Recent Tube

"আল্লামা মওদুদী (রাহঃ)'' কি শায়েখ যাকারিয়ার মত নকল মুফাসসির???" Tanzil Islam।



আমাদের ভারত উপমহাদেশের কতিপয় ভাই বলে থাকেন, আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) পূর্ববর্তী কোনো মুফাসসিরের তাফসীর ফলো করেননি, তাই 'তাফহীমুল কুরআন' মনগড়া তাফসীর। এদের সাথে আহলে হাদীসের কতিপয় ভাইয়েরাও সুর মিলিয়ে ছিলেন। কিন্তু আমরা যখন প্রমাণ করেছি - আহলে হাদীসের মাদখালী শায়খ যাকারিয়া আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর প্রসিদ্ধ তাফসীর 'তাফহীমুল কুরআন' থেকে দাড়ি, কমাসহ একই শব্দ ও বাক্যে হুবাহু তাফসীর নকল করেছেন, কিন্তু 'তাফহীমুল কুরআন' এর কোনো রেফারেন্স দেননি বরং অনেক জায়গায় হাকাও ভাবে অন্য তাফসীরের রেফারেন্স দিয়ে তথ্য জালিয়াতি করেছেন; তখন শায়খের অন্ধ ভক্তগণ দাবী করে বসলেন যে, অামাদের শায়খ বিনা রেফারেন্সে তাফসীর কপি/নকল করেনি বরং মওদুদী (রাহঃ) প্রাচীন তাফসীর গ্রন্থ থেকে রেফারেন্স ছাড়াই তাফসীর নকল করেছেন। আর শায়খ 'তাফহীমুল কুরআন' থেকে কপি করেন নি বরং মওদুদী (রাহঃ) যাদের থেকে নিয়েছেন তিনিও তাদের থেকে নিয়েছেন। তাই মিলে গেছে! 
.
পাঠক বন্ধুগণ! আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর তাফসীরের সাধারণ নীতি হল-
(১) তিনি সাধারণত সরাসরি কুরআনের আয়াত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীসের উপর ভিত্তি করে তাফসীর করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আয়াত বা হাদীসের রেফারেন্স দিয়েছেন। যেমন- 
(ক) আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ.
"আর যে কোন বিষয়েই তোমরা মতবিরোধ কর, তার ফয়সালা আল্লাহর কাছে।" (আশ-শুরা: ৪২/১০)
এ আয়াতের তাফসীরে তিনি বলেন, "----আকীদাগত মতানৈক্যের ক্ষেত্রে হক কোনটি আর বাতিল কোনটি সে বিষয়ের ফায়সালা যেমন তিনিই করবেন তেমনি আইনগত ক্ষেত্রেও তিনিই ফায়সালা করবেন মানুষের জন্য কোনটি পবিত্র আর কোনটি অপবিত্র, কোনটি বৈধ ও হালাল আর কোনটি হারাম ও মাকরুহ? নৈতিকতার ক্ষেত্রে অন্যায় ও অশোভন কি আর ন্যায় শোভনীয় কি? পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনটি কার প্রাপ্য আর কোনটি প্রাপ্য নয়? জীবনাচার, সভ্যতা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোন্ পন্থা ও পদ্ধতি বৈধ আর কোনটি ভুল ও অবৈধ তাঁর সবই তিনি স্থির করবেন। এর ওপর ভিত্তি করেই তো আইনের মূলনীতি হিসেবে কুরআন মজীদে একথা বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে যে,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ.
'যদি কোন ব্যাপারে তোমরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ো তাহলে সেটিকে আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের কাছে ফিরিয়ে দাও' (নিসা: ৫৯)
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ- 
'আল্লাহ ও তাঁর রসূল যখন কোন ব্যাপারে ফায়সালা করে দেন তখন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীর জন্য সে ব্যাপারে কোন ইখতিয়ার থাকে না' (আহযাব: ২৬) এবং
 اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُو
 مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ-
তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে যা নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না।' (আ'রাফ: ০৩) ----"
(খ) আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا.
"আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বাড়িয়ে দেয়।" (সূরা বানী ইসলাঈল: ১৭/৮২)
এ আয়াতের তাফসীরে তিনি বলেন,
"যারা এ কুরআনকে নিজেদের পথপ্রদর্শক এবং নিজেদের জন্য আইনের কিতাব বলে মেনে নেয়, তাদের জন্য তো এটি আল্লাহর রহমত এবং তাদের যাবতীয় মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও তামাদ্দুনিক রোগের নিরাময়। কিন্তু যেসব জালেম একে প্রত্যাখ্যান করে এবং এর পথনির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করে এ কুরআন তাদেরকে এর নাযিল হবার বা একে জানার আগে তারা যে অবস্থায় ছিল তার ওপরও টিকে থাকতে দেয় না। বরং তাদেরকে আরো বেশী ক্ষতির মধ্যে ঠেলে দেয়। ------------ একথাটিই নবী (সাঃ) একটি ছোট তাৎপর্যবহ বাক্যের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
القرآن حجة لك أو عليك
অর্থাৎ 'কুরআন হয় তোমার সপক্ষে প্রমাণ আর নয়তো তোমার বিপক্ষে প্রমাণ।' (সহীহ মুসলিম, তাফহীমুল কুরআন: ৭/১৬১-১৬২)
আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর এ তাফসীরের মাঝখান থেকে বাদ দিয়ে ১ম ও শেষাংশের হাদীস সহ শায়খ বিনা রেফারেন্সে কপি করেছেন।
.
(২) নির্ভরযোগ্য প্রাচীন তাফসীর যেমন- তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে তাবারী, আহকামুল কুরআন, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে কাবীর, তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে বায়যাবী, ইবনে কাসীর, ফাতহুল কাদীর ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে যখন হুবাহ নকল করেছেন তখন তিনি রেফারেন্স প্রদান করেছেন। যেমন-
আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ 
ﺃَﻟَﻢْ ﺃَﻋْﻬَﺪْ ﺇِﻟَﻴْﻜُﻢْ ﻳَﺎ ﺑَﻨِﻲ ﺁﺩَﻡَ ﺃَﻥْ ﻟَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ ۖ ﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﻜُﻢْ ﻋَﺪُﻭٌّ ﻣُﺒِﻴﻦ ﻭَﺃَﻥِ ﺍﻋْﺒُﺪُﻭﻧِﻲ ۚ ﻫَٰﺬَﺍ ﺻِﺮَﺍﻁٌ ﻣُﺴْﺘَﻘِﻴﻢٌ 
"হে বনী আদম, আমি কি তোমাদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেইনি যে, ‘তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’? আর আমারই ইবাদাত কর। এটিই সরল পথ।" (সূরা ইয়াসীনঃ ৩৬/৬০-৬১) 
.
অত্র আয়াত দুটির তাফসীরে আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ 
"এখানে আবার আল্লাহ “ইবাদাত”কে আনুগত্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। ইতিপূর্বে তাফহীমুল কুরআনে আমি বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি। (দেখুন আল বাকারাহ, ১৭০; আন নিসা, ১৪৫; আল আনআম, ৮৭ ও ১০৭; আত তাওবা, ৩১ ; ইবরাহীম ৩২ ; আল কাহফ, ৫০; মারয়াম, ২৭; আল কাসাস, ৮৬ এবং সাবা, ৬৩ টীকা) এ প্রসঙ্গে এ আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে কবীরে যে চমৎকার আলোচনা করেছেন তাও প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন,- ﻟَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥ -মানে হচ্ছে ﻻﺗﻄﻌﻴﻮﻩ (তার আনুগত্য করো না)। এর সপক্ষে যুক্তি হচ্ছে, তাকে নিছক সিজদা করাই নিষিদ্ধ নয় বরং তার আনুগত্য করা এবং তার হুকুম মেনে চলাও নিষিদ্ধ। কাজেই আনুগত্য হচ্ছে ইবাদত। এরপর ইমাম সাহেব এ প্রশ্ন করেছেন যদি ইবাদতের অর্থ হয় আনুগত্য তাহলে, ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ ﺃَﻃِﻴﻌُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﺃَﻃِﻴﻌُﻮﺍ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝَ ﻭَﺃُﻭﻟِﻲ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮِ ﻣِﻨْﻜُﻢْ নিসাঃ৪/৫৯ আয়াতে আমাদের কি রসূল ও কর্তৃত্বশীলদের ইবাদাত করার হুকুম দেয়া হয়েছে? তারপর এ প্রশ্নের জবাব তিনি এভাবে দিয়েছেনঃ “তাঁদের আনুগত্য যখন আল্লাহর হুকুমে করা হয় তখন তা আল্লাহরই ইবাদাত এবং তাঁরই আনুগত্য হবে। দেখছেন না, ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে আদমকে সিজদা করলো এবং এটি আল্লাহর ছাড়া আর কারো ইবাদাত ছিল না। কর্তৃত্বশীলদের আনুগত্য একমাত্র তখনই তাদের ইবাদাত হতে পারে যখন এমন ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা হবে যে ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করার হুকুম আল্লাহ দেননি।” তারপর বলেন, “তোমার সামনে যদি কোন লোক আসে এবং তোমাকে কোন জিনিসের হুকুম দেয় তাহলে দেখো তার এ হুকুম আল্লাহর হুকুমের অনুসারী কিনা। অনুসারী না হলে শয়তান সে লোকদের সহযোগী হয়েছে। যদি এ অবস্থায় তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ও তার শয়তানের ইবাদাত করলে। অনুরূপভাবে তোমার নিজের প্রবৃত্তি যদি তোমাকে কোন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে তাহলে এক্ষেত্রে শরীয়াতের দৃষ্টিতে সে কাজটি করার অনুমতি আছে কিনা দেখো। অনুমতি না থাকলে তোমার প্রবৃত্তি নিজেই শয়তান হয়ে গেছে অথবা শয়তান তার সহযোগী হয়েছে এ অবস্থায় যদি তুমি তার আনুগত্য করো তাহলে তুমি তার ইবাদাত করলে।” সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে তিনি আবার বলছেন, “কিন্তু শয়তানের ইবাদাত করার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। কখনো এমন হয়, মানুষ একটি কাজ করে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সাথে তার কণ্ঠও তার সহযোগী হয় এবং মনও তার সাথে অংশ গ্রহণ করে। আবার কখনো এমনও হয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ একটি কাজ করে কিন্তু অন্তর ও কণ্ঠ সে কাজে তার সহযোগী হয় না। কেউ কেউ এমন অবস্থায় একটি গোনাহ করে, যখন তার অন্তর তাতে সায় দেয় না এবং তার কণ্ঠ সেজন্য আল্লাহর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এ অবস্থায় সে স্বীকার করে আমি এ খারাপ কাজ করেছি। এ হচ্ছে নিছক বাইরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে শয়তানের ইবাদাত। আবার এমন কিছু লোকও আছে যারা ঠাণ্ডা মাথায় অপরাধ করে এবং মুখেও নিজেদের এ কাজে আনন্দ ও সন্তোষ প্রকাশ করে। …এরা ভিতরে বাইরে উভয় পর্যায়ে শয়তানের ইবাদাতকারী। (তাফসীরে কবীর, ৭ খণ্ড, ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠা)" দেখুনঃ তাফহীমুল কুরআন, ১৩/২৯-৩০।
.
(৩) কুরআন, হাদীসের উপর ইজতিহাদ করে কিংবা নির্ভরযোগ্য প্রাচীন তাফসীরগুলো সমন্বয়ে নিজের গবেষণালব্ধ তাফসীর নিজের ভাষায় পেশ করেছেন  কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি সাধারণত রেফারেন্স প্রদান করেননি। আর এ ক্ষেত্রে রেফারেন্স দেওয়ার প্রয়োজনও নেই। 
.
উপরোক্ত নীতি শুধু আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) একার নয় বরং সকল মুফাসসিরের। সুতরাং শায়খ যাকারিয়ার অন্ধ ভক্তগণ যে দাবী করছেন, মওদুদী (রাহঃ) নিজেই অন্য তাফসীর গ্রন্থ থেকে তাফসীর হুবাহু নকল করে রেফারেন্স দেননি - তা মিথ্যাচার। তাদের কিয়ামত পর্যন্ত সময় দেওয়া হল-তারা প্রমাণ করুক যে, আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর তাফসীর থেকে শায়খ যাকারিয়া তাফহীমুল কুরআনের রেফারেন্স ব্যতীত যেভাবে দাড়ি, কমাসহ একই শব্দ ও বাক্যে তাফসীর নকল করেছেন, ঠিক তেমনি আল্লামা মওদুদী (রাহঃ)ও দাড়ি, কমাসহ একই শব্দ ও বাক্যে বিনা রেফারেন্সে অন্য কোন তাফসীর থেকে তাফসীর নকল করেছেন। আমরা চ্যালেঞ্জ দিলাম, কিয়ামত পর্যন্ত তারা তা প্রমাণ করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ! কেননা, এভাবে তিনি বিনা রেফারেন্সে হুবাহু তাফসীর নকল করেননি। আর যেখানে হুবাহু তাফসীর নকল করেছেন, সেখানে তিনি রেফারেন্স পেশ কনেছেন, যার প্রমাণ আমরা পেশ করেছি।
.
বিঃদ্রঃ পরবর্তীতে আমরা প্রমাণ পেশ করব যে, 'তাফহীমুল কুরআন' থেকে শায়খ যাকারিয়া হুবাহু তাফসীর নকল করে যেখানে হাকাও ভাবে অন্য তাফসীর গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়েছেন, তা ভূয়া, জাল ও মিথ্যা।
--------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা। 

Post a Comment

0 Comments