Recent Tube

জ্বি, এটাই আল্লাহ’র নিয়ম- জিয়াউল হক।

          জ্বি, এটাই আল্লাহ’র নিয়ম               .       .    ------------------------ 
     লন্ডনে ১৬৩০ খৃষ্টাব্দে চরম এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া জব চার্নক কাদা মাটি জলাশয়পূর্ণ এক জেলে পল্লী সুতানুটিকে গড়ে তুলেছিলেন কোলকাতা হিসেবে। পুরো বাংলাই নয়, পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা বিকাতে কলকাঠি নাড়া হয়েছে যে কোলকাতায় বসে, সেই কোলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক। চরম দারিদ্রতার নিষ্পেষণে জর্জরিত বাবা-মা’র বখে যাওয়া সন্তান কাজের খোঁজে এসেছিলেন ১৬৫৮ খৃষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন কর্মচারী হিসেবে আসেন হুগলীর কাশিমবাজারস্থ কুঠিতে।

     পলাশিতে স্বাধীনতা হারানোর এক শত বৎসর আগেকার ঘটনা। সম্রাট আওরঙ্গজেব তখন ক্ষমতায়। কোনো রকম কর প্রদান ছাড়াই বাংলার আনাচে কানাচে ব্যবসা করা নিয়ে মোগল সম্রাটের সাথে কোম্পানীর সংঘাত শুরু আর একশত বৎসরে পরে স্বাধীনতা হারানো! ইতিহাস বর্ণনার জন্য নয়। এ লেখা ভিন্ন কিছুর।

    জব চার্নক একবার কুঠির অনতিদূরে নদীর ধার ঘেঁষে কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যসহ যাত্রাপথে দেখলেন অনেক নারী পুরুষের জটলা, কেউ কেউ আবার কাঁদছেনও। নিকটে গিয়ে জানলেন, হঠাৎ মৃত্যু হওয়া এক বনেদী ব্রাহ্মণ যুবকের লাশ পোড়াতে হবে চিতা সাঁজানো হচ্ছে। মৃতের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনরা জটলা করে কাঁদছে। তার একটু দূরেই আরও একদল নারী-পুরুষ বিলাপ করছে পনোরো বৎসরের অনিন্দ সুন্দরী এক কিশোরীকে ঘিরে ধরে।

   চার্নক জানতে পারলেন, কিশোরীটি মৃত যুবকের বিধবা স্ত্রী, মৃত স্বামীর চিতায় জ্যন্ত পোড়ানোর হবে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি সবার সামনেই আগুনে পুড়ে ছাই হবে! সেই বেদনায় মেয়েটির বাবা-মা ভাই বোন, আত্মীয়-স্বজনরা বিলাপ করছে। তবে যে মেয়েটির মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই! সে নিশ্চুপ পাথর যেন!  কারণ, তাকে ধুতুরা রস পান করানোতে সে সজ্ঞানে নেই।

     চার্নক মেয়েটাকে দেখলেন। সুন্দরী ও নিষ্পাপ চেহারার কিশোরীর দিক থেকে চোখ ফেরােেত পারলেন না। এক মহুর্ত ভেবে সৈন্যদের হুকুম করলেন, মেয়েটাকে ঘিরে ফেলতে। সমবেত জনতাকে  বললেন, তোমরা মেয়েটাকে হত্যা করো না, আমি তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিচ্ছি। 'রাম! রাম! ব্যাটা বলে কি? বামুনের জাত মারবে দেখচি!' খেঁকিয়ে উঠলো সকলে। 

     অনড় চার্নক কিশোরীকে জোরপূর্বক নিয়ে গেলেন ১৬৬৩ সালের এক বর্ষণমূখর বিকেলে। আজীবন কাছে রেখেছেন, খৃষ্টধর্মমতে স্ত্রী বানিয়ে, নাম রেখেছিলেন; মারিয়া। প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন। চারটি সন্তান; এক ছেলে, তিন মেয়ে। ছেলেটা চার্নকের জীবদ্দশাতেই মারা যায়। তিন মেয়ে; মেরি, এলিজাবেথ ও ক্যথরিন, ইংরেজ স্বামী নিয়ে ঘর সংসারও করেছিল। মেজো মেয়েটা শতবর্ষীও হয়েছিল। 

     দীর্ঘ পচিশ বৎসর সংসার করে মারিয়া ১৬৮৭ খৃষ্টাব্দে, চার্নকের মৃত্যুর (১৬৯২) পাঁচ বৎসর আগেই মারা গেলে বারাকপুরে খৃষ্টধর্মমতে কবরস্থ করে চার্নক, কবরের পাশে বাগানবাড়ীও করেছিলেন। প্রেমের উপন্যাস নয় বরং ভিন্ন বিষয় সামনে আনতেই এ লেখা।

     হিন্দু সমাজে স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবার দায়িত্ব তার কোনো আত্মীয় স্বজনই নিতো না, এমনকি, নিজ গর্ভের সন্তানরাও নয়। রাষ্ট্র বা সমাজও না, তাই অসহায় এ নারীদের মৃত স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা হতো। এ জঘন্য, অমানবিকতাকে ধর্মীয় আবেগে মহিমান্বিতও করা হতো; 'সতী' হিসেবে!  অবশ্য স্বামীর আগে স্ত্রী মরলেও কিন্তু স্ত্রীর লাশের সাথে স্বামীকে মরতে হতো না! কারণ স্বামীরা সবময়ই স্বৎ! তাদের সততা প্রশ্নাতীত!!

     খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে বর্বর প্রথাটি চলেছে চটকদার ‘সতীদাহ’ নামে। আরবেও জীবন্ত কন্যাশিশুকে কবরস্থ করা হতো। প্রিয় রাসুল সা: এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুললেন। আর রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়েই চীরদিনের জন্য তা অবৈধ ঘোষণা করলেন। বর্বর প্রথাটি দূর হয়ে গেল। 

   সেই প্রিয় রাসুল সা: এর অনুসারী মুসলমানরা ভারতের শাসনক্ষমতা পেয়েও অমানবিক প্রথাটি দূর করতে কোন পদক্ষেপ নিয়েছে? এটা কি তাদের দায়িত্ব ছিল না?  জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো পদক্ষেপ তারা নিয়েছিল? ষোড়শী পাঁচ হাজার সুন্দরীকে নিজের রক্ষিতা বানবার জো ছিল কিন্তু এ্ইসব হতভাগীদের পূনর্বাসনের কোনো উপায় মহামতিদের জানা ছিল না?

    উনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশকের দশটি বৎসরে বাংলা বিহার উড়িষ্যায় ৫৯৯৭ জন নারীকে পুড়ে মরতে হয়। বৎসরে গড়ে ৬০০ জন! বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের এক রিপোর্টমতে ১৮২৯ সালে, এক বৎসরেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ৪৬৩ জনের মধ্যে একমাত্র বাংলাতেই ৪২০ নারী চিতায় জ্বলেছেন!

     মোগল সম্রাট, আমাদের শাহানশাহ, বাদশাহ আলামপনাহরা কোনো ব্যবস্থা নেননি অসহায় নারীর জীবন বাঁচাতে। কিন্তু সুদুর ইংল্যন্ড থেকে আগত এক ইংরেজ তার নিজে চেস্টায় একজন নারীকে যে কেবল বাঁচিয়েছেন তাই নয়, তিনি তাকে সারা জীবনের জন্য নারীত্বের, মাতৃুত্বের সামাজিক ও মানবিক মর্যাদাও দিয়েছেন! অথচ তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্রুর, নির্মম, শঠ প্রকৃতির লোক। তার সহকর্মী ও সমসাময়িক ইংরেজ পর্যটক Alexander Hamilton এর বর্ণনা এবং কোম্পানীর বাৎসরিক গোপন প্রতিবেদনই সে কথা বলে।

   সেই অশিক্ষিত, নির্মম, লোভী, শঠ লোকটিই যখন আল্লাহর সৃষ্টির মানবিক কল্যাণে এগিয়ে এলেন বড় বড় আল্লামাদের নিস্কৃয়তার সুযোগে, তখনই ইতিহাসের গতিপথ উল্টে গেলো। সমাজ ও সভ্যতার নেতৃত্ব থাকবে তাদের হাতে, যাদের দ্বারা সমাজবাসীর বৈষয়িক, জৈবিক ও মানবিক প্রয়োজন পূরণ হয়, এটাই আল্লাহর নিয়ম। ‘ওয়ালানতাজিদা লিসুন্নতিল্লাহি তাবদিলা’; আল্লাহর নিয়মে কোন ব্যতয় হয় না।

     ইসলামের খেদমতে (!) মহাব্যস্ত মহারথীরা কবে বুঝবেন যে, আমরা আসলে ধর্মের কোনো কল্যাণ করতে পারি না বরং ধর্মই মানুষের সার্বিক কল্যাণটাকে নিশ্চিত করে। আমাদের দায়িত্ব হলো, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ ও প্রাণীর কল্যাণটা নিশ্চিত করা। 

   এটাই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। যারা এই মৌলিক শিক্ষাটাকে আত্মস্থ করতে পেরেছে, এই সমাজ, ও সভ্যতার নেতৃত্ব তাদের হাতেই থাকবে। নিস্কর্মা বসে তসবিহজপা, হুজরাবাসী অণলবর্ষী স্বঘোষিত আল্লামাদের হাতে নয়। আর এটাই আল্লাহ’র নীতি -
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ওবিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments