Recent Tube

মরুভূমির হাতছানি -১৮ --মুহিউল ইসলাম মাহিম চৌধুরী।

                                         মরুভূমির
             হাতছানি ;
                                   পর্ব-১৯

 আলোকিত নবীর আলোকিত নগরী মদীনা 
আল মুনাওয়ারা।

   মদীনাতুত তাইয়্যেবা,মদীনাতুর রাসূল,মদীনা অাল মোনাওয়ারা । 
যত নামেই এই পবিত্র নগরীকে ডাকুন না কেনো । সব নামেই যেন এ নগরীকে জান্নাতি ফুলের ঘ্রাণে মাতেয়ারা করে রেখেছে একটি নাম অার তা হলো মুহাম্মদ (স) । কারণ এখানে জীবনের দশটি বছর পার করেছেন সাইয়্যিদুনা,ক্বুদওয়াতুনা,রহমাতুল্লিল আলামীন,বিশ্বনবী (স)।  
আনসারী অার মুহাজীর সাহাবীসহ হুজুর (স) এর এটি হল অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র । 
এই মদিনাতেই তিনি তাওহীদের ভিত্তিতে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেছিলেন । ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল মদীনাতুত তায়্যিবা । 
আর এই নগরীকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর চিরনিদ্রার জায়গা হিসেবে । ওহীর বড় অংশটি এখানেই অবতীর্ণ হয়েছিল ।  
পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাকে বলা হয় দ্বিতীয় হারাম।
এখানে রক্তপাতসহ সকল ধরেনের ফ্যাসাদ,ফেৎনা,প্রানী হত্যা এবং গাছ কাটা  হারাম । 

হুজুর (স) বলেন,ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে ‘হারাম’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, আর আমি মদীনাকে তথা এর প্রস্তরময় দু’ভূমির মাঝখানের অংশকে ‘হারাম’ বলে ঘোষণা করছি- এর বৃক্ষসমূহ কাটা যাবে না এবং এর প্রাণী শিকার করা যাবে না।’
---সহীহ মুসলিম – ৩৩৮৩
      মুসলিম হৃদয়ে এ নগরীটির প্রতি রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও মর্যাদা। কেননা  স্বয়ং অাল্লাহ রাব্বুল অালামীন তাঁর প্রিয় হাবীবের জন্য এ জায়গাটিকে বাছাই করেছিলেন । এটি ছিল প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতভূমি।  

       আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নগরীকে বহুমাতৃক নামে অভিহিত করার কারণে  বহুগুনে বেড়ে গেছে মদীনার মর্যাদা । 

       ঐতিহাসিকগণ এ নগরীর বহু নাম উল্লেখ করেছেন। ‘আল্লামা সামহুদী’ এর ৯৪টি নাম উল্লেখ করলেও  ‘মদীনা’ নামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, যা আল-কুরআনে চার বার এসেছ। সূরা আত্-তাওবাহ: ১০১, ১২০, সূরা আল আহযাব: ৬০, সূরা আল-মুনাফেকুন: ৮
 আর হাদীসে রাসূলে নামটি এসেছে বহুবার ।

    নবী করিম (স) কখনও মদীনাকে ত্বাবা বলেছেন কখনও ত্বাইবা কখনও বা তাইয়্যিবা নামে ডেকেছেন । 
      ইমাম মুসলিম, জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহ তা’য়ালা এ মদীনাকে ‘ত্বাবাহ’ নামে নামকরণ করেছেন।’’ 
---সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৪২৩

     এ শহরের অন্যতম আরেকটি নাম হল ‘ত্বাইবাহ’ বা ‘ত্বাইয়েবাহ’। ইমাম মুসলিমের আরেকটি বর্ণনা এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘এ নগরী হল ত্বাইবাহ, ত্বাইবাহ, ত্বাইবাহ’’।
 --সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৫৭৩

     ত্বাবাহ ও ত্বাইবাহ কিংবা ত্বাইয়্যেবাহ শব্দগুলোর অর্থ হল পবিত্র বা উত্তম।  এছাড়াও  আদ-দার, আল-হাবীবা,দারুল হিজরাহ,দারুল ফাতহ ইত্যাদি নামে মদীনাকে অভিহিত করা হয় ।

   জাহেলী যুগে মদীনার নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নামে এ শহরটিকে অভিহিত করতে অপছন্দ করলেন । বললেন,এই জনপদের নাম হবে মদীনা। 

   ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আমাকে এমন এক জনপদে হিজরত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা অন্য সব জনপদকে গ্রাস করবে। লোকজন একে ইয়াসরিব বলে। অথচ এটি হল মদীনা।’’ 
--সহীহ বুখারী – ১৮৭১ ও সহীহ মুসলিম-৩৪১৯

   মদীনা হলো রাসূলের প্রিয় নগরী । এ নগরী যাতে অন্য সকলেরও প্রিয় হয়, সেজন্য তিনি আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছিলেন: ‘‘হে আল্লাহ! তুমি মদীনাকে আমাদের কাছে প্রিয় করে দাও, যেমনি ভাবে প্রিয় করেছ মক্কাকে, বরং তার চেয়েও বেশী প্রিয় কর।’’ --সহীহ বুখারী: ১৮৮৯, সহীহ মুসলিম: ৩৪০৮
নবীজির দোয়া তাঁর প্রতিপালকের কাছে মঞ্জুর হয়েছিল যার কারণে সারা দুনিয়ার মু'মীনদের ৃন উদগ্রীব হয়ে থাকে একটিবার সোনার মদীনা জিয়ারাতের জন্য । 

   নবীজি তাঁর প্রিয় মদীনার জন্য অনেক দোয়া করেছেন । 
তিনি অামাদের মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (অা) এর দোয়াকে স্মরণ করে মদীনার জন্য, মদীনাবাসীর জন্য,মদীনার ফল-ফসলের জন্য  ইব্রাহীম (অা)  এর মত করেই দোয়া করলেন, 

 ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ফল-ফলাদিতে বরকত দাও। আমাদের এ মদীনায় বরকত দাও। আমাদের আহার্য্য, শস্য ও খাদ্য-দ্রব্যে বরকত দাও। হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই ইবরাহীম তোমার বান্দা, তোমার বন্ধু ও তোমার নবী। আর আমিও তোমার বান্দা ও তোমার নবী। তিনি মক্কা নগরীর বরকতের জন্য তোমার কাছে দো‘আ করেছিলেন। মক্কার জন্য যে পরিমাণ দো‘আ তিনি তোমার কাছে করেছিলেন, মদীনার জন্য সে পরিমাণ এবং তদনুরূপ আরেকগুণ বরকতের দো‘আ আমি তোমার কাছে করছি।’’ [সহীহ মুসলিম: ৩৪০০]

   অন্য বর্ণনায় এরকম দো‘আ এসেছে: ‘‘হে আল্লাহ! মক্কায় যতটুকু বরকত রয়েছে, মদীনায় তার দ্বিগুণ বরকত দাও।’’--সহীহ মুসলিম – ৩৩৯২

ঢ়খন দাজ্জালের ফেৎনা সারা দুনিয়ায়ছড়িয়ে পড়বে তখন পবিত্র মদীনায় দাজ্জাল ঢুকতে পারবেনা । তাঁকে প্রতিহত করা হবে । 
আল্লাহ তা’আলা মদীনার প্রবেশদ্বারসমূহে ফেরেশতাদের মধ্য থেকে প্রহরী নিযুক্ত করেছেন, যারা এতে মহামারী ও দাজ্জালের প্রবেশকে প্রতিহত করবেন।  
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘মদীনার পথে-প্রান্তরে রয়েছে (প্রহরী) ফেরেশতাগণ, (তাই) এখানে মহামারী ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।’’ সহীহ বুখারী – ১৮৮০, ৫৭৩১ ও সহীহ মুসলিম – ৩৩৩৭

    এখানে বলে রাখা দরকার যে,সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের মত মহামারী মদীনাকে কাবু করতে পারেনি । এবং যতটুকু এসেছিলো তা মহামারী অাকারে ছড়ায়নি । সারা দুনিয়ার মধ্যে এই মদীনাকে সর্বপ্রথম করোনামুক্ত ঘেষণা দিয়ে মসজিদে নববীকে সর্বসাধারণের জন্য খোলে দেওয়া হয়েছে । 

   মদীনায় বসবাসের আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে:মদীনায় বসবাসের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি এখানে বসবাসের ফলে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হলেও ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন এবং মদীনা ছেড়ে যেতে অনুৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন: ‘‘মানুষের কাছে এমন এক সময় আসবে, মদীনায় বসবাসরত ব্যক্তি তার চাচাত ভাই ও আত্মীয়কে বলবে চল স্বচ্ছলতার দিকে, চল স্বচ্ছলতার দিকে। অথচ মদীনাই তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা জানত। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, মদীনার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে যে ব্যক্তিই এখান থেকে বের হয়ে যায়, আল্লাহ তদস্থলে তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি স্থলাভিষিক্ত করে দেন। সাবধান, মদীনা (কামারের) হাঁপরের ন্যায় নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে বের করে দেবে। হাঁপর যেভাবে লোহার ময়লা বের করে দেয়, তেমনি, মদীনা ও তার মন্দ ব্যক্তিদের বের না করা পর্যন্ত ক্বিয়ামত হবেনা।’’ [সহীহ মুসলিম – ৩৪১৮]

    যে ব্যক্তি মদীনার কষ্টে ধৈর্যধারণ করে তথায় মৃত্যুবরণ করবে, ক্বিয়ামতের দিন আমি তার জন্য শাফায়াত করব অথবা তার পক্ষে সাক্ষ্য দেব, যদি সে মুসলিম হয়।’’ [সহীহ মুসলিম – ৩৪০৫]

2. মদীনার দু:খ-কষ্ট ও বালা-মুসিবতে ধৈর্যধারণের মর্যাদা:রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি মদীনার কষ্ট ও বালা-মুসিবতে ধৈর্যধারণ করবে, ক্বিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে সাক্ষ্য দেব কিংবা তার জন্য শাফায়াত করব।’’ [সহীহ মুসলিম – ৩৪০৫]

3. মদীনায় মৃত্যু হওয়ার মর্যাদা:রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি মদীনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম, সে যেন তা করে। কেননা যে তথায় মৃত্যুবরণ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াত করব।’’ [সহীহ সূত্রে ইমাম আহমাদ: ৫৮১৮]

4. মদীনা ঈমানের স্থান:মদীনা দারুল ঈমান বা ঈমানের গৃহ। তাইতো এখান থেকেই ঈমানের আলো সারা বিশ্বে বিচ্ছুরিত হয়েছিল। পরিশেষে মানুষ যখন ঈমান হতে বিচ্যুত হতে থাকবে, তখন ঈমান তার গৃহে তথা মদীনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “ঈমান মদীনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।’’ [সহীহ বুখারী – ১৮৭৬ ও মুসলিম – ৩৭২]

5.  মদীনায় ইলম শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়ার মর্যাদা:মদীনা ছিল প্রথম বিদ্যালয় যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের এমন এক প্রজন্মের তারবিয়াতের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ইতিহাসে যাদের আর কোন জুড়ি মেলে না। তাইতো এখান থেকে বের হয়েছে অসংখ্য সৎ ও বিজ্ঞ আলেম, যারা স্বীয় ইলম ও তারবিয়াতের মাধ্যমে জগতকে আলোকিত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘মানুষ হন্যে হয়ে ইলম অনুসন্ধান করবে, তবে মদীনার আলেমের চেয়ে অধিক বিজ্ঞ কোন আলেম তারা খুঁজে পাবে না।’’ [নাসায়ী: ৪২৭৭ ও হাকেম: ৩০৭ সহীহ সূত্রে]

   তিনি আরো বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে শুধু এই জন্যেই আসে যে, সে কোন কল্যাণের দীক্ষা নেবে কিংবা অন্যদের শিক্ষা দেবে, সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর সমতূল্য।’’ হাকিম: ৩০৯, বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী]

    মাসজিদে নববী হচ্ছে সেই তিন মাসজিদের একটি, যার উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত হতে সওয়াবের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘তিনটি মাসজিদ ছাড়া আর কোথাও (সাওয়াবের নিয়তে) সফর করা জায়েয নেই। এগুলো হল: (মক্কার) মাসজিদুল হারাম, আমার এই মাসজিদ এবং মাসজিদুল আকসা।’’ --সহীহ বুখারী ১১৮৯ ও সহীহ মুসলিম: ৩৪৫০

   মদীনায় অবস্থানকালীন সময়ে সকল মু'মীনের উচিৎ মসজিদে নববীতে জামায়াতের সাথে সালাত অাদায় করা । মহান অাল্লাহর কাছে নিজের জন্য পরিবার পরিজনের জন্য এবং প্রিয় জন্মভূমীর জন্য দোয়া করা । 
যদি কারো মদীনায় অবস্থানকালীন সময়ে মৃত্যু এসে যায় তাহলে সেটা সৌভাগ্যের বিষয় ।  কারণ রাসূল (স) মদীনায় মৃত্যুবরণকারীকে শাফায়াতের ওয়াদা করেছেন  । 

  আল্লাহ অামাদেরকে মদীনায় বারবার যাওয়া এবং শির্ক বিদায়াতমুক্ত অামলের মাধ্যমে তাঁর হাবীবের শাফায়াতের অধিকারী হওয়ার তাাওফিক দিন।
------------------------------------------------
লেখকঃ কলামিস্ট ওপ্রবন্ধ লেখক।        

Post a Comment

0 Comments