Recent Tube

বিতিকিচ্ছা-১৯, নুর মুহাম্মদ চৌধূরী।

বিতিকিচ্ছা-১৯, 

আয় বুঝে ব্যয়ঃ
-
            আয় বুঝে ব্যয় করার দিন নাকি আর নেই। সীমিত আয়ে আগাম বাজেট করা, অতঃপর তদনুযায়ী হাটি হাটি পাঁ পাঁ করে একান্ত ধৈর্য্যশীল মাটির মানুষের মত এগিয়ে যাওয়া আজ স্বপ্ন। আজকাল অর্ধ মাস অন্তে বাজেট পুনর্বিবেচনায় আসতে বাধ্য হয়ে কপালে হাত দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না কারো। এতএব এই ক্ষণে সেই দিন এসে হাজির হয়েছে, যেখানে ব্যয় বুঝে আয় করার চরম পেরেশানীতে ভোগে জীবন নির্বাহ করতেই হয় সবাইকে। তীব্র  প্রতিযোগীতার এই যুগে জীবন যাত্রার ব্যয় এখন অসম্ভব রকমে উর্ধ্বগামী। ব্যয়  অনুযায়ী সুপরিসর আয়ের পথ আবিষ্কার করাই আজ রীতিমত বুদ্ধিমানের কাজ হিসাবে সীকৃত। আগে যেখানে পায়ে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে শুন্য ব্যয়ে বাজারে কিংবা স্কুলে যাতায়াত চলতো, আজ সেখানে একটি বিশাল পরিবহন ব্যয় ছাড়া জীবন যাত্রা একেবারেই কল্পনাতীত। তার উপরও আছে সেলামী-যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। রিক্সা চালকের সেলামী, টেক্সী চালকের সেলামী, রেষ্টুরেন্টে ওয়েটারের সেলামী। আজ ন্যায্য পাওনায় সন্তুষ্টি কারো নেই বললেই চলে। অফিস আদালতে হাটে বাজারে সর্বত্র শুধু সেলামী আর সেলামী। সীমিত, সৎ আয়ে সংসার নির্বাহ করতে চান, -তো অন্য গ্রহে পথ খোজেন, এই বাজারে আপনার স্থান  নাই।

         বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্রের দাম বাড়ে, আর সেই সাথে তাল রেখে বাড়তেই থাকে সেলামীর রেট। মোটকথা পদে পদে হাই রেটের সেলামী দিতে দিতে সৎলোকের অবস্থা নাকাল। পাবলিকেরে যত দিবেন, ততই চাইবে। দেয়ার যতই সীমাবদ্ধতা থাক্, চাওয়ার কিন্তু শেষ নাই। দেশটা যেন এখন একটা সেলামীর বাংলাদেশ। ক'দিন আগে নাকি  মহামতি  বড় কর্তা আক্ষেপ করে বলেছেন, "এতো বেতন দেই তবু ওরা কেন দূর্ণীতি করে ? "

         তাহলে শুনুন  সেলামীর রেট নিয়ে একটি ঘটনা। রাত তিনটা বাজে, মহা সড়কে বাস ডাকাতি হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ডাকাতরা পুনর্বার এসে সব যাত্রীদের মাল সামানা ফেরৎ দেয়া শুরু করল। যাত্রীরা অবাক! ওরা কেন এমন করছে? কিভাবে, কেন হঠাৎ করে ওদের মতি পরিবর্তন হয়ে গেল? কেমন করে, কিসের প্রভাবে ওরা হঠাৎ করে ভাল মানুষ হতে চললো? সে যা ই হোক, মালগুলো যে সবাই ঠিকঠাক মত ফেরৎ পাচ্ছে -সে ই ভাল। এবার ডাকাত সর্দার যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলল, ভাই সব- আপনাদের প্রত্যেকে যার যার মাল ঠিক মত পেয়েছেন তো? সকলের পক্ষ থেকে একজন বলল,"জ্বী পেয়েছি"।  এবার ডাকাত সর্দার বলল, ভাই সব- সামনে পুলিশ ফাঁড়িতে যদি এই গাড়ী আটকায় তবে আপনাদের প্রতি আমাদের একটি অনুরোধ, আপনারা বলবেন "এই গাড়ীতে কোন ডাকাতী হয়নি"। সাহসী যাত্রীটি সকলের পক্ষ থেকে সম্মতি দিলে বিদায় নিল ডাকাত দল। বাস চললো অগ্রপানে। কিছুদুর যেতে না যেতেই পুুলিশের টহল দল থামালো গাড়ীটি। তারা গাড়ী নিরীক্ষণ শুরু করল। গাড়ীর সামনে যায়, পিছনে যায়, গাড়ীর নাম্বার প্লেট পর্যবেক্ষণ করে। যাত্রীরা কিন্তু নিরব। নেই কোন অভাব অভিযোগ । পুলিশ দল হতবাক! কি ব্যাপার? পথে কি এই গাড়ী  কোন ডাকাতীর কবলে পড়েছিল? এক পুলিশের প্রশ্ন যাত্রীদের উদ্দ্যেশ্যে। যাত্রীরা অস্বীকার করল। পুলিশটি অপেক্ষাকৃত বিষ্ময়ের সাথে জানতে চাইলো। কি বলেন,  হয়নি ডাকাতি? কিন্তু আমাদের সোর্স তো বলছে ডাকাতী হয়েছে। আপনারা কেন অস্বীকার করছেন? বলুন,  আপনাদের কোন ভয় নাই। আপনাদের নিরাপত্তার জন্যই তো আমরা। বলুন,  ডাকাতী হয়েছে কি? যাত্রীরা সকলেই বেমালুম অস্বীকার করল বিষয়টি। এবার পুলিশ দল নেমে যাবে গাড়ী থেকে। এমন সময় সাহসী যাত্রীটি পুলিশের উদ্দ্যেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো," দারোগা সাহেব, রেট কমান, রেট কমান, নতুবা ওরা আবার ডাকাতী ছেড়ে ভার্সিটিতে লেখাপড়ায় লেগে যাবে"। আসলে ডাকাতী করে প্রাপ্ত অংকটি পুলিশি বখরার অংকের চেয়ে স্ফীত হয়নি বলেই এমন ঘটনা।

        অনেকে বলে থাকেন দেশ নাকি আপাদমস্তক দূর্ণীতিতে ডুবে আছে। আমি কথাটিতে দ্বিমত করতে চাই। দূর্ণীতি আসলে পদে পদে নয়, মূলতঃ মস্তকে। মাথা ঠিক, তো সব ঠিক।  আগেকার দিনের মা-বাবারা সন্তান তথা অধীনস্থদের বলতেন, যাও, খেলতে যাও সমস্যা নাই, তবে কোন নালিশ যেন না আসে। আর আজ বড় কর্তার দেয়া টার্গেট অনুযায়ী দশটা মামলা নথিভুক্ত করতেই হবে তাকে। মাথা থেকে চাপিয়ে দেয়া  এই দানবীয় জুলুমনীতি, লোভের জিহ্বার দৌরাত্ম্যে মজে লাগামহীন দূর্ণীতি আর উচ্ছ মাত্রার সেলামীর খড়গ নিয়ে অধঃস্তনরা নাস্তানাবুদ। যার আনুপাতিক হারের পীড়নেই ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি আমরা, ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে দেশ ও জাতি। বেতন যতই বাড়ান, চাহিদার লাগাম টেনে না ধরলে দূর্ণীতি বন্ধ হবে কি কোন কারণে?  কিন্ত কাকে বলব লাগাম টানতে? সর্সের মধ্যেই যে ভুতের বাস!! বড় কর্তাইতো দূর্ণীতির বড় ঠিকাদার!!!

         আসলে আমার কি চাই, কতটুকু চাই?  আগে এই প্রশ্নের সমাধান কি করাটা দরকার নয়? চাহিদা মেটানোর প্রতিযোগিতার হাটে দিশেহারা হয়ে ক্রমশঃ আমরা কবরের পারেই পৌছে যাচ্ছি। অবশেষে যতটুকু আমাদের প্রয়োজন ছিল ততটুকুই আমরা পেলাম। সাড়ে তিন হাত মাটির তৈরী আলো বাতি হীন এক পোকা মাকড়ের ঘর। এ ছাড়া আর যা ছিল অর্জন, সবই হয়ে গেল পর। তারপরও দেখি আয় বুঝে ব্যয় করার সুশীল এক চিরন্তন নীতি ত্যাগ করে ব্যয় বুঝে আয় করার পাগলা নীতিতে মজতে মজতে ভীষণ  পেরেশানীতে ভোগতে আছে দুনিয়ার মানুষ। কোথায় যে এর শেষ? আল্লাহ মালুম। তবে আমরা কিন্তু "আয় বুঝে ব্যয়" করারই পক্ষপাতি।
-------------------------------------------------
  

Post a Comment

0 Comments