আল্লামা মওদুদী রাহঃ এর বিরুদ্ধে আতাউল করিম মাকসুদ, নাসিবীর মিথ্যাচার ও আমাদের জবাবঃ পর্ব ০১
------------------------------------------------------------------
চরমোনাই এর গৃহপালিত মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ দাবী করেন, আমীরে মুয়াবিয়ার শাসনামলে সুন্নাত পরিবর্তন করে বিদয়াত চালু করা ঘটনা- মাওলানা মওদুদীর নিজস্ব সংযোজন।
আমরা মুফতি সাবকে সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, এটি আল্লামা মওদুদী রাহঃ এর নিজস্ব সংযোজন নয়; বরং নির্ভরযোগ্য ইতিহাস ও তাফসীর গ্রন্থের পাশাপাশি সহীহ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত যে, আমীরে মুয়াবিয়া সুন্নাতের বিরোধী ও সুন্নাত পরিবর্তন করে বিদয়াত চালু করেছেন। আমরা সাধারণত এসব বিষয়ে কলম ধরতে চাইনা। কিন্তু নাসিবীরা আমাদের কলম ধরতে বাধ্য করায়।
০১. আবূ নাজীহ আল-ইরবাদ ইবনু সারিয়াহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
"وعظنا رسول الله صلى الله عليه وسلم موعظة بليغة وجلت منها القلوب وذرفت منها العيون، فقلنا: يا رسول الله كأنها موعظة مودع فأوصنا. قال: "أوصيكم بتقوى الله ، والسمع والطاعة وإن تأمر عليكم عبد حبشي، وإنه من يعش منكم فسيرى اختلافاً كثيراً. فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، عضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور فإن كل بدعة ضلالة" (رواه أبو داود، والترمذي وقال : حديث حسن صحيح).
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী বক্তৃতা শুনালেন যে, তাতে অন্তর ভীত হল এবং চোখ দিয়ে অশ্রু বয়ে গেল। সুতরাং আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায়ী ভাষণ মনে হচ্ছে। তাই আপনি আমাদেরকে অন্তিম উপদেশ দিন।’ তিনি বললেন, ‘‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি এবং (মুসলিম উম্মাহর খলিফার) কথা শোনার ও তার আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি; যদিও তোমাদের উপর কোন নিগ্রো রাষ্ট্রনেতা হয়। (স্মরণ রেখো) তোমাদের মধ্যে যে আমার পর জীবিত থাকবে, সে অনেক মতভেদ বা অনৈক্য দেখবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে মজবূত করে ধরে থাকবে। আর তোমরা দ্বীনে নব উদ্ভাবিত কর্মসমূহ (বিদ‘আত) থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।’’ (আবূ দাউদ হাঃ ৪৬০৭, তিরমিযী হাঃ ২৬৭৬, ইবনে মাজাহ হাঃ ৪২, মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৬৬৯৪, ১৬৬৯৫; দারেমী হাঃ ৯৫, রিয়াযুস স্বালিহীন হাঃ ১৬১, মিশকাত হাঃ ১৬৫)
এ হাদীসে খলিফাতুল মুসলিমীনের কথা শোনা ও তাঁর আনুগত্য করতে এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত (আদর্শ) কে আঁকড়ে ধরতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমীরে মুয়াবিয়া সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের অন্তর্ভুক্ত খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) এর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা তো দূরের কথা; তিনি তাঁর খিলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন এবং বিদয়াতের জন্ম দিয়েছেন।
০২. প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু জার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত,
عن أبى ذر رضي الله عنه ، قال: قال النبي صلى عليه وسلم: «أولُ مَنْ يُبدِّلُ سُنَّتىْ رجُلٌ مِنْ بَنِىْ أُمَيَّة». أخرجه ابن أبى شيبة (7/260 ، رقم 35877) بسند صحيح ، وعزاه الذهبى فى السير (1/330) للرويانى. وأخرجه ابن عساكر (65/250) ، وإسناده صحيح. وصححه الألباني فيما سماه "السلسلة الصحيحة" (4/329 ، رقم 1749).
হযরত আবু জার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “আমার সুন্নাত (ধর্ম ও শাসন ব্যবস্থার নিয়ম-নীতি) সর্বপ্রথম পরিবর্তন করবে বনু উমাইয়ার একজন পুরুষ (মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান)।” (সহীহ সনদে মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাঃ ৩৫৮৭৭ এবং আলবানী কর্তৃক তাঁর সিলসিলা সহীহাহ হাঃ ১৭৪৯ বিশুদ্ধ বলে উল্লেখিত)
উমাইয়া বংশের মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানই প্রথম ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাত পরিবর্তন করেছেন।
০৩. আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِنْ رِجَالِكُمْ ۖ فَإِنْ لَمْ يَكُونَا رَجُلَيْنِ فَرَجُلٌ وَامْرَأَتَانِ.
তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দু’জন সাক্ষী রাখ। অতঃপর যদি তারা উভয়ে পুরুষ না হয়, তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী সাক্ষী হবে। (সূরা বাকারা ২/২৮২) কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, সাক্ষীর ক্ষেত্রে দুজন পুরুষ পাওয়া না গেলে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা প্রযোজ্য। কিন্তু আমীরে মুয়াবিয়া প্রথম ব্যক্তি যিনি একজন সাক্ষী ও বাদীর পক্ষ থেকে কসমের কসমের সাহায্যে ফয়সালা শুরু করেন। এ বিষয়ে ইমাম যুহরীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, بدعة وأول من قضى بها معاوية. এটা বিদয়াত। আর সর্বপ্রথম এই বিদয়াত দ্বারা বিচারকার্য সম্পন্ন করে মুয়াবিয়া। (মুয়াত্তা মুহাম্মদ হাঃ ৮৪৬; আহকামুল কুরআন লিজ জাসসাস ২/২৬১)
০৪. ইমাম যুহরী (১২৪ হিঃ) আরো বলেন,
وإنها البدعة وأول من قضى به معاوية.
নিঃসন্দেহে তা বিদয়াত। আর এ বিদয়াত দ্বারা সর্বপ্রথম বিচারকার্য সম্পন্ন করেন মুয়াবিয়া। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাঃ ২৩২৭৬; আহকামুল কুরআন লিজ জাসসাস ২/২৬১)
০৫. আল্লামা সাদরুশ শারিয়া বলেছেন,
ذكر في المبسوط ان القضاء بشاهد ويمين بدعة وأول من قضى به معاوية.
মাবসুত কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক সাক্ষী ও এক কসমের উপর ভিত্তি করে বিচার ফায়সালা করা বিদয়াত। আর এ বিদয়াত দ্বারা সর্বপ্রথম বিচারকার্য সম্পন্ন করেন মুয়াবিয়া। (আত-তাওজিহ ওয়াত তালবিহ পৃঃ ৩১১)
০৬. ইমাম আবু বকর জাসসাস (৩৭০ হিঃ) বলেন,
أنه قد علم أن معاوية أول من قضى به وأنه بدعة.
এটা জানা কথা যে, সর্বপ্রথম মুয়াবিয়া এই ভিত্তিতে বিচার ফায়সালা করেছেন এবং তা বিদয়াত। (আহকামুল কুরআন লিজ জাসসাস ২/২৬১)
০৭. বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম মাসরুক বলেন,
ما أحديث في الإسلام قضية اعجب من قضية قضاها معاوية قال كان يورث المسلم من يهودى والنصرانى من المسلم.
ইসলামের মধ্যে এর নব উদ্ভাবিত বিদয়াতি ফায়সালা আর নেই, যে ফায়সালা মুয়াবিয়া করেছেন। তিনি মুসলমানদের ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের ওয়ারিস নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু তাদেরকে মুসলমানদের ওয়ারিস নির্ধারণ করেননি। (আহকামুল কুরআন লিজ জাসসাস ২/১২৩)
০৮. আল্লামা আব্দুল হাই লেখেন,
هى بدعة وأول من قضى به معاوية.
এটি বিদয়াত। মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম এ বিদয়াতের প্রচলন করেন। (আত-তালিকুল মুমাজ্জাদ পৃঃ ৩৬১)
০৯. শরহে বেকায়া গ্রন্থে 'দাবী' অধ্যায়ে এসেছে,
عندنا هذا بدعة وأول من قضى به معاوية.
আমাদের নিকট এটি বিদয়াত। মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম এ বিদয়াতের প্রচলন করেন। (শরহে বেকায়া পৃঃ ২৫, হিঃ ১৩২৬ প্রকাশিত)
১০. আল্লামা মুঈনউদ্দীন নাদভী রহঃ বলেন,
"আমীরে মুয়াবিয়া কর্তৃক খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) এর মুকাবেলায় যুদ্ধ করা, যুদ্ধে জয়লাভ করার অভিপ্রায়ে বৈধ অবৈধ সব ধরণের পন্থা অবলম্বন করা, পরবর্তী খলিফা হযরত হাসান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, ইসলামী খিলাফাতকে রাজতন্ত্রে পরিবর্তন করা, (এক কথায় বলা যায়) মুয়াবিয়ার শাসনামলের প্রতিটি ঘটনা এমন প্রকাশ্য ভ্রান্তিময় যাকে সত্যাশ্রয়ী লোক কখনো সমর্থনযোগ্য ও পছন্দনীয় বলে গণ্য করতে পারে না। বিশেষত ইয়াযীদের মনোনয়নে খিলাফাতের চেতনা চিরতরে শেষ হয়ে যায় এবং ইসলামে বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক প্রথা চালু হয়। এসব ঘটনায় শুধু সাধারণ লোকই নয় সমাজের সত্যপ্রিয় বিশিষ্ট লোকজনও আমীরে মুয়াবিয়া সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করতে থাকেন। তার প্রবর্তিত বিভিন্ন বিদয়াতের মধ্যে ইসলামী খিলাফাতকে ব্যক্তিগত ও রাজতন্ত্রে পরিণত করার বিদয়াত ছিল সবচেয়ে নিন্দনীয় যা ইসলামী খিলাফাতের মূল প্রাণ সত্তাকে চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়।" (সিয়ারুস সাহাবা, ৬/৯৩)
আমীরে মুয়াবিয়া যে, সুন্নাত পরিবর্তন ও সুন্নাতের বিরোধিতা করে বিদয়াতের প্রচলন করেছেন; এটি কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং তা আল্লামা মওদুদী রাহঃ এর নিজেস্ব সংযোজন বা বানোয়াট কথা নয়। বরং নাসিবী মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ সাহেবের ইলমি খিয়ানত।
0 Comments