Recent Tube

পথে নামলেই পথিক হওয়া যায় না। -জিয়াউল হক।

   
   পথে নামলেই পথিক হওয়া যায় না -
    

    প্রবাস জীবন মানুষকে বদলে দেয়। কেবলমাত্র বাহ্যিক অবয়বই বদলায় না, বদলে দেয় তার ভেতরটাও। জীবন ও জগৎ, সমাজ ও সভ্যতা সন্মন্ধ্যে দৃষ্টিভংগীও বদলে দেয়। ব্যক্তির শক্তি ও সামর্থ বদলে দেয়। নিজের ব্যাপারেও ভাবতে শেখায়। নতুন এক সত্তা হিসেবে তার রুপান্তর ঘটায়। সবার বেলাতে না হলেও কারো কারো বেলাতে এমনটা ঘটে। ব্যক্তি একেবারে  নতুন এক রুপ ও পরিচিতিতে আবির্ভূত হন।

    ভ্রমণ মানুষ চেনায়। মানুষের যে কতো বাহারি রুপ আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। বিশ্বাস না হলে, জানা শোনা কোন প্রবাসীকে জিজ্ঞেস করুন। তাকে আশ্বস্থ করুন, গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিন, এর পরে সততার সাথে বলতে বলুন, দেখুন তিনি কি বলেন! 

     আপনি অবাক হবেন তার কথা শুনে। তার মনে একটা জগত রয়েছে, যে জগতে তিনি নিজের খুব কাছের লোকজনের  কারো কারো ব্যাপারে এমন বিষ্ময় লুকিয়ে রেখেছেন, এমন কষ্ট ও ক্ষোভ লুকিয়ে রেখেছেন যে, তা জানলে আপনি অবাক হবেন।
 
     তিনি আপনাকে জানাবেন তার জানা লোকগুলোকে আবার নতুন করে চেনার গল্প, জানার ইতিহাস। আপনাকে এমনসব কষ্টের কথা, অভিজ্ঞতার কথা জানাবেন যা শুনলে কষ্ট হবে, বিষ্ময়ে মুখ হা হবে। আপনার চোখ ভিজে আসবে, চোখে জ্বালাও ধরবে।

    এক বুক জ্বালা আর কষ্ট নিয়ে অনেক প্রবাসী জীবন পার করে দেন। অনেক কষ্ট আছে, যা বলার মতো কোন লোক এ পৃথিবীতে নেই। এতো নিকটজনের কাছ থেকে তারা কষ্ট পেয়েছেন যে, তার চেয়ে কোন নিকটজন হতে পারে না। ঐ কষ্টগুলো বলার মতো কোন নিকটজনই এ পৃথিবীতে থাকে না, তাই কাউকে বলাও হয় না।

   প্রবাস মানুষ চেনায়। কত প্রবাসীর কাছে বসে তাদের জীবনের গল্প শুনেছি নিজ কানে, কতো চাপা, অব্যক্ত কষ্ট দেখেছি নিজের চোখে যে, নিজেই অবাক হই। কোনদিনও মানুষের জীবনের এই বৈচিত্রময় দিকটিকে আগে বুঝতে পারিনি। তাদের সাথে না বসলে, তাদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে না শুনলে জানতেও পারতাম না।

     তবে এটাও ঠিক যে, যিনি যতো ভ্রমণ করেছেন, ততো বেশি মানুষ চিনেছেন, তাও কিন্তু নয়। কারণ, মানুষ চিনতে ও বুঝতে হলে অন্তর্চক্ষুকে অত্যন্ত শানিত করতে হয়। অনেকের মধ্যে বাস করেও সময়মতো অন্তর্মূখী হয়ে একাকী থাকার ভান করতে হয়, নিজের মতো পর্যবেক্ষণ করার জন্য একা হতে হয়ে!

    মানুষ এক অদ্ভূত জীব! সে জগতের মাঝে বাস করেও নিজের জন্য আলাদা একটা জগত তৈরি করে নিতে পারে। প্রয়োজনবোধ করলেই শামুকের মতো করে সেই জগতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজেই একচ্ছত্র অধিপতি, কারো কোন অধিকার নেই সে জগতে। 

    এই সময়টাতে তার মনের কোণে ঝড় বয়ে চলে। কখনও কখনও তা সুনামীর আকারও ধারণ করে। বর্ষার সময় পদ্মায় ইলিশের ডিম পাড়ার সময় হয়। শীতকালে সময় হয় সাইবেরিয়ার পাখিদের বাংলাদেশে আসার। এ সময় আনাচে কানাচে কত প্রজাতির পাখির দেখা মেলে! উপযুক্ত সময়ের সাথে সম্পৃক্ত এ ঘটনাগুলো।

   ঠিক তেমনি মনের কোণে লুকায়িত এই গোপন জগতেরও একটা সিজন রয়েছে, সেই সিজনে কতো চিন্তা, কতো আবেগ আর বিচিত্র অনুভুতি ভেঁসে উঠে মনে! সে সব চিন্তা আর ভাববেগের সাথেই রয়েছে ব্যক্তির আসল সত্তার সম্পর্ক। 

   এটাই তার আসল চিত্র, মনের প্রকৃত চিত্র, প্রকৃত ছবি। তার বাহিরের যে ছবি এ বিশ্ব দেখে, সেটা মেকি! সামাজিকতা, তথাকথিত ভদ্রতার মেকি শাসনে তা ঢাঁকা থাকে। প্রলেপের আবরণে মানুষ সব সময় নিজের সেই জগতটাকে গোপন করে রাখে।

  গোপন এই জগতের দ্বার সে সবার জন্য, সব সময় খুলে না, খুলতেও চায় না। কখনও কারো জন্য এই দ্বার সে খুললেও সবটুকু খুলে ধরে না, এ ক্ষেত্রে সে বড় স্বার্থপরই বটে।

   বিগত প্রায় তিন যুগে কত দেশে কত প্রবাসীর সাথে মিশেছি! যখন যেখানেই প্রথমবার গিয়েছি সে জনপদই ছিল আমার জন্য ‘নতুন’, ‘অজানা আর অচেনা’। অথচ কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অনেকেই হয়ে গেছেন ‘পরিচিত’। কেউ কেউ তো  ‘বন্ধু’ও হয়েছেন।

  নতুন জায়গায় যাবার আগে সেই জায়গা ও জনপদ, পরিবেশ, লোকজন, নিয়ম নীতি নিয়ে একধরনের শংকা, উৎকন্ঠা আর অনিশ্চয়তা থাকে।  একসময় সেসব কেটে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। সবার ক্ষেত্রেই এটা ঘটে। কারণ ব্যক্তি অনিশ্চিত ও অজানা পরিবেশে নিজেকে টেনে এনে তার সাথে মিশে যায়, নিজেই সেই অজানা পরিবেশের ‘উপাদান’ হয়ে উঠে নিজেরই অজান্তে। গড়ে উঠে পরিচিতি, জানাশোনা।

  এই জানা শোনা, এই চেনা জানাটাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর, দূর্লভ অভিজ্ঞতা। ভ্রমণে আর কিছু জুটুক বা না জুটুক, এই অভিজ্ঞতাটা কিন্তু ঠিকই জুটে যায়। 

মানুষ জানতে বা চিনতে পারার যে অভিজ্ঞতা, তা দারুণ রোমঞ্চকর। এর মধ্যে এক ধরনের বর্ণনাতীত সুখানুভূতীও রয়েছে। আবার রয়েছে ঝুঁকিও। 

   ঝুঁকিটা পরের কষ্ট জেনে নিজের মনে কষ্টের একটা আবহ তৈরি হয়ে যাবার। কখনও কখনও এমন সব কষ্টের কথা শুনবেন, সারা জীবনেও তা ভুলতে পারবেন না, মনের কোণে খচখচ করে মাঝে মধ্যেই আপনাকে কষ্ট দেবে। 
   তারপরেও বলি, মানুষকে জানার মধ্যে রয়েছে এক বর্ণনাতীত সুখ। উনবিংশ শতাব্দির আমেরিকান এক পাদ্রি ও বক্তা William Ellery Channing ঠিক এ কথাটাই বলেছিলেন একটু ভিন্নভাবে ;
 Every man is a volume, if you know how to read him
(প্রতিটি মানুষই একটা ভলিউম বই, একটা সূখপাঠ্য উপন্যাস, যদি তাকে তুমি পড়তে পারো।)

    ঐ যে একটু আগে বলেছিলাম; পথে নামলেই পথিক হওয়া যায় না  ভ্রমণ করলেই পরিব্রাজক হয় না, সফর করলেই সে মুসাফির হয় না। যেসব পথিক, যে সব মুসাফির বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা  মানুষরুপী এইসব ভলিউমগুলোকে পড়তে পারেন, তারাই হয়ে উঠেন ইবনে খালদুন। আর তা না হলে রয়ে যান ভবঘুরে, বাউন্ডুলে এক পথচারী মাত্র! (প্রকাশিতব্য গ্রন্থ 'ধরণীর পথে পথে-২' থেকে সংক্ষিপ্তকৃত)
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments