Recent Tube

রাজতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র: মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

   রাসূলুল্লাহ (সা) এর আগমণের সময় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল মূলত বংশতান্ত্রিক রাজতন্ত্র। রাষ্ট্রের মালিক রাজা। রাজার অন্যান্য সম্পদের মতই রাষ্ট্রের মালিকানাও লাভ করবে রাজার বংশধরেরা। রাজ্যের সকল সম্পদের মত জনগণও রাজার মালিকানাধীন। রাজা নির্বাচন বা রাজ্য পরিচালনা বিষয়ে তাদের কোনো মতামত প্রকাশের সুযোগ বা অধিকার নেই। রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বপ্রথম একটি আধুনিক জনগণতান্ত্রিক পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যবস্থার দু'টি বিশেষ দিক ছিল: 
(১) রাজা ও প্রজার সম্পর্ক মালিক ও অধীনস্থের নয় বরং রাজা তাদের খলীফা বা প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্য পরিচালনা করবেন। জনগণই রাষ্ট্রপ্রধান মনোনীত করবেন এবং জনগণ তাকে সংশোধন বা অপসরণ করবেন।
(২) রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণ করা জনগণের কাজ। জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে তা সম্পন্ন হবে। পরামর্শের ধরণ নির্ধারিত নয়। যুগ, দেশ ও জাতির অবস্থা অনুসারে তা পরিবর্তিত হতে পারে। (খুতবাতুল ইসলাম, পৃঃ ৩৪)
.
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ.
(হে নবী) কাজে-কর্মে জনগণের সাথে পরার্মশ কর। অতঃপর যখন সংকল্প করবে তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালবাসেন। (সূরা আলি ইমরানঃ৩/১৫৯)
.
    উল্লেখিত আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা) কে সাহাবীদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর পরামর্শ গ্রহণ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা কুরআনের দু’জায়গায় সরাসরি নির্দেশ দান করেছেন। একটি হলো এই আয়াতে এবং দ্বিতীয়টি হলো সূরা আশ-শূরার সে আয়াতে যাতে সত্যিকার মুমিন মুসলিমদের গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি গুণ এই বলা হয়েছে যে,
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ.
“(যারা সত্যিকার মুমিন) তাদের প্রতিটি কাজ হবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে”। (সূরা শূরাঃ৪২/৩৮)
এতদুভয় আয়াতে যেভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পরামর্শের অপরিহার্যতা প্রতীয়মান হয়, তেমনিভাবে এতে ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিধান সংক্রান্ত কয়েকটি মূলনীতিও সামনে এসে যায়। তা হলো এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র হলো পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র যাতে পরামর্শের ভিত্তিতে নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে থাকে। এমনকি আলোচনা ও পরামর্শ করাকে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একটি মৌলিক বিষয় হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
.
সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- 
مَنْ بَايَعَ أَمِيرًا عَنْ غَيْرِ مَشُورَةِ الْمُسْلِمِينَ فَلا بَيْعَةَ لَهُ، وَلا بَيْعَةَ لِلَّذِي بَايَعَهُ،
"যে ব্যক্তি মুসলিমদের পরামর্শ বা মতামত ছাড়াই আমীর (রাষ্ট্রপ্রধান) হিসাবে বাইয়াত নেয় তার বাইয়াত বৈধ হবে না। আর যারা তার বাইয়াত গ্রহণ করবে তাদের বাইয়াতও বৈধ্য হবে না।" (মুসনাদে আহমদ, হাঃ ৩৯১) 
.
     সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে জনগণের স্বাধীন মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) কাউকে শাসক মনোনীত না করে উম্মাতকে সরাসরি নির্বাচনের মুখোমুখি রেখে যান। জনগণের স্বাধীন মতামত (ভোট) এর মাধ্যমে আবূ বকর (রা) প্রথম খলীফা নির্বাচিত হন। আবূ বকর (রা) নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শক্রমে উমার (রা) কে পরবর্তী শাসক হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে যান। উমর (রা) ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে যান, যারা জনগণের পরামর্শ ও স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে তাঁদের মধ্য থেকে উসমান (রা) কে মনোনয়ন দেন। উসমান (রা) এর শাহাদতের পর জনগণের স্বাধীন মতামত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ পরামর্শের মাধ্যমে আলী (রা) শাসক মনোনীত করেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো খোলাফায়ে রাশেদীনের পর আমীরে মুয়াবিয়া (রা) শাসনামলে এর পরিবর্তন ঘটে।
.
   মুফতি মুহাম্মদ শফী (রাহঃ) বলেনঃ
ইসলামী খিলাফতের পারস্পরা যখন আমীরে মুয়াবিয়া (রা) পর্যন্তু এসে পৌঁছে, তখন রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে 'খিলাফতে রাশেদা'র সেই রূপ অনুপস্থিত থাকে, যে রূপ নিয়ে 'খোলাফায়ে রাশেদীন' রাষ্ট্র পরিচালনা করে ছিলেন। (শহীদে কারবালা, পৃঃ১৪)
.
  মদীনার গভর্নর মারওয়ান খুতবা দিলেন এবং বললেন, আমীরুল মুমিনীন মুয়াবিয়া (রা) হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) এর পদ্ধতি অনুযায়ী এই ইচ্ছা পোষণ করেছেন যে, তাঁর পরিবর্তে খলিফা হিসাবে তাঁর পুত্র ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করাবেন।
  এ সময় আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বকর (রা) দাড়িয়ে বললেন, হে মারওয়ান! আপনার এ বক্তব্য সঠিক নয়। হযরত মুয়াবিয়া যেটি চাচ্ছেন, এটি আবূ বকর (রা) ও ওমর (রা) এর পদ্ধতি নয়। বরং এটি পারস্য ও রোম সম্রাটের (রাজতান্ত্রিক) পদ্ধতি। হযরত আবূ বকর (রা) ও উমর (রা) তাঁরা তাঁদের পুত্রদের জন্য বাইয়াত নেননি এবং তাঁদের খিলাফতের দায়িত্বও প্রদান করে যাননি। এমন কি তাঁরা তাঁদের গোত্রদের কাউকেই স্থলাভিষিক্ত করে যাননি।
    মুফতি শফী আরো বলেনঃ
ইসলামী খিলাফত হচ্ছে খিলাফতে নুবুয়াত। এই খিলাফতে উত্তরাধিকারীদের কোনই অধিকার নেই যে, পিতার পর তাঁর পুত্র খলিফা হবে। বরং এখানে যেটা অতি প্রয়োজন, তা হচ্ছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে যোগ্যতার ভিত্তিতে খলিফা মনোনয়ন করা। (শহীদে কারবালা, পৃঃ ১৫-১৬),
--------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।      

Post a Comment

0 Comments