Recent Tube

নিরাশ কেন? আপনিই তো ইতিহাস গড়বেন - জিয়াউল হক।


নিরাশ কেন? আপনিই তো ইতিহাস গড়বেন -

    ঘটনাকাল ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের পর, পুরো দিল্লিজুড়ে তখন অচলাবস্থা, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। কে যে কার বন্ধু আর কে যে দুশমন, সেটা বোঝা মুশকিল। ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে বাংলা দখলের মাধ্যমে ভারত দখল শুরু। মোটামুটি একটি শতক ধরে শত চড়াই উৎরাই সয়েও ইংরেজরা ঠিকই এক এক করে পুরো ভারতকে, পাকিস্থান থেকে বার্মা, শ্রীলংকা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত দখল করে নেয়। ভারতের সম্পদ চুষে এনে গড়ে তুলতে থাকে কাদা মাটির স্যাঁত স্যাঁতে ইংল্যন্ডকে।

     যা হোক, ভারতের ইংরেজরা সবচেয়ে কড়া প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় পলাশির যুদ্ধের ঠিক একশত বৎসর পরে এসে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে, সিপাহী বিদ্রোহের সময়। বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পরে ভারতে ইংরেজ সরকার পাগলা কুকুরের মত হুঁস জ্ঞান হারিয়ে চরম দমন পীড়ন শুরু করে। হাজার হাজার মানুষকে বিদ্রোহে অংশ নেওয়া বা সহায়তা করার অভিযোগে হত্যা করে।

      ঠিক এরকম এক সময়ে অনেকের মতই পুলিশ কনস্টেবল গঙ্গাধর তার স্ত্রী ইন্দ্রাণী ও দুই সন্তানসহ দিল্লি থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন নৌকা যোগে। যমুনা নদীর আশে পাশে ইংরেজ সৈনিকরা নিয়মিত টহল দিচ্ছিল রাতের বেলাতেও। তারা নৌকা থামিয়ে ধরলো গঙ্গাধর ও তার পরিবারকে। ইংরেজ সৈনিকদের চোখ আটকে গেলে চার বৎসরের ফুট ফুটে এক শিশু কন্যার উপরে।

     দিল্লিতে বিদ্রোহী সিপাহীরা অনেক ইংরেজ সৈন্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। অনেক ইংরেজ নারী, পুরুষ, শিশু নিখোঁজও ছিল। গভীর রাতে যমুনার বুকে এই ডিঙ্গি নৌকায় চারজন ভারতীয় যাত্রীর মধ্যে এক ফুটফুটে শিশু কন্যাকে দেখে তারা ধরেই নিল, এই শিশুটা কোনো ইংরেজের। তারা জেরা করতে শুরু করলে গঙ্গাধর দাবী করলেন, শিশুটি তার নিজের কন্যা শিশু।
                              লেখক 
         ইংরেজদের কোনমতেই তা বিশ্বাস হচ্ছিল না, ফলে তারা প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জেরা করতে শুরু করলো। তার জবানবন্দী নেয়া হলো, স্ত্রী ইন্দ্রানীর জবানবন্দীও নেয়া হলো, সে সাথে তার আট বৎসরের ছেলে আর এই চার বৎসরের শিশুকন্যাটিরও জবাবন্দী নিয়ে সৈন্যরা নিশ্চিত হলো যে, আসলেই শিশুটি গঙ্গাধরেরই সন্তান। তারা ছেড়ে দিল পরিবারটিকে।

            এই ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বৎসর পরে এই পরিবারে আরও এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয়, গঙ্গাধর নাম রাখেন মতিলাল। হ্যাঁ মতিলাল নেহেরুর কথা বলছি। এই মতিলাল নেহেরুর সন্তানই হলো জওহারলাল নেহেরু, যার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনে ভারত হাতছাড়া হয়েছে ইংরেজদের। যে পরিবার একদিন কোনোমতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল সেই পরিবারই সময়ের ব্যবধানে ইতিহাস গড়লো!

     উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে পরিচালিত আব্বাসীয়দের সফল বিদ্রোহ থেকে বাঁচতে কোনভাবে কেবলমাত্র নিজের প্রাণটুকু নিয়ে স্বস্ত্রীক পালালেন আব্দুর রহমান (আব্দুর রহমান ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান), সেই ৭৫১ সালে।

    পথিমধ্যে তার ভাই ইয়াহহিয়া ধরা পড়ে নিজের মস্তক হারালেও তিনি অনেক কষ্ট সয়ে, মিশর, তিউনিশিয়া, মরক্কো এবং সবশেষে সাগর পেরিয়ে পৌছুলেন আন্দালুস; আজকের স্পেনে। সেটা সেই ৭৫৫ সালের ঘটনা। এর চল্লিশ বৎসর আগে তারেক বিন জিয়াদের মাধ্যমে স্পেনে মুসলিম শাসন চালু হলেও মুসলমানরা তখনও আরব ও অনারব আফ্রিকীয়দের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দে জড়িয়ে রয়েছে, তেমনি স্থানীয় খৃষ্টানরাও তখনও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল।

     একদিকে উবাইদুল্লাহ ইবনে উসমান, আব্দুল্লাহ ইবনে খালিদ ও অপরদিকে আমির ইউসুফ আল ফিহরী, এই তিনপক্ষের যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত মুসলিম স্পেন যখন টলটলায়মান, ঠিক তখনই উমাইয়া শাসনের প্রতি পূর্ব থেকেই সহানুভূতিশীল সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ইবনে উসমান মরক্কোতে অবস্থানরত আব্দুর রহমানের কাছে সাহায্য চেয়ে দূত পাঠান।

      আব্দুর রহমানও এমন একটা মোক্ষম সময়ের জন্যই অপেক্ষমান ছিলেন। তিনি কাল বিলম্ব না করেই মাত্র ৩০০ সৈন্য নিয়ে মালাগার পূর্বপ্রান্তে নামলেন ৭৫৫ খৃষ্টাব্দে।

     সেই শুরু, তারেক বিন জিয়াদ যে মিশনের শুরু করেছিলেন, তারই সমাপ্তি টানতে, স্পেনের এই বিশাল ভূখন্ডে ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে সুসংহত করতে নেমে পড়লেন আব্দুর রহমান। ৭৭৯ সালের মধ্যে তিনি স্পেনের অবিসংবাদিত আমীর! এই তিনিই মাত্র কিছুদিন আগে কোনমতে প্রাণটা হাতে করে পালিয়ে বেঁচেছেন!

       সেই একই অবস্থা হয়েছিল আর এক আব্দুর রহমানের বেলাতেও। তিনি সারাটা জীবন তিউনিসিয়া থেকে মিশর, মিশর থেকে গ্রানাডা কিংবা মরক্কোর ফেজ নগরীতে প্রাণ হাতে করে ছুটে বেড়িয়েছেন। কখনও বা মরুভূমিতে ভক্ত বেদূঈন আরবের তাঁবুতে বৎসরের পর বৎসর কাটিয়েছেন। অখন্ড অবসরে বসে বসে লিখেছেন আল মুকাদ্দিমা। তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি আর পান্ডিত্যের কারণে আব্দুর রহমান আল হাদারামি থেকে হয়ে উঠেছেন 'ইবনে খালদুন'! ইতিহাসের বরপুত্র।

      আরও একজনের কথা বলতে পারি, যেদিন তিনি পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, সেই দিনই তাকে প্রাণভয়ে পালাতে হয়েছিল নিজ অসুস্থ জননীর কোলে চড়ে, পাড়ী দিতে হয়েছিল দীর্ঘ পাহাড়ী পথ, দূর্গম মরু! অথচ এই শিশু সন্তানই এক সময় পরবর্তিতে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বীর, কিংবদন্তী গাজী সালাহউদ্দীন।

      খুঁজলে এরকম শত শত ইতিহাস রয়েছে শত শত মানুষের জীবনে।
প্রায় প্রতিটি সমাজেই। যারা ইসলামের ইতিহাস জানেন, তারা জানেন, প্রিয় রাসুল সা: কেও রাতের আঁধারে মক্কা থেকে এক বস্ত্রে পালিয়ে আসতে হয়েছিল মদিনার উদ্দেশ্যে, আল্লাহর আর এক নবী হযরত মুসা আ: কেও প্রাণ নিয়ে পালাতে হয়েছিল। এই দুই মহামনাব ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনিত নবী ও রাসুল। এঁদের কথা আলাদা। কিন্তু এর আগে যাদের কথা বললাম তারা ছিলেন অতি সাধারণ লোক। পালিয়ে বাঁচা এই সব ব্যক্তিবর্গরাই একদিন ইতিহাস গড়েছেন। 

    আজ যারা জীবনের বিভিন্ন বাঁকে মৃত্যু কিংবা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও কোনমতে বেঁচে ফিরেছেন, তারা এ কথাটা মনে রাখবেন, আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে আল্লাহর এক বিরাট উদ্দেশ্য রয়েছে, ইচ্ছা এবং চেস্টা করলে আপনিও ইতিহাস গড়তে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ।

    অতএব নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। লক্ষ্য স্থির করুন, লক্ষ্যে লেগে থাকুন। বিশ্বাস করুন, ইতিহাস গড়ে উঠবে আপনার হাত ধরেই! প্রয়োজন শুধু ধৈর্য, শ্রম আর একাগ্রতার !
-------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও বিশ্লেষক।      

Post a Comment

0 Comments