلَيْهِمْ رَجُلاً مِنَ الأَنْصَارِ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يَسْمَعُوا لَهُ وَيُطِيعُوا فَأَغْضَبُوهُ فِى شَىْءٍ فَقَالَ اجْمَعُوا لِى حَطَبًا. فَجَمَعُوا لَهُ ثُمَّ قَالَ أَوْقِدُوا نَارًا. فَأَوْقَدُوا ثُمَّ قَالَ أَلَمْ يَأْمُرْكُمْ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنْ تَسْمَعُوا لِى وَتُطِيعُوا قَالُوا بَلَى. قَالَ فَادْخُلُوهَا. قَالَ فَنَظَرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ فَقَالُوا إِنَّمَا فَرَرْنَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مِنَ النَّارِ. فَكَانُوا كَذَلِكَ وَسَكَنَ غَضَبُهُ وَطُفِئَتِ النَّارُ فَلَمَّا رَجَعُوا ذَكَرُوا ذَلِكَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لَوْ دَخَلُوهَا مَا خَرَجُوا مِنْهَا إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ
.
“আলী (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) একটি সেনাদল যুদ্ধাভিযানে প্রেরণ করলেন। এক আনসারী ব্যক্তিকে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। এবং সাহাবীদেরকে তার কথা শুনা ও মানার জন্য নির্দেশ দিলেন। অতপর তাদের কোন আচরণে সেনাপতি রাগ করলেন। তিনি সকলকে লাকড়ি জমা করতে বললেন। সকলে লাকড়ি জমা করলো এরপর আগুন জ্বালাতে বললেন। সকলে আগুন জ্বালালো। তারপর সেনাপতি বললো রাসূলুল্লাহ (সা:) কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করার এবং আমার কথা শুনা ও মানার নির্দেশ দেন নাই? সকলেই বললো, হ্যা। তিনি বললেন, তাহলে তোমরা সকলেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়। সাহাবীগণ একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। এবং বললেন, আমরাতো আগুন থেকে বাঁচার জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে এসেছি। এ অবস্থায় কিছুক্ষন পর তার রাগ ঠান্ডা হলো এবং আগুনও নিভে গেল। যখন সাহাবারা মদীনায় প্রত্যাবর্তণ করলেন তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে উপস্থাপন করা হলো। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন ‘তারা যদি আমীরের কথা মতো আগুনে ঝাঁপ দিতো তাহলে তারা আর কখনোই তা থেকে বের হতে পারতো না। প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য কেবল ন্যায় এবং সৎ কাজেই।”
(সহীহ মুসলিম হা:নং: ৪৮৭২, সহীহ বুখারী হা: নং: ৪৩৪০, সহীহ মুসলিম বাংলা; ইসলামিক ফাউন্ডেশন কতৃক তরজমা; হা: নং: ৪৬১৫।)
এ হাদীস থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সাহাবাগণ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া অন্য কোন সাহাবী (রা) কে সত্যের মাপকাঠি বা মানদন্ড মনে করতেন না। তাই তাঁরা তাঁদের আমীরের নির্দেশ শরীয়ত সম্মত নয় ভেবে আনুগত্য করেননি। এবং এই সিদ্ধান্ত কতটুকু নির্ভুল হয়েছে তা জানার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিটক বিষয়টি উপস্থাপন করেন। আর রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেও সাহাবাগণ (রা) কে সত্যের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে বলেননি, তোমরা তো সবাই সত্যের মাপকাঠি যার কাছে যেটা ভালো লাগে তাই সেটাই করবে, তাহলে নিরাপদে জান্নাতে যেতে পারবে!
বরং তিনি সাহাবাগণ (রা) কে সত্যের মাপকাঠি বা মানদন্ড সাব্যস্ত না করে বলেনঃ "তারা যদি আমীরের কথা মতো আগুনে ঝাঁপ দিতো তাহলে তারা আর কখনোই তা থেকে বের হতে পারতো না। প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য কেবল ন্যায় এবং সৎ কাজেই।"
সুুতরাং 'সাহাবাগণ (রা) সত্যের মাপকাঠি বা মানদন্ড' এ কথা না সাহাবাগণ (রা) মনে করতেন, আর না রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের সত্যের মাপকাঠি হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। সাহাবাগণ (রা) যদি সত্যের মাপকাঠি হতেন, তাহলে তারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে তাঁদের মতামত পরিমাপ করতে, নির্ভুল সমাধান নিতে যেতেন না। সুুতরাং সত্যের মাপকাঠি সাহাবাগণ (রা) নন, যদিও তাঁরা সত্যবাদী, সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত। আর রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া অন্য কোন উম্মতকে সত্যের মাপকাঠি বা মানদন্ড এর দাবী করার অর্থই হলো তাঁদের রিসালাতের আসনে বসানো।
-------------------------
লেখক : প্রবন্ধ লেখক, কলামিস্ট, ইতিহাস গবেষক, শিক্ষক ও অনলাইন একটিভিস্ট।
0 Comments