Recent Tube

আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণ: শাহ আবদুল হান্নানের চিন্তাধারা- প্রফেসর ড. আ. ক. ম. আবদুল কাদের (প্রথম কিস্তি)



আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণ: শাহ আবদুল হান্নানের চিন্তাধারা- 
প্রফেসর ড. আ. ক. ম. আবদুল কাদের 
(প্রথম কিস্তি)

  আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন: মহান আল্লাহ যখন তাঁর কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জিবরাঈল (আ.) - কে ডেকে বলেন- আমি আমার অমুক বান্দাকে ভালোবাসি। অতএব, তুমিও তাকে ভালোবাস। ফলে জিবরাঈল (আ.) তাকে ভালোবাসতে থাকে এবং সে আসমানে ঘোষণা দিয়ে বলে, মহান আল্লাহ তাঁর অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন। অতএব, তোমরাও তাকে ভালোবাস। ফলে আসমানবাসী তাকে ভালোবাসতে থাকে। অতঃপর জমীনে তাকে গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করা হয়। অর্থাৎ- দুনিয়াবাসীও তাকে ভালোবাসতে থাকে। [বুখারী- ৭৪৮৫; মুসলিম- ২৬৩৭; মিশকাত- ৫০০৫]

  মহান আল্লাহর ভালবাসা, জিবরাঈল (আ.) এবং আসমানের সকল ফেরেস্তার ভালোবাসা অর্জনপূর্বক জমীনে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন কঠোর সাধনা, নিরলস প্রচেষ্টা এবং অনবরত অধ্যবসায়। আর তা কেবল মহান ব্যক্তিবর্গের পক্ষেই সম্ভব। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে মরহুম শাহ আবদুল হান্নানকে এই পর্যায়ের মহান ব্যক্তিগণের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর এই ক্ষেত্রে তাঁর বংশীয় ঐতিহ্য, পারিবারিক পরিমণ্ডল, আদর্শিক চেতনা, ব্যক্তিগত অধ্যবসায়, আদর্শিক গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন এবং কিছু আদর্শবান মানুষের সাহচর্য তাঁকে এই পর্যায়ে উন্নীত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

  ইংরেজ কবি Alexander Selkirk বলেছেন, Society, Friendship and Love, divinely bestowed upon man. সমাজ, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত বিষয়। একটি আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য প্রয়োজন সমাজের অন্তর্গত মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের মূলে থাকবে প্রেম প্রীতি ও ভালোবাসার অটুট বন্ধন। মূলত শাহ আবদুল হান্নানের চিন্তা ও মনন এই দর্শনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।

  শাহ আবদুল হান্নানের সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের একটি রেস্ট হাউসে একান্ত পরিবেশে। তাঁর সান্নিধ্যের এই ধারাবাহিকতা তাঁর জীবনের সর্বশেষ দিনগুলো পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এই পরিক্রমায় আমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক থ্যট এবং বাংলাদেশ ইসলামিক ল এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টারের পরিচালনা পর্ষদ ও বিআইআইটি ট্রাস্ট- এর সাথে যুক্ত হয়ে তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি এবং খুব কাছে থেকেই তাঁর চিন্তাধারা পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছি।

  বর্তমান পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তাঁর চিন্তাধারা ছিল প্রচলিত ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। এর পরেও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে তাঁর কখনো কোন অসুবিধা হয়নি। তাঁর সকল চিন্তা- চেতনার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আলোকিত মানুষ, আদর্শিক সমাজ, সমৃদ্ধ দেশ এবং শান্তিময় বিশ্ব। আর এই লক্ষ্য অর্জনে তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মপরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী।

  আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হলো আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষা। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই দিকটি উপেক্ষিত। ফলে আমাদের সমাজে আদর্শবান ও চরিত্রবান নাগরিক তৈরি হচ্ছে না। এতে করে সমাজের সকল স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়। এর থেকে উত্তরণের জন্য শাহ আবদুল হান্নান প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সামনে অগ্রসর হন। প্রথমত ব্যক্তিগত জীবনে কখনো দুর্নীতি এবং অন্যান্য অনিয়মকে প্রশ্রয় দেননি।

  অতঃপর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক থ্যট, বাংলাদেশ ল রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার, পাইওনিয়ার, উইটনেস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জ্ঞানের ইসলামীকরণ, ইসলামী আইনের উপর মৌলিক গবেষণা ও প্রকাশনা এবং মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে আদর্শিক চেতনা সৃষ্টির দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যার সুফল দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত নাগরিক ভোগ করে চলছে। এই পরিকল্পনাকে তিনি জীবনের মিশন এবং ভিশন হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। আর তাঁর এই সব কর্মসূচি ছিল সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত।

  শাহ আবদুল হান্নানের সকল চিন্তা চেতনার মূলে ছিল তাওহীদ। যার পেছনে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার চেতনা ক্রিয়াশীল ছিল। ইসমাইল রাজী আল ফারুকীসহ যেইসব স্কলার তাওহীদের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি সেইসব গ্রন্থ সংগ্রহ করে গভীরভাবে তা অধ্যয়ন করেন এবং সেগুলোর সার সংক্ষেপ লিখে তা পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
 মুসলিম যুবসমাজকে প্রচলিত গড্ডালিকা প্রবাহ হতে মুক্ত করে তাদের মধ্যে ঈমানী চেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান।

  এক. প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের রচিত মৌলিক ও অনূদিত গ্রন্থ গভীরভাবে অধ্যয়নের মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টি। এই ক্ষেত্রে তিনি সাইয়েদ মওদূদী, সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ আল গাযালী, ইউসুফ আল কারযাভী, আবদুল হামিদ আবু সুলাইমান প্রমুখ রচিত গ্রন্থাবলী অধ্যয়নের প্রতি জোর দেন।

  দুই. সকলের মধ্যে লেখা লেখির যোগ্যতা অর্জন। তিনি লেখনীর মাধ্যমে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সবাইকে গ্রন্থ প্রণয়ন, পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা ইত্যাদির প্রতি জোর দেন। এমনকি, অনলাইনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের প্রতিও তিনি আহ্বান জানান।

  তিন. আধুনিক সকল মাধ্যমকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে ব্যবহার। এই ক্ষেত্রে তিনি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়াসহ সকল মিডিয়াতে আদর্শিক লোকদের উপস্থিতি অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেন।

  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি তাঁর বিশেষ নির্দেশনা ছিল, আদর্শিক বিষয়ের সমন্বয়ে এবং ইসলামী নীতিমালার সংযোগ সাধনপূর্বক মৌলিক পাঠ্যবই রচনা এবং তা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করে শ্রেণীকক্ষে ইসলামী আদর্শ তুলে ধরা এবং ভালো ছাত্র ছাত্রীদের দাওয়াতী কাজে সম্পৃক্ত করা।

  তাঁর মতে, আদর্শ সমাজ আসমান থেকে নাজিল হবে না। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কুরআন সুন্নাহ অনুসরণে স্বাভাবিক দাওয়াতী কাজের মধ্য দিয়ে অর্জিত হবে। যেহেতু মানব সমাজ মানুষের মাধ্যমে পরিবর্তিত হবে, তাই যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে মধ্যপন্থা অনুসরণ করেই তা সম্ভব। তিনি প্রায়ই সহীহ মুসলিম গ্রন্থে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করতেন। আর তা হলো, هلك المتنطعون অর্থাৎ- যারা মধ্যমপন্থা বাদ দিয়ে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।

  শাহ আবদুল হান্নানের মতে, দ্বীনের দায়ীগণকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হয়ে যথাসম্ভব নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দাওয়াতী ময়দানে কাজ করা উচিত। এতে করে অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো সম্ভব হবে। রাজনীতির ময়দানে শক্ত প্রতিপক্ষের সংখ্যা অনেক বেশী। পক্ষান্তরে, Intellectual Movement এ প্রতিপক্ষের সংখ্যা নগণ্য। তাই ইসলামিক স্কলারদেরকে Intellectual Movement এ নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলী অর্জন করতে হবে।

  বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া তথা ইসলামভীতি একটি বড় সমস্যা। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে পাশ্চাত্যের কিছু বুদ্ধিজীবী। আর একে বাস্তবায়ন করছে কিছু সংখ্যক প্রাচ্যবিদ। আর একে পরিপূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে দেশী- বিদেশী কিছু মিডিয়া। এদের নেতিবাচক কর্মকান্ড আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণের পথে বিরাট অন্তরায়। এই অন্তরায় দূরীকরণে ইসলামিক স্কলারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশী। মূলত ইসলামের ভবিষ্যত নির্ভর করছে ইসলামিক স্কলারদের গৃহীত পরিকল্পনা ও গবেষণার উপর। এই জন্য শাহ আবদুল হান্নান বিআইআইটিকে ইসলামের মৌলিক গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার উপর সদা জোর দিতেন। কারণ, সমাজে যোগ্য নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন যোগ্য স্কলারের। আর স্কলার তখনি যোগ্য হবেন যখন তিনি আদর্শিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবেন। মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়া যোগ্য স্কলার এবং যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি সুদূর পরাহত। তিনি মনে করতেন, অনেক সময় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বেদখল হয়ে যেতে পারে, কিন্তু নিজেদের তৈরী স্কলার বেদখল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।

 শাহ আবদুল হান্নানের মতে, একক প্রচেষ্টায় কখনো কোন মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এতে যেমন আভ্যন্তরীন বিভিন্ন পক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন, অনুরূপভাবে মুসলিম উম্মাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে মুসলিম উম্মাহর আন্তঃরাষ্ট্রীয় ফোর্সগুলোকেও এই ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। এই জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। কারণ, এককভাবে কোন মহৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আর কোথাও তা বাস্তবায়ন হলেও সেটি টেকসই হয় না।

Post a Comment

0 Comments