Recent Tube

বুকের উপর হাত বাধার সকল হাদীস দুর্বল (পর্ব ১): , মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

বুকের উপর হাত বাধার সকল হাদীস দুর্বল,
 -পর্ব ১,

হাদীস নং ১:
হযরত ওয়াইল রা. বলেছেন,

صليت مع رسول الله صلى الله عليه و سلم ووضع يده اليمنى على يده اليسرى على صدره

   আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়লাম। তিনি তার ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন।(সহীহ ইবনে খুযাইমা হা.নং ৪৭৯)

   তাহকীক:হাদীসের সনদে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল আছেন,তিনি জুমহুরে মুহাদ্দিসের মতে তিনি অত্যাধিক ভুলকারী।

   মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলের উপর যে সকল মুহাদ্দিস জারাহ করেছেন,

১.আবূ হাতেম রাযী রহ বলেছেন, তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ, তবে প্রচুর ভুল করতেন, তার হাদীস লিপিবদ্ধ করা যায়। (আল জারহু ওয়াত তাদীল, ৮/৩৭৪)

২.ইবনে সা’দ রহ বলেছেন, তিনি বিশ্বস্ত, তবে অনেক ভুল করতেন।(আত তাবাকাতুল কুবরা খ.৫,পৃ.৫০১)

৩.মুহাম্মদ ইবনে নসর আল মারওয়াযী রহ বলেছেন, তিনি কোন বর্ণনার ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ হলে ভেবে চিন্তে দেখতে হবে, কেননা তিনি প্রচুর ভুলের শিকার ছিলেন।(তা'যীম কদর আস সালাত খ.২,পৃ.৫৭২,বর্ণনা নং ৬১৪)

৪.ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান আল ফাসাবী রহ বলেন,তার বর্ণিত হাদীসসমূহ তার সঙ্গী-সাথীদের বর্ণিত হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হত না।(আল মারিফা ওয়াত তারীখ, ৩/৫২)

৫.সুলায়মান ইবনে হারব বলেছেন,আলেমগণের উচিৎ, তার হাদীস গ্রহণ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা ও কম করে বর্ণনা করা। কারণ তিনি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনা করতেন আমাদের বিশ্বস্ত উস্তাদগণ থেকে। এটা খুবই অন্যায়। কারণ এসব আপত্তিকর বর্ণনা যদি দুর্বলদের থেকে হতো তবে আমরা তাকে মাযুর বিবেচনা করতাম। (আল মারিফা ওয়াত তারীখ, ৩/৫২)

৬.আল্লমা খতিবে বাগদাদী রহ বলেন,তিনি প্রচুর ভুল করতেন। (তারিখে বাগদাদ ৬)

৭.যাকারিয়া আস সাজী রহ বলেছেন,তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ, তবে প্রচুর ভুলের শিকার, সেগুলোর পরিমাণ এত বেশী যে,উল্লেখ করলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। (তাহযীবুত তাহযীব খ.১০,পৃ.৩৮১)

৮.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ বলেন, মুয়াম্মাল হাদীস বর্ণনায় ভুল করতেন। (মাওসুয়াতুল আকওয়ালি ইমাম আহমাদ খ.৩, পৃ.৪১৯)

  এছাড়া আল মারওয়াযী বলেন,আমি আবু আব্দুল্লাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়াহিয়া বিন ইয়ামান এবং মুয়াম্মাল বিন ইসমাঈল হাদীস বর্ণনায় মতবিরোধ করলে?(কাকে প্রাধান্য দিতে হবে) তিনি বললেন,বর্জন কর।তারপর তিনি বললেন,মুয়াম্মাল হাদীস বর্ণনায় ভুল করত। (সুয়ালাত আল মারওয়াযী ৫৩)

   এর থেকে বোঝা গেল,ইমাম আহমদের মতে মুয়াম্মাল ইয়াহিয়া ইবনে ইয়ামান অপেক্ষা দুর্বল।অথচ ইয়াহিয়া ইবনে ইয়ামান স্বয়ং ইমাম আহমদ রহ এর নিকট দুর্বল।(দেখুন,তারীখে বাগদাদ খ.১৪,পৃ.১২৩,মাউসু'আহ আকওয়াল ইমাম আহমদ খ.৪,পৃ.১৪২-১৪৩)

৯.ইমাম দারাকুতনী রহ বলেছেন,তিনি বিশ্বস্ত তবে অত্যধিক ভুলের শিকার।(সুয়ালাতুল হাকেম রাবী নং ৪৯২)

১০.ইমাম নাসাঈ রহ বলেন,মুয়াম্মাল হাদীস বর্ণনায় প্রচুর ভুল করতেন।(সুনানে কুবরা বর্ণনা নং ২৮৩৮,৯৮৩৩)

১১.ইবনে হিব্বান রহ বলেন,সিকাহ কিন্তু ভুল করতেন।(কিতাবুছ ছিকাত খ.৯,পৃ.১৮৭)

১২.ইবনে হাজার আসকালানী রহ বলেন, সত্যবাদী কিন্তু খারাপ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। ( তাকরীব,রাবী নং ৭০২৯)

১৩.ইমাম ইবনুত তুরকুমানী রহ তার সমালোচনা করেছেন।(জাওহারুন নাকী খ.২,পৃ.৩০)

১৪.ইমাম হায়ছামী রহ বলেন,সিকাহ কিন্তু প্রচুর ভুল করেন।(মাজমাউজ যাওয়াযেদ খ.১,পৃ.৮০)

১৫.ইমাম যাহাবী রহ বলেন,তিনি প্রচুর ভুল করতেন।(আল কাশিফ রাবী নং ৫৭৪৭)

মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলের ভুলের একটি নমুনা:

ইমাম তিরমিযি রহ  উক্ত হাদীস বর্ণনা করে
((((((মাহমুদ ইবন গায়লান (রহঃ) ...... আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ‘ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম' বলাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর।)))))) লিখেন,

  হাদীসটি গারীব। হাদীসটি সঠিক ভাবে রক্ষিত নয়। এটি হাম্মাদ ইবন সালামা-হুমায়দ-হাসান বসরী (রহঃ) সূত্রেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে। এটিই অধিক সহীহ।এর সনদে মুআম্মাল (রহঃ) ভুল করেছেন যে এতে ‘হুমায়দ-আনাস (রাঃ) কথাটি উল্লেখ করেছেন। এতে তাঁরা কোন সমর্থক নেই। (হা. নং ৩৫২৫ এর আলোচনা)

ইমাম তিরমিযি রহ এর উক্ত মন্তব্য থেকে এটা প্রমানিত যে,
মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল যখন এককভাবে হাদীস বর্ণনা করেন তখন ভুল করেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে তিনটি বিষয় প্রমাণিত,

১.মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল রহ সত্যবাদী।
২.কিন্তু তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল তাই তিনি হাদীস বর্ণনায় প্রচুর ভুল করতেন।

  আর এই ধরনের রাবীদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হলো,তাদের একক বর্ণনাকে দলিল হিসেবে গ্রহন করা যাবে না।

  শাইখ যুবাইর আলী যাই রহ বলেন,যে সকল রাবী কাসীরুল ওয়াহাম,কাসীরুল খাতা(অত্যাধিক ভুলকারী),সা'ই উল হিফয (দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী) তাদের মুনাফারিদ (একক) বর্ণনা দুর্বল। (নুরুল আইনাইন পৃ.৬৩)

   আর মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল রহ কে আবু হাতিম রাযি,ইবনে সাদ,আস সাজি,দারাকুতনী রহ কাসিরুল খাতা এবং ইবনে হাজার আসকালানী রহ সা'ই উল হিফয বলেছেন। সুতরাং যুবাইর আলী যাই রহ এর মূলনীতি মোতাবেক মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল রহ এর মুনফারিদ(একক) বর্ণনা দুর্বল।

৩.সুফিয়ান সাওরী রহ হতে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলের বর্ণনা দুর্বল।কারন

১.ইবনে মাঈন রহ বলেছেন, সুফিয়ানের ক্ষেত্রে তিনি প্রমাণযোগ্য হওয়ার উপযুক্ত নন। (তারীখে ইবনে মুহরিয, ১/১১৪)

২.ইমাম দারাকুতনী রহ তার ইলালে দারাকুতনী বইয়ে মুয়াম্মাল বর্ণিত যে সকল হাদীসকে তার ভুল বলেছেন,তাদের তালিকা: (2/142),(2/244), (4/380), (5/252), (6/275), (7/17-18), (7/242), *(7/249) , *(8/22), *(9/201-202), *(9/273) ,*(9/314), *(11/151) , (11/186), *(11/317) 
* চিহ্নিত বর্ণনাগুলো মুয়াম্মাল সুফিয়া সাওরী রহ হতে বর্ণনা করেছেন।

৩.ইমাম ইবনে আবী হাতেম রহ তার ইলালে ইবনে আবী হাতেম বইয়ে মুয়াম্মাল বর্ণিত যে সকল হাদীসকে তার ভুল বলেছেন তার তালিকা:
(289), (578), (1754), (2008), (2069), (923), (1116), (1570), (2003), (2164), (2660)
প্রতিটি বর্ণনায় মুয়াম্মাল সুফিয়ান সাওরী রহ থেকে বর্ণনা করেছেন।

৪.ইমাম বাযযার রহ তার মুসানাদে বাযযার বইয়ে মুয়াম্মাল বর্ণিত যে সকল হাদীসকে তার ভুল বলেছেন তার তালিকা:
(1476), (2395), (4363), (8653)
প্রতিটি বর্ণনায় মুয়াম্মাল সুফিয়ান সাওরী রহ থেকে বর্ণনা করেছেন।

৫.হাফিয ইবনে আবিল ফাওয়ারিস রহ সুফিয়ান সাওরী রহ হতে মুয়াম্মালের বর্ণিত একটি হাদীসকে ভুল বলেছেন।(ইরওয়ালুল গালীল খ. ৬,পৃ.২৪০)

৬.ইমাম বাইহাকী রহ ও সুফিয়ান সাওরী রহ হতে মুয়াম্মালের বর্ণিত কয়েকটি হাদীসকে ভুল বলেছেন [শোয়াবুল ইমান হা. নং 572,আস সুনান আস সাগীর (3/20),আল কুবরা (4/213), (4/240)]

৭.ইমাম তাবরানি রহ ও সুফিয়ান সাওরী রহ হতে মুয়াম্মালের বর্ণিত কয়েকটি হাদীসকে ভুল বলেছেন (আল আওসাত হা.নং ১৫১২,আস সাগীর হা. নং ৭৭৭)

ইমামদের এই সকল বর্ণনাকে সামনে রেখে হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী রহ বলেন,
একইভাবে (সুফিয়ান) ছাওরী হতে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলের বর্ণনায় দুর্বলতা আছে। (ফাতহুল বারী খ.৯, পৃ.২৮৮,৫১৭২ হাদীসের অধীনে)

সুতরাং বুকের উপর হাত বাধার উপরোক্ত হাদীসটি দুইটি কারণে দুর্বল।

১.উপরোক্ত বর্ণনাটি মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল রহ এর একক বর্ণনা।কারন সুফিয়ান সাওরী রহ থেকে 

ক.মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ ফিরয়াবী (আলমুজামুল কাবীর তাবারানী ২২/৩৩) ও 
খ.আব্দুল্লাহ ইবনুল ওয়ালিদ (মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮; নাসাঈ, হাদীস নং ৮৮৯) (দুজনই বিশ্বস্ত রাবী) 

দুইজন হাদীস বর্ণনা করেছেন কিন্তু তাদের বর্ণনায় ‘বুকের উপর’ কথাটি নেই।

হাফেয ইবনুল কায়্যুম রহ বলেছেন,মুয়াম্মাল ছাড়া আর কেউ "বুকের উপর" উল্লেখ করেন নি।(বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ: ৩/৯১)

ইমাম বায়হাকী রহ বলেন,এক দল হাদীস বর্ণনাকারী হাদীসটি সুফিয়ান সাওরী রহ বর্ণনা করেছেন কিন্তু মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল ছাড়া কেউ বুকের উপর বর্ণনা করেন নি।(আল খিলাফিয়্যাত খ.২,পৃ. ৩৮, হস্তলিখিত পান্ডুলিপি,সুলাইমানি লাইব্রেরী,ইস্তাম্বুল)

২.উপরোক্ত বর্ণনাটি মুয়াম্মাল সুফিয়ান থেকে বর্ণনা করেছেন।আর সুফিয়ান থেকে মুয়াম্মালের বর্ণনা দুর্বলা।
সুতরাং বুকের উপর হাত বাধার এই হাদীসটি দুর্বল।

যে সকল সালাফী ও আহলে হাদীস আলেম এই হাদীসকে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলের কারনে দুর্বল বলেছেন তাদের তালিকা:

১.শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানী রহ (সহীহ ইবনে খুযাইমা হা. নং ৪৭৯ এর টিকা,সনদকে দুর্বল বলেছেন তবে অন্যান্য বর্ণনার ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন।)
২.ইরাকের বিখ্যাত সালাফি আলেম ড.মাহের আল ফাহাল (সহীহ ইবনে খুযাইমা হা. নং ৪৭৯ এর টিকা)
৩.ইয়ামানের সালাফি আলেম মুকবিল ইবনে হাদী (রিয়ায আল জান্নাহ পৃ. ১১৪)
৪.সৌদি সালাফি আলেম ড.আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল আযীয আল জিবরীন (শরাহ উমদাতুল ফিকহ,পৃ.২৭২)
৫.সৌদি সালাফি আলেম খালেদ আল শায়া (আল ই'লাম বি তাকবীর আল মুসাল্লি বি মাকান ওয়াদ'ইল ইয়াদাইনন বা'আদ তাকবীরাতুল ইহরাম পৃ,২৩-২৯) 
৬.সৌদি সালাফি আলেম আব্দুল আযিয  আল তারিফি (সিফাতুস সালাতিল নবী 
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃ.৮৭-৮৮)
৭.উপমহাদেশের বিখ্যাত আহলে হাদীস আলেম শফীউর রহমান মুবারকপুরী রহ (আবকার আল মিনান পৃ.৩৫৯)
 ------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।         

Post a Comment

0 Comments