Recent Tube

বঙ্গবন্ধু মুজিব হত্যা এবং ভারতের অন্তরালের ভূমিকা ; ইবনে যুবাইর।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যা এবং ভারতের অন্তরালের ভূমিকা,

বন্ধু!
 লেখাটি বেশ বড়। যদি সময় থাকে,তবে পড়িও এবং এদেশে ভারতের মুখপাত্র যারা আছে তাদের মুখের উপর ছুঁড়ে মারিও। ছুঁড়ে মারিও আওয়ামী লীগের মুখের উপরেও।

  ভারতের সাথে শুরু থেকেই শেখ সাহেবের সম্পর্ক আস্থার সংকট দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। 
যেমন : -
১. তাজউদ্দীন আহমদদের সাথে শেখ সাহেব ভারতে না গিয়ে ভারতের কাছে প্রথমে বিশ্বাসভঙ্গকারী হিসেবে গণ্য হন।

২. পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার সময় পাকিস্তানের সাথে শিথিল কনফেডারেশনের ভুট্টো প্যাকেজের প্রতি নমনীয়তা দেখিয়ে দ্বিতীয়বার ভারতের চোখে বিপজ্জনক ও আনপ্রেডিকটিবল বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হন। 

৩. পাকিস্তান থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকায় না এসে ভারতীয় বিমানের অফার নাকচ করে বৃটিশ এয়ার ব্যবহার করায় দিল্লী ক্ষুব্ধ হয়।

৪. লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নয়াদিল্লীতে যাত্রাবিরতি ছিল শেখ সাহেবের ইচ্ছার প্রতিকূল অনুরোধে ঢেঁকি গেলা। এটা ভারতের নেতৃত্বের ইগো-কে আহত করেছে। দিল্লীতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় ফিরতে ভারতীয় বিমান অফার করলে, তা-ও শেখ সাহেব নিতে অস্বীকার করেন।

৫. ঢাকায় ফিরে শেখ সাহেব বাংলাদেশকে 
‘‘দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ’’ হিসেবে পরিচিতি দেয়ায় ভারতের সেক্যুলার আদর্শকে অবমাননা করা হয়। ভারত বাংলাদেশকে যখন স্বীকৃতি দেয়, তখন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ তাদের রাষ্ট্রীয় পলিসিতে দেশ চালাতে অঙ্গীকার করেছে বলে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের পার্লামেন্টকে অবহিত করেন। 
শেখ সাহেবের এই ঘোষণা ছিল ভারতের সাথে তাজ উদ্দিন সরকারের সাথে তাদের বিশ্বাসের সেতু ভাঙ্গার সমতূল্য।

৬. ভারতের সাথে অবমাননাকর ৭ দফা চুক্তি সম্পাদনের জন্য শেখ সাহেবের তাজ উদ্দিনকে ভৎর্সনা করা, তাঁকে উপেক্ষা করা এবং শেষ পর্যন্ত ‘ভারতপন্থী' অপবাদের আবর্তে ঠেলে দিয়ে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া দিল্লীকে ক্ষুব্ধ করে।

৭. বাংলাদেশে পাকিস্তানী নেতা জেড.এ ভুট্টোকে লালগালিচা সংবর্ধনা এবং শেখ সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সুযোগে ঐ সময় থেকেই ঢাকা বিমানবন্দরে ভারত বিরোধী স্লোগান দান, ভারতীয় কূটনীতিকদের বহনকারী গাড়ির ওপর ঘৃণাসূচক জুতো, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ এবং এর পাশাপাশি ভুট্টোকে বহনকারী গাড়িকে ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে ঢাকায় বরণ ছিল দিল্লীর জন্য চরম অবমাননা ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার এক বিস্বাদ। 

৮. এরপর ভারতের প্রত্যক্ষ ও কঠোর বারণ উপেক্ষা করে শেখ সাহেবের লাহোরে ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় যোগদান ছিল ভারতের জন্য বাংলাদেশকে হারানোর আর একটি নাটকীয় মুহূর্ত। ভারত মনে করতে থাকে, বাংলাদেশের ওপর তারা তিন দশক ধরে যে বিনিয়োগ করেছে এবং যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিয়ে তারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সম্ভব করে তুলেছে বলে মনে করে, সেই দেশের নেতা ভারতের সমান্তরালে মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক গড়ার নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলায় এবং ভারতীয় কূটনীতিকরা মুজিব সরকারের সাড়ে তিন বছরের বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে পাকিস্তান আমলের চেয়েও ‘তিক্ত ও বৈরী' বলে মন্তব্য করেছেন। [জেএন দীক্ষিতের লিবারেশন এন্ড বিয়ন্ড : ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশন্স' দ্রষ্টব্য] সত্য বটে, ভারতের তদানীন্তন ‘র' প্রধান আর.এন কাও একজন ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে ঢাকা সফর করেন এবং ‘বঙ্গবীর' কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে শেখ সাহেবের সাথে দেখা করে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের দিক থেকে তাঁকে উৎখাতসহ তাঁর ক্ষতিসাধনে তৎপরতার কথা জানিয়ে তাঁকে সতর্ক থাকতে বলেন। 

  তবে শেখ সাহেব এ ব্যাপারে ‘র' প্রধানের এডভাইস নাকচ করে বলে দেন, বাঙালিরা তাঁকে হত্যা করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। [এ ব্যাপারে অশোক রায়না লিখিত ‘ইনসাইড ‘র' বই দ্রষ্টব্য]। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালো রাতের আগেও ভারতের ‘র' অপারেটিভদের পরামর্শ-প্রস্তাব নাকচ করে শেখ সাহেব তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে অবস্থান করেন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে গ্রেফতার বরণের পূর্ব পর্যন্ত। সাধারণের প্রশ্ন হচ্ছে, ‘র' তাদের আউট অব কন্ট্রোলে যাওয়া একজন বিপজ্জনক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানকে রক্ষা করে বাংলাদেশকে আর একটি পাকিস্তান হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ কেন দিবে? 

   ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র'-এর সাফল্যের মুকুটে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তথা ‘পাকিস্তান ভাঙা' হচ্ছে অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই বাংলাদেশের সংহত ও বিকশিত হওয়ার অর্থ বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখা তাদের জন্য আরও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠা। এ কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে ভারত কোন সেনাবাহিনী চায়নি। পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া বিপুল অস্ত্র এজন্যই তারা লুট করে নিয়ে যায়। এমনকি শেখ সাহেব এসব অস্ত্র ফেরত চাওয়ার পরও ভারত তা ফিরিয়ে দেয়নি।

    ১৯৭৫-এর আগস্টের মহাবিপদকালে ভারত শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার বা তাঁর ক্ষমতাসীন সরকারকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। মুজিব শাসনের অবসানকে ভারত সরকারিভাবে বাংলাদেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়' উল্লেখ করে সরকারি ভাষ্য প্রদান করে। দ্বিতীয়ত: আগস্ট পটপরিবর্তন-উত্তর মোশতাক সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে নয়াদিল্লী স্বীকৃতি দেয়। ভারত স্বীকৃতি না দিলে মোশতাক সরকার ৮৩ দিন টিকতো না বলে অনেকে মনে করেন। 

      তৃতীয়ত: তদানীন্তন ভারতের হাইকমিশনার সমর সেন ঢাকায় প্রকাশ্যে খন্দকার মোশতাকের সাথে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় করমর্দন করে ভারত সরকারের সন্তোষ ও স্বস্তি প্রকাশ করেন। 

       চতুর্থত: সপরিবারে মুজিব হত্যার জন্য ভারত সরকারিভাবে কোন শোক প্রকাশ করেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়ার মতো আওয়ামী লীগের চতুর্থ গ্রেডের নেতার মৃত্যুতেও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করে শোকবার্তা হস্তান্তর করেছে। অর্ধযুগ ধরে ভারতে অবস্থানকালে শেখ হাসিনার কাছেও ভারত এ নিয়ে কোন শোকবার্তা হস্তান্তর করেছে বলেও জানা যায়নি। 

     উপরন্তু ভারতের খ্যাতিমান সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী অন্নদাশংকর রায়সহ যেসব ভারতীয় নাগরিক মুজিব হত্যার ওপর শোক প্রকাশধর্মী লেখা লিখেছেন, তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সরাসরি হস্তক্ষেপে ভারতের কোন মিডিয়া তা প্রকাশ করেনি। 

     দিল্লী সরকার বলেছে, মুজিব পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে, এমন কিছুই তারা প্রকাশ করতে দেবেন না। ‘মুজিবের খুনি,' সরকারের সাথে আওয়ামী লীগ বান্ধব মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের গোপন সম্পর্কটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করা যাবে? 

    পঞ্চমত: ভারতের স্বাধীনতা দিবস- ১৫ আগস্টকে অভ্যুত্থানের দিন-তারিখ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এরইবা তাৎপর্য কী? ভারত তার স্বাধীনতা দিবস পালনের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত, ভারতীয় সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার অজুহাতে শেখ মুজিবকে রক্ষায় তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেনি, এমন একটা ধারণা দান করাই কী ঘটনার জন্য ১৫ আগস্টকে বেছে নেয়া?

      এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, অভ্যুত্থানকারীদের ভারতের ফোর্ট উইলিয়ামকে ইস্টার্ন সেনা কমান্ডের কলকাতাস্থ সদর দফতর জড়িয়ে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ কথা-বার্তায়। এ ব্যাপারে দু'টি সূত্রের উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। প্রশ্ন, মুজিব হত্যার দৃশ্যমান খুনিদের ফাঁসি দিয়ে ভারতের ভূমিকা চাপা দেয়া হয়েছে? আগস্ট অভ্যুত্থানকারী ‘মেজরদের' বিরুদ্ধে তদানীন্তন সেনাবাহিনীর ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল কাউন্টার ক্যু'র প্রস্তুতি নিলে অভ্যুত্থানকারীরা তাকে সতর্ক করে দিয়ে জানায় যে, কোনরকম ‘মুভ' করার চেষ্টা করেও কোন লাভ হবে না। 

     কেননা অভ্যুত্থানকারীরা ফোর্ট উইলিয়ামের (কলকাতাস্থ ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টার) সাথে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ রক্ষা করছে। শাফায়াত জামিল মুজিব হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আদালতে একথা বলেছেন। 

       ষষ্ঠত : আগস্ট ঘটনার প্রতিশোধ নিতে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুজিবভক্ত যে জঙ্গি গ্রুপটি ভারতে গিয়েছিলেন, ভারত তাদের কোনরকম সাহায্য করেনি এবং নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। সপ্তমত : জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নবেম্বর '৭৫ যে পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, ভারত পরিকল্পিতভাবেই তা থেকে দূরত্ব রক্ষা করে। অষ্টমত : সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ এবং রক্ষীবাহিনীর রাজনৈতিক নির্দেশক তোফায়েল আহমেদ শেখ সাহেব ও তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর কোন উদ্যোগই নেননি। এই নিষ্ক্রিয়তা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের উভয়ের সহজাত আবেগের পরিপন্থী। 

      কারা তাদেরকে ঐ সময় প্যারালাইজেড করে রেখেছিল? শেখ পরিবারের সদস্য শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় সফিউল্লাহর ব্যর্থতাকে কাকতালীয় মনে করেন না। বাংলাদেশের সুপুরুষ-যোগ্য নেতৃত্বকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ায় এ অঞ্চলে কারা বেশি লাভবান হতে পারে এবং হয়েছে, সে বিশ্লেষণের ওপর ইতিহাসের রায় নির্ভর করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে ভারতকে যেভাবে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়েছে, তাতে ভারতের প্রতি সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করাকে অনেকেই মহাপাপ এবং পাকিস্তানী মানসিকতার পুনরাবির্ভাব হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন। বেশ কিছু দিন ধরে শোনা যাচ্ছে, মুজিব হত্যার দুই দন্ডপ্রাপ্ত আসামি ভারতের তিহার জেলে বন্দি। উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দিলে ভারত তাদের ফেরত দেবে বলেও খবর পাওয়া গেল। 

      সরকার যখন দন্ডপ্রাপ্ত মুজিব হত্যাকারীদের প্রবাস থেকে ফিরিয়ে আনতে দক্ষযজ্ঞ শুরু করেছেন, তখন ভারতের কারাগারে বন্দি খুনিদের ফেরত আনার ব্যাপারে নীরব কেন? প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানীদের কথিত ভাড়াটে খুনিরা, ভারতে যাবার সাহস পেল কীভাবে? ঐ দু'খুনি কী ধরা পড়ে ভারতের কারাগারে আছে, নাকি ভারতই তাদের সেফ কাস্টোডিতে রেখেছে, এ প্রশ্নের মীমাংসাও হওয়া দরকার। 

       এখন শোনা যাচ্ছে, এসব খুনীরা ভারতে উলফাদের ট্রেনিং দিচ্ছে। এ মীমাংসায় যাবার আগে ভারতের খ্যাতিমান ও প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের অতি সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি ফেরাতে চাই। ভারতের ‘দ্য ট্রিবিউন' পত্রিকায় প্রকাশিত [২৫-০৮-১০] এক নিবন্ধে কুলদীপ নায়ার শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড ঠেকাতে ভারতের ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। ‘‘ভারতের স্বাধীনতা দিবসের একইদিনে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের ঘটনা ভারতের জনগণ কোনদিন ভুলতে পারবে না’’ বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। 

     তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে এই অনুতাপ চিরদিন আমাদের থেকে যাবে। কারণ, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অাঁচ করতে পেরেছিল, শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান ঘটবে। কিন্তু শেখ সাহেবের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, ঢাকাকে এটুকু অবহিত করা ছাড়া এ ঘটনা ঠেকাতে আমরা কিছুই করিনি।’’ প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত ও তার সমর্থক অনুগামীরা যদি দৃঢ়ভাবে এটা বিশ্বাস করেন যে, একাত্তরের পরাজিত শত্রু, তথা পাক-মার্কিন অক্ষ মুজিব হত্যার নাটের গুরু, তাহলে ভারতের নিষ্ক্রিয়তার সমীকরণ তারা কিভাবে টানবেন? 

     ভারতের এই ‘কিছুই না করার' ব্যর্থতা কী নিছক অমনোযোগিতা না দুর্ঘটনা? নাকি মুজিব হত্যার রচিত দৃশ্যপট বাস্তবায়ন কামনা করে ভারত তাকে পরোক্ষ সমর্থনে সফল করে তুলেছে? ঢাকায় ১৫ আগস্ট যে অভ্যুত্থান ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র'-এর অজ্ঞাতে তা ঘটেছে বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। এ প্রশ্নে যাবার আগে মুজিব হত্যার পর ভারতের খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় পশ্চিম বাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়সহ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যকার আলাপচারিতার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

    অবশ্যই সেটা মুজিব হত্যার ঘটনাকেন্দ্রিক। অন্নদা শংকর লিখেছেন : ‘‘...আমি কাঁদতে কাঁদতে একটা প্রবন্ধ লিখি। নাম রাখি-‘‘কাঁদো, প্রিয় দেশ।’’ সেটি পাঠিয়ে দেই ‘দেশ' পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে। সাগরময় ঘোষ সেটি ফেরত দিয়ে লিখেন : ‘‘ছাপাতে পারা যাবে না মুখ্যমন্ত্রীর বারণ।’’ মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সাথে অন্নদা বাবু দেখা করে এর বৃত্তান্ত জানতে চাইলে তিনি তাঁকে বলেন : ‘‘ঢাকায় যা ঘটেছে, তা আরও ভয়ানক। 

     শোনা যাচ্ছে, চার হাজার লোক মারা গেছে। এমন অবস্থায় এই প্রবন্ধ প্রকাশ না করাই ভালো। এই প্রবন্ধ প্রকাশে হয়তো এক কোটি লোক এপারে এসে শরণার্থী হবে। আমরা মারা যাবো।’’ অনেক পীড়াপীড়ির পর মুখ্যমন্ত্রী লেখাটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর মতামতের জন্যে সেটি অনুবাদ করে দিল্লী পাঠান। অন্নদা বাবু লিখেছেন : ‘‘কিছুদিন পর পেলুম শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর লেখা এক চিঠি।... 

     তাঁর মতে, আমার প্রবন্ধ প্রকাশ করা হলে ভারত সরকার হবে বিব্রত। সুতরাং ওটি প্রকাশ না করাই উচিত।... তাঁরই তো শোক প্রকাশ করা উচিত।... তাঁর সরকারেরতো উচিত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা। তাঁরইতো উচিত সরকারিভাবে শোক প্রকাশ করা। কয়েকমাস পরে আমি আবার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রবন্ধটি প্রকাশের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেই। তিনি নিরুত্তর। আবার কয়েকমাস পরে চিঠি লিখি। তিনি নিরুত্তর। আবার কয়েকমাস পরে চিঠি লিখি। তিনি নিরুত্তর। আবার কয়েকমাস পরে চিঠি লিখি। তিনি নিরুত্তর। তখন নিতাই মজুমদার নামে একজন নতুন প্রকাশক প্রস্তাব করেন যে, তিনি আমার প্রবন্ধটি আরও কয়েকটি প্রবন্ধের সাথে মিলিয়ে বই করে প্রকাশ করতে চান। বইয়ের ওপর সেন্সরশিপ নেই। 
‘‘... ‘কাঁদো প্রিয় দেশ'-নামে বই হয়ে বের হয়।’’ ভারতীয় নাগরিক অন্নদা বাবুর মনে যে প্রশ্নের দহন, বঙ্গবন্ধুভক্ত আওয়ামী লীগারদের মনে এমন প্রশ্ন নেই কেন? আরও প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশ বিরোধী প্রকাশনাকে বরাবর উৎসাহ দিয়ে প্রকাশ করে, সেখানে মোশতাক সরকারের সময় ভারত সরকার কেন এই সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল?
------------------------------------------------  
সুত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম,সম্পাদকীয়। সোমবার ০৪ অক্টোবর ২০১০ | 

Post a Comment

0 Comments