হিন্দুদের 'অবতার' এর আকিদায় আহলে হাদীসের সহীহ আকিদাঃ
মুসলিমদের আকিদা হলো- আল্লাহ তা'আলা একমাত্র প্রকৃত বিধানদাতা (সূরা মায়িদাঃ ৫/৫০, সূরা আন’আমঃ ৬/৫৭, সূরা ইউসুফঃ ১২/৪০ ও ৬৭; আবু দাউদ হাঃ ৪৯৫৫; নাসায়ী ৮/২২৬; বায়হাকী ১০/১৪৫ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত)। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষের উপর আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন জারি করার অধিকার নেই। আর মানুষও পারে না আল্লাহ ব্যতীত আর কারো আইন মেনে নিতে। আল্লাহর আইনের বিপরীতে অন্য কারো আইন মানলে তা হবে সুস্পষ্ট ভাবে আল্লাহর সাথে শিরক করা। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
ﻣَﺎ ﻟَﻬُﻢْ ﻣِﻦْ ﺩُﻭﻧِﻪِ ﻣِﻦْ ﻭَﻟِﻲٍّ ﻭَﻟَﺎ ﻳُﺸْﺮِﻙُ ﻓِﻲ ﺣُﻜْﻤِﻪِ ﺃَﺣَﺪًﺍ.
"তিনি (আল্লাহ) ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক, (আইনদাতা) নেই। তাঁর আইনে তিনি কাউকে শরীক করেন না।" (সূরা কাহফঃ ১৮/২৬)
.
ধর্মীয় জীবনসহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে একমাত্র হাকাম বা বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করা তাওহীদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর উলুহিয়্যাতের দাবী যে, বান্দা তাঁর হুকুমের আনুগত্য করবে। এজন্য আনুগত্য ইবাদতের অন্যতম প্রকাশ। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
أَفَغَيْرَ اللَّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلًا.
(বল) আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিধানদাতা মানব? অথচ তিনিই তোমাদের নিকট বিস্তারিত ভাবে (বর্ণনাসহ) কিতাব নাযিল করেছেন। (সূরা আন'আমঃ ৬/১১৪)
আল্লাহ তা'য়ালা বিধানদাতা হলেও তিনি নিজেই 'মানব' এর রূপ ধারণ করে তাঁর সৃষ্টি মানুষের মাঝে বিধান কার্যকর করেন না। এমনকি তিনি সব মানুষকে সরাসরিভাবে তাঁর বিধানও দেন না। বরং তিনি অসংখ্য মানুষের মধ্য থেকে কিছু সম্মানিত মানুষকে নির্বাচন করে তাঁদেরকে ওহীর মাধ্যমে তাঁর দ্বীন বা বিধান প্রদান করেন। আর এই নির্বাচিত ও সম্মানিত মানবরাই হলেন নবী ও রাসূল। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর দ্বীন তথা বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য নবী রাসূলদের নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা শুরাঃ৪২/১৩) আর নবী রাসূলগণই তাঁদের উম্মতের মাঝে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও বাস্তবায়নের জন্যই নেতৃত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ তা'য়ালা নবী রাসূলদের বিষয়ে বলেনঃ
ﻭَﺟَﻌَﻠْﻨَﺎﻫُﻢْ ﺃَﺋِﻤَّﺔً ﻳَﻬْﺪُﻭﻥَ ﺑِﺄَﻣْﺮِﻧَﺎ
আর তাদেরকে আমি নেতা বানিয়েছিলাম, তারা আমার বিধান অনুসারে মানুষকে সঠিক পথ দেখাত। (সূরা আম্বিয়াঃ২১/৭৩)
.
পক্ষান্তরে হিন্দুদের আকিদা হলো- স্রষ্টা স্বয়ং সৃষ্টির রূপ ধারণ করে বা কোন মানুষের উপর অবতরণ করে মানুষকে পথ দেখায়। এ জন্য হিন্দুরা তাদের ধর্মগুরুদের (যেমন- কৃষ্ণকে) স্রষ্টার অবতার বলে। একই আকিদা লালন করে হাল জামানার আহলে হাদীস। প্রমাণ হিসােব আহলে হাদীসের শায়খ মুযাফফর বিন মুহসিনের একটা দৃষ্টান্ত পেশ করারা যায়। শায়খ তার আকিদার বইয়ে লেখেন :
"যামাখশারী (৪৬৭-৫৩৮ হিজরী) সুরা ফাতহের ১০ নং আয়াতের অর্থ করেছেন এভাবে—
ﻳﺮﻳﺪ ﺃﻥ ﻳﺪ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺘﻲ ﺗﻌﻠﻮ ﺃﻳﺪﻯ ﺍﻟﻤﺒﺎﻳﻌﻴﻦ : ﻫﻲ ﻳﺪ ﺍﻟﻠﻪ، ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻣﻨﺰﻩ ﻋﻦ ﺍﻟﺠﻮﺍﺭﺡ ﻭﻋﻦ ﺻﻔﺎﺕ ﺍﻷﺟﺴﺎﻡ.
'তিনি ইচ্ছা করেছেন, রাসুল (সাঃ)-এর হাত বায়আতকারীদের হাতগুলোর উপর থাকবে। আর সেটাই আল্লাহর হাত। কারণ আল্লাহ তাআলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং শরীরের আকৃতি থেকে মুক্ত।' (তাফসীরে কাশশাফ ৪/৩৩৭)
এরপর শায়েখ বলেন, "তিনি প্রথমাংশে সঠিক উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পরের অংশে আল্লাহকে নিরাকার সাব্যস্ত করেছেন। অনুরূপ অর্থ করেছেন আবুল বারাকাত আন-নাসাফী। তাফসীরে বায়যাবীতেও (অনুরূপ) রূপক অর্থ করা হয়েছে। এ ধররণের রূপক অর্থ গ্রহণযোগ্য নয়।" (ভ্রান্ত আক্বীদা বনাম সঠিক আক্বীদা’ পৃ. ৩৮-৩৯)
.
এখানে শায়খ আল্লামা যামাখশারী রহ.-এর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। এরপর সেটাকে দু-ভাগ করেন। প্রথম ভাগকে সঠিক বলে আখ্যায়িত করেন এবং দ্বিতীয় ভাগকে গলদ বলে আখ্যায়িত করেন। প্রথম অংশ কী ছিল? দেখে নিন- "তিনি ইচ্ছা করেছেন, রাসুল (সাঃ) এর হাত বায়আতকারীদের হাতগুলোর উপর থাকবে। আর সেটাই আল্লাহর হাত।"
উদ্ধৃতিটা আরেকবার মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। "আর সেটাই আল্লাহর হাত" অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাতই আল্লাহর হাত—
এটি সঠিক আকিদা! আর "আল্লাহ তাআলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং শরীরের আকৃতি থেকে মুক্ত"—এটি গলদ আকিদা! (নাউযূবিল্লাহ)
.
প্রথম অংশকে সঠিক বলার অর্থ হলো, আহলে হাদীস হিন্দুয়ানী আকিদা হুলুলে বিশ্বাসী। হুলুল হলো আল্লাহর সত্তা অন্য কারও সত্তার মধ্যে অবতারিত হওয়া কিংবা অন্য কোনো সত্তা আল্লাহর সত্তার মধ্যে অবতারিত হয়ে যাওয়া। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, প্রভু মানুষ, প্রাণী, বৃক্ষ, পাথরসহ সবকিছুর মধ্যে অবতারিত হন। তো আহলে হাদীসের শায়খও হিন্দুদের মতো আকিদা প্রচার করছেন যে, "রাসুল (সাঃ)-এর হাতই আল্লাহর হাত"- এটাই উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য। আর এটাই সহীহ আকিদা (নাউযূবিল্লাহ)।
আর আল্লাহ তাআলাকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
এবং দেহের গুণাগুণ থেকে মুক্ত ভাবা
গলদ আকিদা। শায়খ দেহের গুণাগুণ
শব্দটির অর্থ করেছেন দেহের আকৃতি। শায়খ এতটাই দেহবাদে বিশ্বাসী যে, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের এই স্বীকৃত আকিদাটিকে গলদ বলে আখ্যায়িত করলেন। শুধু গলদই নয়, নিরাকার সাব্যস্তকরণ বলে আখ্যায়িত করলেন। আর তার দৃষ্টিতে নিরাকার মনে করা মানে অস্তিত্বহীন বলে বিশ্বাস করা।
.
বস্তুত, পবিত্র কুরআনে কোথাও আল্লাহর আকার, দেহ বা শরীর আছে এমন কোন কথা বলা হয়নি। কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর হাত, পা, চোখ, চেহারা ইত্যাদি সিফাতকে আহলে হাদীসগণ মানুষের মত দৈহিক অঙ্গ মনে করে আর এর উপর কিয়াস করে আল্লাহ তা'য়ালার দেহ/শরীর ও আকার সাব্যস্ত করেছে (নাউযুবিল্লাহ)।
নির্বিশেষে সকল ইমাম ও সালাফ বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ তাআলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও দেহের গুণাগুণ হতে মুক্ত। কিন্তু সালাফি নামধারী দেহবাদীরা প্রচার করছে ঠিক এর উলটো। আহলে সুন্নাহ ওয়ার জামায়াতের ভাষ্যকার ইমাম ত্বহাবী (রহ.) লেখেন :
ﻭﺗﻌﺎﻟﻰ ﻋﻦ ﺍﻟﺤﺪﻭﺩِ ﻭﺍﻟﻐﺎﻳﺎﺕِ ﻭﺍﻷﺭﻛﺎﻥِ ﻭﺍﻷﻋﻀﺎﺀِ ﻭﺍﻷﺩﻭﺍﺕ
"আর আল্লাহ তা‘আলা সীমা-পরিধি
থেকে উর্ধ্বে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সাজ-
সরঞ্জাম থেকে মুক্ত।" (আবূ জাফর ত্বহাবী, মাতানুল আকীদাহ আত-ত্বহাবিয়্যাহ, পৃঃ ১০)
.
কেউ বলতে পারেন, তাহলে তো আল্লামা যামাখশারীকেও হুলুলি বলতে হয়। এর জবাব হলো- না, যামাখশারী হুলুলি নন। তিনি যামাখশারী বাক্যের পূর্বাপর বাদ দিয়ে নিজের মনগড়া করে উপস্থাপন করেছেন। আহলে হাদীসের শায়খ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাতকে আল্লাহর হাত আখ্যায়িত করে বসলেও যামাখশারী তা করেননি। আল্লামা যামাখশারীর পুরো বাক্য দেখলে এর উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। কিন্তু বাক্যের আগপর বাদ দিয়ে খানিকটা অংশ দেখলে বিভ্রম তো হবেই। পুরো কথাটা নিম্বরূপ :
ﻟﻤﺎ ﻗﺎﻝ ﺇِﻧَّﻤﺎ ﻳُﺒﺎﻳِﻌُﻮﻥَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺃﻛﺪﻩ ﺗﺄﻛﻴﺪﺍ ﻋﻠﻰ ﻃﺮﻳﻖ ﺍﻟﺘﺨﻴﻴﻞ « ﻗﺎﻝ ﺃﺣﻤﺪ : ﻛﻼﻡ ﺣﺴﻦ ﺑﻌﺪ ﺇﺳﻘﺎﻁ ﻟﻔﻆ ﺍﻟﺘﺨﻴﻴﻞ ﻭﺇﺑﺪﺍﻟﻪ ﺑﺎﻟﺘﻤﺜﻴﻞ» ﻓﻘﺎﻝ ﻳَﺪُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﻮْﻕَ ﺃَﻳْﺪِﻳﻬِﻢْ ﻳﺮﻳﺪ ﺃﻥ ﻳﺪ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺘﻲ ﺗﻌﻠﻮ ﺃﻳﺪﻯ ﺍﻟﻤﺒﺎﻳﻌﻴﻦ : ﻫﻲ ﻳﺪ ﺍﻟﻠﻪ، ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻣﻨﺰﻩ ﻋﻦ ﺍﻟﺠﻮﺍﺭﺡ ﻭﻋﻦ ﺻﻔﺎﺕ ﺍﻷﺟﺴﺎﻡ، ﻭﺇﻧﻤﺎ ﺍﻟﻤﻌﻨﻰ : ﺗﻘﺮﻳﺮ ﺃﻥ ﻋﻘﺪ ﺍﻟﻤﻴﺜﺎﻕ ﻣﻊ ﺍﻟﺮﺳﻮﻝ ﻛﻌﻘﺪﻩ ﻣﻊ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺗﻔﺎﻭﺕ ﺑﻴﻨﻬﻤﺎ، ﻛﻘﻮﻟﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻣَﻦْ ﻳُﻄِﻊِ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝَ ﻓَﻘَﺪْ ﺃَﻃﺎﻉَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭﺍﻟﻤﺮﺍﺩ : ﺑﻴﻌﺔ ﺍﻟﺮﺿﻮﺍﻥ.
অর্থাৎ যেহেতু তিনি বলেছেন, “তারা তো আল্লাহর কাছেই বাইয়াত নেয়।”, সেহেতু তিনি এ ব্যাপারে কাল্পনিকভাবে তাকীদ দিলেন ৷ ইমাম আহমদ রহ বলেন, তাখীল তথা কল্পনা শব্দ বিলোপ করে শব্দটিকে তামছীল তথা উদাহরণ/দৃষ্টান্ত দ্বারা পরিবর্তন করলে (এটা) একটি চমৎকার উক্তি হবে। তাছাড়া তিনি (আল্লাহ) বলেন, “আল্লাহর হাত তাদের হাতসমূহের উপর।” (দ্বারা) উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা) এর হাত যেটি সকল বাইয়াতকারীদের হাতের উপর (ছিল)। আর এটাই মূলত আল্লাহর হাত। আর আল্লাহ তা’আলা দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ এবং দৈহিক গুণাগুণ/বৈশিষ্ট্য থেকে সমপূর্ণ পবিত্র। সুতরাং (এখানে) মর্মার্থ হচ্ছে, আল্লাহ ও তার রাসুলুল্লাহ (সা) এর মাঝে কোন পার্থক্য ছাড়াই রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে অঙ্গীকার করার সিদ্ধান্ত (যা মূলত) আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করার মতই। যেমন, আল্লাহ তা’আলার বানী, “যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এর আনুগত্য করলো সে মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করলো।” অতএব (এখানে মূল) উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘বাইয়াতুর রিদ্বওয়ান’ তথা সন্তুষ্টিমূলক আনুগত্যের শপথ। (তাফসীরে কাশশাফ ৪/৩৩৭)
[সংকলিত ও সম্পাদিত]
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।
0 Comments