Recent Tube

নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, তাসবীহ, তিলাওয়াত ট্রেনিং কোর্সঃ মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।


নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, তাসবীহ, তিলাওয়াত ট্রেনিং কোর্সঃ ৩য় পর্ব 
---------------------------------------
    সালাতের পরেই মুসলিমদের প্রতি আল্লাহ তা'আলা যে ইবাদত ফরয করেছেন তা হচ্ছে রমযান মাসের রোযা। আত্মার পরিশুদ্ধি, অাধ্যাত্মিক উন্নতি, মানবিক মমতাবোধের বিকাশ, সততা, তাকওয়া অর্জনসহ আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামীর ট্রেনিং হিসাবে সকল যুগের সকল বিশ্বাসী মানুষের জন্য অন্যতম প্রধান অবলম্বন হলো সিয়াম। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
"হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।" (সূরা বাকারাঃ২/১৮৩)
.
   রমযান মাসে যারা সিয়াম পালন করে তাদের দুটি শ্রেণী রয়েছে। প্রথম শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: 
َ«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَاناً وَاحْتِسَاباً، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»
“যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মপর্যালোচনার সাথে রমযানের রোযা পালন করে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (সহীহ বুখারী হাঃ ৩৫, ৩৭, ৩৮, ১৯০১, ২০০৮, ২০০৯, ২০১৪, সহীহ মুসলিম হাঃ ৭৬০, তিরমিযী হাঃ ৬৮৩, নাসায়ী হাঃ ২১৯৮, ২১৯৯, ২২০০, ৫০২৭, আবূ দাউদ হাঃ ১৩৭১, ১৩৭২, আহমাদ হাঃ ৭১৩০, ৭৭২৯, ৭৮৭৫, ৯১৮২, ৯৭৬৭, ১০১৫৯, ১০৪৬২, ২৭৬৭৫, দারেমী হাঃ ১৭৭৬)
.
 দ্বিতীয় শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
 «رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ».
কতক রোযাদার আছে যাদের রোযার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারে না। কতক সালাত আদায়কারী আছে যাদের সালাতের বিনিময়ে রাত জাগরণের কষ্ট ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারে না। (মুসনাদে আহমাদ হাঃ ৮৬৩৯, ৯৩৯২; ইবনে মাজাহ হাঃ ১৬৯০, দারেমী হাঃ ২৭২০; মিশকাত হাঃ ২০১৪; নামায-রোযার হাকীকত পৃঃ ৫৫)
.
  এরূপ রোযাদারদের প্রতি বদদোয়া করে তাদের দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
بعد من أدرك رمضان فلم يغفر له.
"যে ব্যক্তি রমযান মাস পেল কিন্তু এই মাসে তাকে ক্ষমা করা হলো না সেই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে চির-বঞ্চিত বিতাড়িত।" (মুস্তাদরাকে হাকীম ৪/১৭০; সহীহ ইবনে হিব্বান ২/১৪০-১৪১; সহীহুত তারগীব ১/২৬২)
.
   প্রশ্ন হলো দ্বিতীয় শ্রেণী মানুষ কোন কারণে নামায রোযা আদায় করার পরও কোন নেকী অর্জন করতে পারে না বরং রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রতি বদদোয়া করে দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়েছেন - তারা কারা? জবাব হলো- তারা সেই সকল লোক যারা নামায রোযাকে ট্রেনিং কোর্স মনে করে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান পালনের শিক্ষা অর্জন করে না। তারা পানাহার বর্জনের মধ্যেই সিয়াম কে বন্দি করে রাখে, সিয়ামের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজ বর্জনের ট্রেনিং গ্রহণ করে না। রাসূলুল্লাহ (সা) স্পষ্ট করে বলেন,
ليس الصيام من الأكل والشرب إنما الصيام من اللغو والرفث.
"পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়, সিয়াম হলো অনর্থক ও নাফরমানীমূলক কথা-কাজ বর্জন করা।" (মুস্তাদরাকে হাকীম ১/৫৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান ৮/২৫৫; সহীহুত তারগীব ১/২৬১)
.
     হারাম বা আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজেকর্মে রত থেকে হালাল খাদ্য ও পানীয় হতে নিজেকে বঞ্চিত রাখার নাম 'উপবাস' বলে গণ্য হতে পারে তবে ইসলামী 'সিয়াম' বলে গণ্য হবে না। সিয়াম হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সকল হারাম ও পাপ কাজ বর্জনের সাথে সাথে হালাল খাদ্য, পানীয় ও সম্ভোগ থেকে নিজেকে বিরত রেখে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান পালনের ট্রেনিং গ্রহণ করা।

     রোযাদার রোযা রেখে তার জীবনের প্রত্যেক চিন্তা, কথা ও কর্মে ‘তাকওয়া’ আনবে -এটাই বাঞ্ছিত। আর ‘তাকওয়া’ হল সেই আল্লাহ-ভীতির নাম, যার মাধ্যমে বান্দা তাঁর সকল আদেশ যথাসাধ্য পালন করে চলবে এবং যাবতীয় নিষিদ্ধ কর্ম থেকে সুদূরে থাকবে। বলা বাহুল্য, এটাই হল রোযার মহান উদ্দেশ্য ও প্রধান লক্ষ্য। পানাহার ও যৌনক্রিয়া নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে মানুষকে বৃথা কষ্ট দেওয়া রোযার উদ্দেশ্য নয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ». 
“যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও তার উপর আমল করা পরিহার না করল, তখন আল্লাহর কোন দরকার নেই যে, সে তার পানাহার ত্যাগ করুক।” (সহীহ বুখারী হাঃ ১৯০৩, ৬০৫৭, তিরমিযী হাঃ ৭০৭, আবূ দাউদ হাঃ ২৩৬২, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৬৮৯, আহমাদ হাঃ ১৫২৯, ১০১৮৪; নামায-রোযার হাকীকত, পৃঃ ৫৫)
.
     রোযা মন ও প্রবৃত্তিকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার অনুশীলন দেয়। জিতেন্দ্রিয় ও সংযমী হতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে রোযাদার তার মন ও প্রবৃত্তিকে সেই কাজে ব্যবহার করতে পারে; যাতে ইহ-পারলৌকিক সকল প্রকার মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত আছে। আর এমন আচরণ ও কর্ম থেকে তাকে দূরে রাখে; যাতে সে একটি ইন্দ্রিয়সেবী ও পাশবিক গুণসম্পন্ন মানুষ বলে পরিচিত হতে পারে; যেখানে সে কামনা-বাসনা ও লালসার প্রবণতা থেকে তাকে রুখতে সক্ষম হয় না।

     সুতরাং রোযা সেই মন্দপ্রবণ আত্মার বিরুদ্ধে লড়ায়ে বিজয়ী হতে মুসলিমকে সার্বিক সহযোগিতা করে, যে আত্মা সর্বদা হারাম কাজে লিপ্ত হতে চায়, অবৈধভাবে কাম-লালসা চরিতার্থ করতে চায়। রোযা রোযাদারের ইচ্ছাশক্তিকে সর্বপ্রকার পাপ ও কুপ্রবৃত্তির স্পর্শ থেকে দূরে থাকার ‘ট্রেনিং’ দেয়। রোযার মাঝে রয়েছে আত্মসংযম এবং কুপ্রবৃত্তির দমন।
রোযা পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ এবং তাঁর পূর্ণ দাসত্ব করার কথা শিক্ষা দেয়। এভাবে মুসলিম মহান আল্লাহর পূর্ণ দাসত্ব ও আনুগত্যের উপর দীর্ঘ প্রশিক্ষণ লাভ করে থাকে। (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ১০পৃঃ)
.
     রোযা হল পরহেযগার ও নেক লোকদের ট্রেনিং-ময়দান; যার মাঝে আল্লাহর দেওয়া পৃথিবীর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার উপর নিজেদের কর্তব্যের বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, রোযা দেহ-মনের জন্য একটি বড় রহমত। রোযার মাঝেই হৃদয় ও সকল চিন্তা-ভাবনা আল্লাহ তাআলার সাথে যুক্ত থাকে। সকল মনোবল তাঁর ভালোবাসা, আনুগত্য ও তাঁর পথে জিহাদের কাজে বর্ধিত ও সংবদ্ধ হয়ে থাকে। যার পশ্চাতে উদ্দেশ্য থাকে এই যে, আল্লাহর বিধানই সমুন্নত হোক এবং কাফেরদের বিধান হোক অবনত; সে কাফের যেমনই হোক, তার যে নাম বা উপাধি হোক অথবা যে প্রতীকই হোক। (ফাইয পৃঃ ১০৭)
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।         

Post a Comment

0 Comments