Recent Tube

নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, তাসবীহ, তিলাওয়াত ট্রেনিং কোর্সঃ ২য় পর্ব, মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

      -----------------------------------
        ইসলামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রুকন সালাত বা নামায। আল্লাহ তা'আলা বান্দার জন্য নামায কে ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি নামাযের ফরযিয়্যাত কে অস্বীকার করবে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির বলে গণ্য হবে। 
নামাযের অনেক গুরুত্ব ও তৎপর্য রয়েছে। সকল ধরণের পাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে এবং বাস্তব জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার ক্ষেত্রে নামাযের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নামায আদায় না করার পরিণাম জাহান্নাম।
.
     জাহান্নামীদের প্রশ্ন করা হবে- 
مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ. قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ.
কিসে তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাল? তারা বলবে, ‘আমরা সালাত আদায়কারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না’। (সূরা মুদ্দাসসিরঃ৭৪/৪২-৪৩)
.
   পক্ষান্তরে যারা সালাতে যত্নবান এবং সালাতের হক যথাযথভাবে আদায় করে তারা জান্নাতে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। আল্লাহ তা'আলার বলেন,
وَالَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ. أُولَٰئِكَ فِي جَنَّاتٍ مُكْرَمُونَ.
যারা নিজদের সালাতে যত্নবান, তারা জান্নাতে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা মা'আরিজঃ৭০/৩৪-৩৫)
.
      তবে সকলেই সালাত আদায়ের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করবে- বিষয়টি এমন নয়। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
 «رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ».
 কতক রোযাদার আছে যাদের রোযার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারে না। কতক সালাত আদায়কারী আছে যাদের সালাতের বিনিময়ে রাত জাগরণের কষ্ট ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারে না। (মুসনাদে আহমাদ হাঃ ৮৬৩৯, ৯৩৯২; ইবনে মাজাহ হাঃ ১৬৯০, দারেমী হাঃ ২৭২০; মিশকাত হাঃ ২০১৪; নামায-রোযার হাকীকত পৃঃ ৫৫; সহীহুত তারগীব ১/১৬২)
.
       অর্থাৎ শুধু পাঁচ ওয়াক্ত সালাতই নয় বরং রাত জেগে তাহাজ্জুদের সালাত আদায়কারী ব্যক্তির মধ্যেও কতক লোক আছে যারা সালাতের বিনিময়ে রাত জাগরণের কষ্ট ছাড়া কোন নেকী অর্জন করতে পারে না। এ পর্যায়ে যে কোন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে নামায রোযা আদায় করার পরও কোন নেকী অর্জন করতে পারে না, তারা কারা? জবাব হলো- তারা সেই সকল লোক যারা নামায রোযাকে ট্রেনিং কোর্স মনে করে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান পালনের শিক্ষা অর্জন করে না।

      আল্লাহ তা'আলা মানুষকে তাঁর 'ইবাদত' তথা দাসত্ব ও গোলামী করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতএব মানুষের সমগ্র জীবনই তাঁর গোলামী ও দাসত্বে অতিবাহিত হওয়াই একান্ত বাঞ্ছনীয়, জীবনের কোন একটি মুহূর্তেও মানুষ তাঁর 'ইবাদত' থেকে মুক্ত হয়ে অন্য কারো ইবাদত করতে পারে না। মুসলিমগণ প্রকৃত মুসলিম কি না এবং বাস্তব কর্মজীবনে সে আল্লাহর আইন পালন করে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ইবাদত করতে প্রস্তুত কি না, এর বাস্তব পরীক্ষা এবং প্রমাণ নেওয়ার জন্যই ট্রেনিং সরূপ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ব্যবস্থা। যারা নামায রোযা থেকে বাস্তব জীবনে আল্লাহর আইন পালনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে না বরং সালাতের শিক্ষা থেকে অমনোযোগী তাদের পরিণাম জাহান্নামের দুর্ভোগ। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ. الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ. الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ.

     অতএব সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য (জাহান্নামের) দুর্ভোগ, যারা নিজদের সালাতে অমনোযোগী, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে। (সূরা মাউনঃ১০৭/৪-৬)
.
        মূলত মুনাফিকরা সালাতের শিক্ষা থেকে উদাসীন। তারা লোক দেখানোর জন্যে এবং মুসলিম হওয়ার দাবী সপ্রমাণ করার জন্য সালাতে দাড়ায়। সালাতে আল্লাহকে লক্ষ্য করে বলে "আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি" কিন্তু বাস্তব জীবনে জাহেলী বিধান মেনে তাগুতের দাসত্ব করে। সালাতের শিক্ষার প্রতি ভ্ৰক্ষেপ না করা মুনাফিকদের অভ্যাস এবং ( سَاهُونَ ) শব্দের আসল অর্থ তাই। সালাতের মধ্যে কিছু ভুল-ভ্ৰান্তি হয়ে যাওয়ার কথা এখানে বোঝানো হয়নি। কেননা, এজন্যে জাহান্নামের শাস্তি হতে পারে না। সহীহ হাদীস সমূহে প্রমাণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনেও একাধিকবার সালাতের মধ্যে ভুলচুক হয়ে গিয়েছিল। (কুরতুবী, ইবন কাসীর)
.
    সালাতের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন,
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ ۖ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ.
আর সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুতঃ২৯/৪৫)

      নামাযের শিক্ষার মধ্যে এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং। এ আয়াতে নামাযের যে গুণ বর্ণনা করা হয়েছে তার দু’টি দিক রয়েছে। একটি তার অনিবার্য গুণ। অর্থাৎ সে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে। আর দ্বিতীয় তার কাঙ্ক্ষিত গুণ। অর্থাৎ নামায আদায়কারী কার্যক্ষেত্রে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখুক। বিরত রাখার ব্যাপারে বলা যায়, নামায অবশ্যই এ কাজ করে। যে ব্যক্তিই নামাযের ধরনের ব্যাপারে সামান্য চিন্তা করবে সে-ই স্বীকার করবে, মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য যত ধরনের ব্রেক লাগানো সম্ভব তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ব্রেক নামাযই হতে পারে। এর চেয়ে বড় প্রভাবশালী নিরোধক আর কী হতে পারে যে, মানুষকে প্রতিদিন পাঁচবার আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য আহ্বান করা হবে এবং তার মনে একথা জাগিয়ে দেয়া হবে যে, তুমি এ দুনিয়ায় স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী নও বরং এক আল্লাহর বান্দা এবং তোমার আল্লাহ‌ হচ্ছেন তিনি যিনি তোমার প্রকাশ্য ও গোপন সকল কাজ এমনকি তোমার মনের ইচ্ছা ও সংকল্পও জানেন এবং এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন তোমাকে আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজের যাবতীয় কাজের জবাবদিহি করতে হবে।
       এ নামাযের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েকবার তার বিবেকে প্রাণ সঞ্চার করা হচ্ছে, তার মধ্যে দায়িত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাকে দায়িত্বশীল মানুষে পরিণত করা হচ্ছে এবং যে আইনের প্রতি সে ঈমান এনেছে তা মেনে চলার জন্য বাইরে কোন শক্তি থাক বা না থাক এবং বিশ্ববাসী তার কাজের অবস্থা জানুক বা না জানুক নিজের আনুগত্য প্রবণতার প্রভাবাধীনে গোপনে ও প্রকাশ্যে সকল অবস্থায় সে সেই আইন মেনে চলবে-কার্যত তাকে এরই অনুশীলন (ট্রেনিং) করানো হচ্ছে।
       এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, অমুক লোক রাতে সালাত আদায় করে, আর সকাল হলে চুরি করে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অচিরেই তার সালাত তাকে তা থেকে নিষেধ করবে। (মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৪৭)
.
       যারা নামাযকে ট্রেনিং কোর্স মনে করে না এবং আল্লাহর নাফরমানি থেকে বিরত থাকে না তাদের নামায নামাযই নয়। ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণনা করেন, নবী ﷺ বলেছেনঃ
من لم تنهه صلوته عن الفحشاء والمنكر فلا صلاة له. 
“যার নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি তার নামাযই হয়নি।”(ইবনে আবী হাতেম) ইবনে আব্বাস (রা.) নবী (সা.) এর এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে,
من لم تنهه صلوته عن الفحشاء والمنكر لم يزدد بها من الله الا بعدا.
“যার নামায তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি তাকে তার নামায আল্লাহ‌ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছে।”
হাসান বসরী (র) একই বস্তু সম্বলিত হাদীস নবী (সা.) থেকে মুরসাল রেওয়ায়াতের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। (ইবনে জারীর ও বাইহাকী) ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে নবী করীমের ﷺ এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছেঃ
لا صلوة لمن لم يطع الصلوة وطاعة الصلوة ان تنهي عن الفحشاء والمنكر.
“যে ব্যক্তি নামাযের আনুগত্য করেনি তার নামাযই হয়নি আর নামাযের আনুগত্য হচ্ছে, মানুষ অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে।” (ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতেম)
   একই বক্তব্য সম্বলিত একাধিক উক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হাসান বাসরী, কাতাদাহ, আ’মাশ ও আরো অনেকের থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। (বিস্তারিত জানতে দেখুন- তাফহীমুল কুরআন)

.
   আল্লাহ তা'আলা বলেন,
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِ.
‘নিশ্চয় আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; সুতরাং আমার ইবাদাত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর’। (ত্বহাঃ২০/১৪)
       এখানে সালাতের মূল প্রশিক্ষণের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। মানুষ যেন আল্লাহ থেকে এবং আল্লাহর আইন থেকে গাফেল না হয়ে যায়। দুনিয়ার চোখ ধাঁধানো দৃশ্যাবলী যেন তাকে এ সত্য বিমুখ না করে দেয় যে, সে কারো বান্দা। এক কথায় আল্লাহর সাথে বান্দার দাসত্বের সম্পর্ক জড়িত করার সবচেয়ে বড় ট্রেনিং হচ্ছে সালাত।
------------------------------------------------  
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলান।       

Post a Comment

0 Comments