Recent Tube

ওহীর ইসলাম বনাম রাজনৈতিক ইসলাম। মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।


ওহীর ইসলাম বনাম রাজনৈতিক ইসলাম।
---------------------------------------------
প্রশ্নঃ আহলে হাদীসের শায়খ মতিউর রহমান মাদানী বলেছেন, ইকামতে দ্বীন মানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা নয়। তিনি আরো দাবী করেছেন, ইসলামে রাজনীতির কোন স্থান নেই। ওহীর ইসলাম মানতে হবে, (আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য) রাজনীতি করে নাজাত পাবেন না। 
প্রশ্ন হলো ওহীর ইসলাম কি? যারা আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনীতি করছেন তারা কি নাজাত পাবেন না?

উত্তরঃ 
মতিউর রহমান মাদানী একজন তাগুতপন্থী, পথভ্রষ্ট ও মুলহিদ ব্যক্তি। ওহীর ইসলাম বলে তিনি তার কুফুরী মতবাদকে বুঝিয়েছেন, যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহর নিকট রাসূলুল্লাহ (সা) ওহীর মাধ্যমে যে বিধান এনেছেন তাকেই ওহীর ইসলাম বলে। আর এই ওহীর ইসলাম দ্বারা-ই প্রমাণিত যে, আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য নবী-রাসূলগণ রাজনীতি করেছেন। এটি তওহীদ ও ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ কাজের উপরই ব্যক্তির নাজাত নির্ভর করে। (সূরা সফঃ৬১/৯-১৩) এর দলিলসহ জবাব নিম্নে বর্ণিত হলো-

আল্লাহর উলুহিয়্যাত ও রবুবিয়্যাত তথা তওহীদের একটি বিশেষ দিক তাঁর 'হাকামিয়্যাত' বা আইন ও বিধান রচনার অধিকার ও ক্ষমতা। আল্লাহ তা'য়ালার মহান নামগুলির অন্যতম 'আল-হাকাম' অর্থাৎ বিচারক বা বিধানদাতা। যিনি প্রতিপালক তাঁরই অধিকার তাঁর প্রতিপালিত সৃষ্টির জন্য বিধান প্রদান করার। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
ﺇِﻥِ ﺍﻟْﺤُﻜْﻢُ ﺇِﻻَّ ﻟِﻠّﻪِ
"আল্লাহ ছাড়া কোন আইনদাতা নেই।”-
(সূরা আন’আমঃ৬/৫৭, সূরা ইউসুফঃ১২/৪০ ও ৬৭)।

আল্লাহর সৃষ্টি মানুষের উপর আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন জারি করার অধিকার নেই। আর মানুষও পারে না আল্লাহ ব্যতীত আর কারো আইন মেনে নিতে বা পালন করতে। করলে তা হবে সুস্পষ্ট আল্লাহর সাথে শিরক করা। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
ﻣَﺎ ﻟَﻬُﻢْ ﻣِﻦْ ﺩُﻭﻧِﻪِ ﻣِﻦْ ﻭَﻟِﻲٍّ ﻭَﻟَﺎ ﻳُﺸْﺮِﻙُ ﻓِﻲ ﺣُﻜْﻤِﻪِ ﺃَﺣَﺪًﺍ
তিনি (আল্লাহ) ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক, (আইনদাতা) নেই। তাঁর আইনে তিনি কাউকে শরীক করেন না।
(সূরা কাহফঃ১৮/২৬)

ধর্মীয় জীবনসহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে একমাত্র হাকাম বা বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করা তাওহীদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর উলুহিয়্যাতের দাবী যে, বান্দা তাঁর হুকুমের আনুগত্য করবে। এজন্য আনুগত্য ইবাদতের অন্যতম প্রকাশ। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
أَفَغَيْرَ اللَّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلًا.
(বল) আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিধানদাতা মানব? অথচ তিনিই তোমাদের নিকট বিস্তারিত কিতাব নাযিল করেছেন। আর যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছিলাম তারা জানত যে, তা তোমার রবের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে নাযিলকৃত। (সূরা আন'আমঃ৬/১১)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
"আল্লাহই হলেন আইনদাতা, আর তাঁর নিকট থেকেই আইন নিতে হবে"
(আবু দাউদ হাদীস নং ৪৯৫৫; নাসায়ী ৮/২২৬; বায়হাকী ১০/১৪৫ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত)।

আল্লাহ তা'য়ালা আইন প্রণেতা ও আইনদাতা হলেও তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ ভাবে তাঁর সৃষ্টি মানুষের মাঝে আইন কার্যকর করেন না। এমনকি তিনি সব মানুষকে সরাসরিভাবে তাঁর বিধানও দেন না। বরং তিনি অসংখ্য মানুষের মধ্য থেকে কিছু সম্মানিত মানুষকে নির্বাচন করে তাঁদেরকে ওহীর মাধ্যমে তাঁর দ্বীন বা বিধান প্রদান করেন। আর এই নির্বাচিত ও সম্মানিত মানবরাই হলেন নবী ও রাসূল। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর দ্বীন তথা বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য নবী রাসূলদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيه. তোমরা দ্বীন কায়েম করো এবং এতে মতভেদ করো না। (সূরা শুরাঃ৪২/১৩) আর নবী রাসূলগণই তাঁদের উম্মতের মাঝে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও বাস্তবায়নের জন্যই নেতৃত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ তা'য়ালা নবী রাসূলদের বিষয়ে বলেনঃ
ﻭَﺟَﻌَﻠْﻨَﺎﻫُﻢْ ﺃَﺋِﻤَّﺔً ﻳَﻬْﺪُﻭﻥَ ﺑِﺄَﻣْﺮِﻧَﺎ
আর তাদেরকে আমি নেতা বানিয়েছিলাম, তারা আমার বিধান অনুসারে মানুষকে সঠিক পথ দেখাত। (সূরা আম্বিয়াঃ২১/৭৩)

আল্লাহ তা'য়ালা আরো বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ 
আর আমি যে কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তা কেবল এ উদ্দেশ্যে যে, যেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হয়। (সূরা নিসাঃ৪/৬৪)
আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল এ জন্য আসেন না যে, কেবল তাঁর রিসালাতের প্রতি ঈমান আনতে হবে তারপর ইচ্ছেমতো যে কারো আনুগত্য করা যাবে। বরং নবী রাসূলগণের আগমনের উদ্দেশ্যই এই হয় যে, জীবন যাপনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আইন কানুন তাঁরা আনেন দুনিয়ার সমস্ত তাগুতী আইন কানুন বাদ দিয়ে কেবল মাত্র তাঁদেরই অনুসরণ করতে হবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁরা যে বিধান দেন সমস্ত তাগুতী বিধান ত্যাগ করে একমাত্র সেই বিধানকেই কার্যকর করতে হবে। তাই তো নবীদের দাওয়াত ছিল- 
فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ 
‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’। (সূরা আলি ইমরানঃ৩/৫০; সূরা শুআরাঃ২৬/১০৮, ১১০, ১২৬, ১৩১, ১৪৪, ১৫০, ১৬৩, ১৭৯; সূরা যুখরুফঃ৪৩ /৬৩)

যে আল্লাহর বিধানের মোকাবেলায় নিজেই বিধান রচনা করে এবং মানুষের উপর তা কার্যকর করতে চায় তাকে তাগুত বলে। প্রত্যেক নবী-রাসূলই তাগুতী বিধানকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর বিধানের প্রতি উম্মাতকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺑَﻌَﺜْﻨَﺎ ﻓِﻲ ﻛُﻞِّ ﺃُﻣَّﺔٍ ﺭَﺳُﻮﻟًﺎ ﺃَﻥِ ﺍﻋْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﺍﺟْﺘَﻨِﺒُﻮﺍ ﺍﻟﻄَّﺎﻏُﻮﺕَ.
আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি এ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর এবং তাগূতকে বর্জন কর। (সূরা নাহলঃ১৬/৩৬)

সুতরাং নবী-রাসূলদের মিশন ছিল সকল তাগুতী বিধান উৎখাত করে আল্লাহর তওহীদ তথা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা, ইসলমী রাজত্ব কায়েম করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী উম্মাতদের শাসন করা। কারণ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রতিনিধি (অর্থাৎ নবী-রাসূলগণ) কখনো অন্যের আনুগত ও অন্যের প্রজা হয়ে থাকতে আসেন না। বরং তিনি আসেন অন্যকে অনুগত ও প্রজায় পরিণত করতে। কোন কাফেরের শাসনাধিকার মেনে নেয়া তাঁর রিসালাতের মর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। (তাফহীমুল কুরআন, সূরা আ'রাফঃ৭/১১০ তাফসীর দ্রঃ)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ﻛَﺎﻧَﺖْ ﺑَﻨُﻮْ ﺇِﺳْﺮَﺍﺋِﻴْﻞَ ﺗَﺴُﻮْﺳُﻬُﻢْ ﺍﻷَﻧْﺒِﻴَﺎﺀُ ﻛُﻠَّﻤَﺎ ﻫَﻠَﻚَ ﻧَﺒِﻲٌّ ﺧَﻠَﻔَﻪُ ﻧَﺒِﻲٌّ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﺎ ﻧَﺒِﻲَّ ﺑَﻌْﺪِﻱْ ﻭَﺳَﻴَﻜُﻮْﻥُ ﺧُﻠَﻔَﺎﺀُ .
বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের উম্মাতকে (আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা) শাসন করতেন। যখন কোন একজন নবী মারা যেতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলীফা হবে। (সহীহ বুখারী, হাঃ৩৪৫৫; সহীহ মুসলিম হাঃ১৮৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাঃ৭৯৪৭; ইবনে মাজাহ হাঃ২৮৭১; ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৪৯৫, ৮/১১০, ১০/৫৭৭)

বিঃদ্রঃ হাদীসে উল্লেখিত ﺗَﺴُﻮْسُ শব্দটি سياسة 'সিয়াসাহ' থেকে উদগত। যার অর্থ 'রাজনীতি'। সুতরাং যেসকল মর্দে মুজাহিদ আল্লাহর দ্বীন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য (ইসলামী) রাজনীতি করে তারাই প্রকৃত ورثة الأنبياء নবীদের ওয়ারিছ তথা উত্তরাধিকারী। পক্ষান্তরে যারা ইসলামী রাজনীতির বিরোধীতা করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারাই আল্লাহদ্রোহী, তাগুতপন্থী ও নবীদের দুশমন। 

অতএব, ওহীর ইসলাম দ্বারা-ই প্রমাণিত যে, আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য নবী-রাসূলগণও রাজনীতি করেছেন। তাই আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনীতি করা ফরজ এবং তা তওহীদের অংশ। তাই তো শায়খ ইবনে উসাইমীন (রাহ) বলেছেনঃ 
আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা একদিক থেকে তা তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত, অপরদিকে তা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহকে একমাত্র আইনদাতা হিসাবে না মানলে তাওহীদুর রুবুবিয়্যাতে শিরক করা হয়। অপরদিকে আল্লাহ্‌র আইনকে না মেনে অন্য কারো আইনে বিচার-ফয়সালা করলে তাতে তাওহীদুল উলুহিয়াতে শিরক করা হয়। অনুরূপভাবে, আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইনের বিচার-ফয়সালা মনে-প্রাণে মেনে নেয়াও তাওহীদুল উলুহিয়াতে শিরক করা হয়। সুতরাং এ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, আইনদাতা হিসেবে আল্লাহকে মেনে নেয়া এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা তাওহীদের অংশ। (মাজমু ফাতাওয়া ও রাসাইলে ইবন উসাইমীন ২/১৪০-১৪৪ ও ৬/১৫৮-১৬২)।

Post a Comment

0 Comments