Recent Tube

কুরবানীর গোস্ত বণ্টনে যাদের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবেঃ---------- মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

কুরবানীর গোস্ত বণ্টনে যাদের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবেঃ

     আল্লাহ তা'য়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন কাউকে ধনী করে আবার কাউকে গরীব হিসাবে। তিনি চাইলে সবাইকে ধনী করতে পারতেন। কিন্তু তখন পরীক্ষা থাকত না। আল্লাহ তা'য়ালা কাউকে ধনী করে আবার কাউকে গরীব করে পরীক্ষা করতে চান যে, কে কে ধনী হয়ে আর কে কে গরীব হয়েও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি থেকে তাঁর বিধান মেনে চলে। খুব গরীব লোক যারা, তারা নিজেদের উপার্জনে জীবন পরিচালনা করলেও বিশেষ পরিস্থিতিতে তারা ধনীদের নিকট সাহায্যে হাত বাড়ায়। একটু সাহায্য পাওয়ার আশায় অন্যত্র গমন করে- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সাহায্য প্রার্থনা করে। ধনী-গরীবের মাঝে আর এক শ্রেণীর লোক আছে যারা খুবই গরীব না, আবার ধনীদের কাতারেও এরা সামিল নয়। এরা মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত তবে সম্ভ্রান্ত লোক। এরা স্বল্প আয়ে জীবন পরিচালনা করে। কোন পরিস্থিতিতে তাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেলেও কিংবা কোন কারণে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতায় কঠিন জীবন যাপন করলেও, তাদের আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা ধনীদের নিকট সাহায্যের হাত বাড়ায় না। এমনকি তারা তাদের কষ্টের কথাও কারো কাছে প্রকাশ করতে বা শেয়ার করতে চায় না। তবে কেউ কিছু দিলে তা নিয়ে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'য়ালা উল্লেখিত সকল শ্রেণীর লোকের কথাই তুলে ধরেছেন।


    কুরবানীর গোস্ত বণ্টনের বিষয়ে ধনীদের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ.
"তা থেকে (নিজেরা) খাও। আর যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদেরকে খেতে দাও।" (সূরা হজ্জ ২২/৩৬)
যাদেরকে হাদঈ ও কুরবানীর গোস্ত দেয়া প্রয়োজন, এই আয়াতে তাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। তাফসীর গ্রন্থ থেকে জানা যায, الْقَانِعَ ঐ অভাবগ্ৰস্ত ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে না, দারিদ্র্য সত্ত্বেও আত্মমর্যাদা রক্ষার স্বার্থে স্বস্থানে বসে থাকে, সাহায্যের জন্য কারো কাছে গমন করে না এবং কেউ কিছু দিলে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। পক্ষান্তরে الْمُعْتَرَّ ঐ অভাবগ্রস্ত বা হত দরিদ্র ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কিছু পাওয়ার আশায় অন্যত্র গমন করে- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সাহায্য প্রার্থনা করে। 

আল্লাহ তা'য়ালা আরো বলেন,
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ.
"নিশ্চয় যাকাত হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ  মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরা তওবা ৯/৬০)

   যাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় খাত হল যথাক্রমে ফকীর ও মিসকীন। ফকীর হল যার কিছুই নেই। শারীরিক ত্রুটি বা বার্ধক্যজনিত কারণে স্থায়ী বা সাময়িক ভাবে অন্য সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। তাই তারা ধনীদের নিকট সাহায্যের হাত বাড়ায়।

 আর মিসকীন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেই বলেন,
الْمِسْكِينُ الَّذِي لاَ يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ وَلاَ يُفْطَنُ بِهِ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ وَلاَ يَقُومُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ.
"যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতে পারে না, যাকে সাহায্য করার জন্য চিহ্নিত করা যায় না এবং যে নিজে দাঁড়িয়ে কারোর কাছে সাহায্যও চায় না, সেই মিসকীন।" (সহীহ বুখারী হাঃ ১৪৭৯, সহীহ মুসলিম হাঃ ১০৩৯, মুসনাদে আহমদ হাঃ ২৭২৬৮, ২৭৪০৪) অর্থাৎ সে একজন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র নিম্নবিত্ত (গরীব) মানুষ।

   নবী (সাঃ) الْمِسْكِينُ শব্দটির ব্যাখ্যা করে বিশেষ ভাবে এমন সব লোকদের সাহায্য লাভের অধিকারী বলে গণ্য করেছেন, যারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপায়-উপকরণ লাভ করতে পারেনি কিংবা বিশেষ কোন কারণে তাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে অথবা যতটুকু উপার্জন করতে পারে তা যথেষ্ট নয়, ফলে অত্যন্ত অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তবে তাদের বাহ্যিক অবস্থা এমন নয় যে, কেউ তাদের দেখে অভাবী মনে করবে। আবার তাদের আত্মমর্যাদা সচেতনা কারোর সামনে তাদের হাত পাতার অনুমতি দেয় না। 
আল্লাহ বলেন,
يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا.
"(আর্থিক সাহায্য) না চাওয়ার কারণে অনবগত ব্যক্তি তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদেরকে চিনতে পারবে তাদের বৈশিষ্ট্য দ্বারা। তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে চায় না।" (সূরা বাকারা ২/২৭৩)

  তারা অন্যের নিকট সাহায্যের হাত না বাড়ালেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) তাদের বৈশিষ্ট্য বলে দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, ঐ সম্ভ্রান্ত নিম্নবিত্ত লোকগুলোও যেন দান সাদকা, যাকাতের অর্থ ও কুরবানীর গোস্ত থেকে বঞ্চিত না হয়।

  কুরআন ও হাদীসে হত দরিদ্র লোকের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত লোকেরও কথা উল্লেখ করে তাদের দান করা বা হাদিয়া দেওয়ার নির্দেশ প্রদানের কারণ হল, তারা অসহায়; কোন সময় তারা হত দরিদ্র লোকদের চেয়েও বেশি কষ্টে দিন কাটায়। তারপরও কারো নিকট নিজের কষ্টের কথা বলে সাহায্য চায় না। এজন্য তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ধনীদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তাই আল্লাহর নিকট মাহবুব বান্দা তথা প্রিয় মানুষ হতে হলে আমাদের সকলের উচিত হল যারা সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় তাদের গোস্ত দান করার পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে সে সকল লোকদের খুঁজে বের করে কুরবানীর গোস্ত হাদিয়া দেওয়া জরুরী, যারা বিশেষ কোনো কারণে কুরবানী করতে পারছে না এবং কারো নিকট সাহায্যের হাতও বাড়ায় না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
أحب الناس إلي الله أنفعهم للناس و أحب الأعمال إلي الله سرور تدخله علي مسلم-
"আল্লাহ তা'য়ালার নিকট সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি প্রিয় যে মানুষের বেশি উপকার করে এবং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হল কোনো মুসলিমের হৃদয়ে আনন্দ প্রবেশ করানো।" (মাজযাউয যাওয়াইদ: ৮/১৯১; সহীহুল জামে: ১/৯৭; সহীহুত তারগীব: ২/৩৫৯)।
------------------------------------------------  
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গবেষক মাওলানা।       

Post a Comment

0 Comments