Recent Tube

সাইয়েদ কুতুবের জন্ম, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ৷ শামীম আজাদ।

সাইয়েদ কুতুবের জন্ম, শিক্ষা কর্মজীবনঃ


   সাইয়েদ কুতুবের নাম সাইয়েদ 
কুতুব তাঁর বংশীয় উপাধি। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিসরের উত্তরাঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী ইবরাহীম কুতুব। ইবরাহীম কুতুবের পাঁচ সন্তান ছিল। সাইয়েদকুতুব, মুহাম্মাদ কুতুব, হামিদ কুতুব, আমিনা কুতুব।পঞ্চম কন্যা সন্তানটির নাম জানা যায়নি। সাইয়েদ কুতুব ভাই বোনদের মধ্যে বড়, তাঁরা সকল ভাই বোনই উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন; ইসলমামী জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে জিহাদ করেন এবং কঠোর অগ্নি পরীক্ষায় দৃঢ়তার পরিচয় দেন।

সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ (উনিশ শ’ ছয়) সালে মিসরের উসইউত জিলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আম্মা ফাতিমা গোসাইন উসমান অত্যন্ত দ্বীনদার ও আল্লাহভীরু মহিলা ছিলেন। সাইয়েদের পিতা হাজী ইবরাহীম চাষাবাদ করতেন কিন্তু তিনিও ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ন ও চরিত্রবান।

    গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈশবেই কুরআন হেফয করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পিতা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। সাইয়েদ তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্ত কের তিনি কায়রোর বিখ্যাত মাদ্রাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। উনিশ শ’ তেত্রিশ সালে ঐ মাদ্রাসা থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

     কিছুকাল অধ্যাপনা করার পর তিনি শিক্ষা মন্ত্রোণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। মিসরে ঐপদটিকে অত্যন্ত সম্মানজনক বিবেচনা করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই তাঁকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি পড়া-শুনার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। তিনি দু’বছরের র্কোস শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকা থাকা কালেই তিনি বস্তুবাদী সমাজের দুরবস্থা লক্ষ্য করেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।

    আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পরই তিনি ইখয়ানুল মুসলেমুন দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী যাচাই করতে শুরু করেন। উনিশ শ’পয়তাল্লিশ সালে তিনি ঐ দলের সদস্য হয়ে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মিসরেক স্বাধীনতা দানের ওয়াদা করেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইখওয়ান দল বৃটিশের মিসর ত্যাগের দাবীতে আন্দোলন শুরু কের। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেড়ে যায়। মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যে এ দলের সক্রিয় কর্মী সংখ্যা পঁচিশ লক্ষে পৌছে। সাধারণ সদস্য, সমর্থক ও সহানুভুতিলীলদের সংখ্যা ছিল কর্মী সংখ্যার কয়েকগুণ বেশী। বৃটিশ ও স্বৈরাচারী মিসর সরকার ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে পড়েন এবং এ দলের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ষড়ডন্ত্রে লিপ্ত হন।

     ইংরেজী উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের জুলাই মাসে মিসরে সামরিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বছরই ইখওয়ান দল পুনরায় বহাল হয়ে যায়। ডঃ হাসানুল হোদাইবি দলের মোরশেদ –এ- আম নির্বাচিত হন। দলের আদর্শ প্রচার ও আন্দোলনের সম্প্রসারণ বিভাগ তাঁর পরিচালনাধীনে অগ্রসর হতে থাকে। পরিপূর্ণ রূপে নিজেকে আন্দোলনের কাজে উৎসর্গ করেন তিনি।

    উনিশ শ’ চুয়ান্ন সালে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী-“ইখওয়ানুল মুসলিমুন”- এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছ’মাস পরই কর্নেল নাসেরের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। কারণ, ঐ বছর মিসর সরকার বৃটিশের সাথে নতুন করে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন, পত্রিকাটি তার সমালোচনা করে। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার এ দলের উপর নির্যাতন শুরু করেন। একটি বানোয়াট হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলিমুন দলকে বেআইন ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার ও নির্যাতন
গ্রেফতারকৃত ইখওয়ান নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। তাঁকে মিসরের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাঁকে সে অবস্থায় গ্রেফতার করেন। তাঁর হাতে পায়ে শিকল পরানো হয়। শুধু তাই নয়, সাইয়েদ কুতুবকে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় জেল পর্যন্ত হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়। পথে কয়েকবার বেহুঁস হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। হুঁশ ফিরে এলে তিনি বলতেনঃ ———— (আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ)।

    জেলে ঢুকার সাথে সাথেই জেল কর্মচারীগণ তাঁকে মারপিট করতে শুরু করে এবং দু’ঘন্টা পর্যন্ত এ নির্যাতন চলতে থাকে। তারপর একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুরকে তাঁর উপর লেলিয়ে দেয়া হয়। কুকুর তাঁর পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে বেড়ায়। এ প্রাথমিক অভ্যর্থনা জানানোর পর একটানা সাত ঘন্টা ব্যাপী তাঁকে জেরা করা হয়। তাঁর স্বাস্থ্য এসব নির্যাতন সহ্য কর আর যোগ্য ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর সুদৃঢ় ঈমানের বলে পাষাণ থেকে উচ্চারিত হতে থাকেঃ—————– (আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ)

      জেলের অন্ধকার কুঠরী রাতে তালাবদ্ধ করা হতো। আর দিনের বেলা তাঁকে রীতিমত প্যারেড করনো হতো। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বক্ষপীড়া, হৃদপিণ্ডেরদুর্বলতা ও সর্বাঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। তবু তাঁর গায়ে আগুনের ছেঁকা দেয়া হতে থাকে। পুলিশের কুকুর তাঁর শরীরে নখ এ দাঁতের আঁচড় কাটে। তাঁর মাথায় খুব গরম পানি এবং পরক্ষণেই বেশী ঠাণ্ডা পানি ঢালা হতে থাকে। লাথি, কিল, ঘুষি, অশ্লীন ভাষায় গালাগালি ইত্যাদি তো ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার।

       উনিশ শ’ পঞ্চান্ন সালের তেরই জুলাই, গণআদালতের বিচারে তাঁকে পনর বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। অসুস্থতার দরূণ তিনি আদালতে হাজির হতে পারেননি। তাঁর এক বছর কারাভোগের পর নাসের সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি সংবাদ পত্রের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন করলে তাঁকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে জবাব দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অম্নান হয়ে থাকবে। তিনি বলেনঃ

   “আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি যে, মযলুমকে যালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবু আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাযী নই। আমি আল্লাহ্‌র দরবারে এমন অবস্থায় হাযির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।”

    পরবর্তীকালে তাঁকে যতবার ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ততবারই তিনি একই কথা বলেছেন: “যদি আমাকে যথার্থই অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি এতে সন্তুষ্ট আছি। আর যদি বাতিল শক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে থাকে, তাহলে আমি কিছুতেই বাতিলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবো না।”

    উনিশ শ’ চৌষট্টি সালের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর যান। তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করায় কর্নেল নাসের তাঁকে মুক্তি দিয়ে তাঁরই বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করেন।

আবার গ্রেফতার ও দণ্ড
এক বছর যেতে না যেতেই (?)তাঁকে আবার বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অথচ তিনি তখনও পুলিশের কড়া পাহারাধীন ছিলেন। শুধু তিনি নন, তাঁর ভাই মুহাম্মাদ কুতুব, বোন হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাযারেরও বেশী লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রায় সাত শ’ ছিলেন মহিলা।

      উনিশ শ’পয়ষট্টি সালে কর্নেল নাসের মস্কো সফরে থাকাকালীন এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। আর এই ঘোষণার সাথে সাথেই সারা মিসরে ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক ধরপকড় শুরু হয়। উনিশ শ’ চৌষট্টির ছাব্বিশে মার্চে জারীকৃত একটি নতুন আইনের বলে প্রেসিডেন্টকে যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার,তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ প্রভৃতি দণ্ডবিধির অধিকার প্রদান করা হয়। তার জন্যে কোন আদালতে প্রেসিডেন্টের গৃহীত পদক্ষেপের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলেও ঘোষণা করা হয়। কিছুকাল পর বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। প্রথমত ঘোষনা করা হয় যে, টেলিভিশনে ঐ বিচারানুষ্টানের দৃশ্য প্রচার করা হবে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ অপরাধ স্বীকার করতে অস্বীকার এবং তাদের প্রতি দৈহিক নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করায় টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর রুদ্ধদার কক্ষে বিচার চলতে থাকে। আসামীদের পক্ষে কোন উকিল ছিল না। অন্য দেশ থেকে আইনজীবীগণ আসামী পক্ষ সমর্থনের আবেদন করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করা হয়। ফরাসী বার এসোসিয়েনের ভূতপূর্ব সভাপতি উইলিয়াম থরপ (Thorp) ও মরোক্কোর দু’জন আইনজীবী আসামী পক্ষ সমর্থনের জন্য রীতিমত আবেদন করেন। কিন্তু তা না মঞ্জুর করা হয়। সুদানের দু’জন আইনজীবী কায়রো পৌছে তথাকার বার এসোসিয়েশনে নাম রেজিষ্ট্রী করে আদালতে হাযির হন। পুলিশ তাঁদের আদালত থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয় এবং মিসর ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সাইয়েদ কুতুব ও অন্যান্য আসামীগণ উনিশ শ’ ছেষট্টি সালের জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইবুনালের সামনে প্রকাশ করেন যে, অপরাধ স্বীকার করার জন্যে তাঁদের উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। ট্রাইবুনালের সভাপতি আসামীদের কোন কথার প্রতিই কান দেননি।

ইংরেজী উনিশ শ’ ছেষট্টি সালের আগষ্ট মাসে সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর দু’জন সাথীকে সামরিক ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে মৃত্যুদন্ডাদেশ শুনানো হয়। সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠে। কিন্তু পঁচিশে আগষ্ট, উনিশ শ’ ছেষট্টি সালে ঐ দন্ডদেশ কার্যকর করা হয়। 

সাইয়েদ কুতুবের জ্ঞান ও সাহিত্য চর্চা
সাইয়েদ কুতুব মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও সাহিত্যকদের অন্যতম। শিশু সাহিত্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যক জীবনের সূচনা। ছোটদের জন্যে আকর্ষণীয় ভাষায় নবীদের কাহিনী লিখে তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন। শিশুদের মনে ইসলামী ভাবধারা জাগানোর জন্যে এবং তাদের চারিত্রক মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি গল্প লিখেন। পরবর্তীকালে ‘আশওয়াক’ (কাটা) নামে ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট একখানা উপন্যাস রচনা করেন। পরে ঐ ধরণের আরও দু’টো উপন্যাস রচনা করেন। একটি ‘তিফলে মিনাল ক্বারীয়া’ (গ্রামের ছেলে) ও অন্যটি ‘মাদিনাতুল মাসহুর’ (যাদুর শহর)।

  তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির বিবরণ নিম্নরূপ:

(১), ---- (কুরআনের আঁকা কেয়ামতের দৃশ্য )। কুরআন পাকের ১১৪টি সূরার মধ্য থেকে ৮০ টি সূরার ১৫০ স্থানে কেয়ামতের আলোচনা রয়েছে। সাইয়েদ বিপুল দক্ষতার সাথে সেসব বিবরণ থেকে হাশরের ময়দান, দোযখ ও বেহেশতের চিত্র এঁকেছেন।

(২) -- ২০০ পৃষ্ঠা সন্বলিত গ্রন্থখানায় সাইয়েদ কুতুব কুরআনের ভাষা, ছন্দ, অলংকার ও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনাভঙ্গীর আলোচনা করেছেন।

(৩)--  (ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার )। এ পর্যন্ত বইখানার ৭ম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বইখানা অনুদিত হয়েছে। (যথাঃ ইংরেজী, ফারসী, তুর্কী ও উর্দুভাষায় )।

(৪) --- সাইয়েদ কুতুবের এক অনবদ্য অবদান। আট খন্ডে সমাপ্ত এক জ্ঞানের সাগর। ঠিক তাফসীর নয়- বরং কুরআন অধ্যয়নকালে তাঁর মনে যেসব ভাবের উদয় হয়েছে তা-ই তিনি কাগজের বুকে এঁকেছেন এবং প্রতিটি আয়াতের ভিতরে লুকানো দাওয়াত সংশোধনের উপায়, সতর্কীকরণ, আল্লাহর পরিচয় ইত্যাদি বিষয়ে নিপুণতার সাথে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

(৫)--- (ইসলাম ও পুঁকিবাদের দ্বন্দ)।

(৬)—– (বিশ্বশান্তি ও ইসলাম )।

(৭)—— (ইসলামী রচনা বলী)।

(৮)——-(সাহিত্য সমালোচনার মূলনীতি ও পদ্ধতি )।

(৯)— (‘ভবিষ্যত সংস্কৃতি’ নামক পুস্তকের সমালোচনা )।

(১০) —– (গ্রন্থাবলী ও ব্যক্তিত্ব )।

(১১)—– (ইসলামী সমাজের চিত্র)।

(১২)——(আমি যে আমেরিকা দেখেছি)।

(১৩)——- (চার ভাই বোনের চিন্তাধারা)। এতে সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মাদ কুতুব, আমিনা কুতুব ও হামিদা কুতুবের রচনা একত্রে সংকলিত হয়েছে।

(১৪)—— (কবিতা গুচ্ছ)।

(১৫)—– (নবীদের কাহিনী )।

(১৬) ——(কবিতা গুচ্ছ)।

(১৭)——-(কবিতা গুচ্ছ )।

(১৮) ——- (জীবনে কবির আসল কাজ)।

(১৯)—— (সমাজ বিপ্লবের ধারা )।

পুস্তক লেখার জন্যেই মিসর সরকার সাইয়েদ কুতুবকে অভিযুক্ত করেন ও ঐ অভিযোগে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। মিসরে সামরিক বাহিনীর পত্রিকা।

পয়ষট্টির ১লা অক্টোবরের প্রকাশিত ৪৪৬নং সংখ্যায় তাঁর বিরুদ্ধে অতীত অভিযোগের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়, তাতে যা বলা হয়েছে, তার সারমর্ম নিম্নরূপঃ

“লেকখ পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সমাজ এবং মার্কসীয় মতবাদ উভয়েরই তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি দাবী করেন যে, ঐসব মতবাদের মধ্যে মানব জাতির জন্য কিছুই নেই। তাঁর মতে বর্তমান দুনিয়া জাহেলিয়াতে ডুবে গেছে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের জায়গায় অন্যায়ভাবে মানুষের সার্বভৌমত্ব কায়েম হয়ে গেছে। লেখক কুরআনের দৃষ্টিভংগীকে পুনরুজ্জীবিত করে সে জাহেলিয়াতকে উচ্ছেদ করার উপর জোর দেন এবং এ জন্যে নিজেদের যথাসর্বস্ব কুরবানী করে দেয়ার আহবান জানান।

 তিনি আল্লাহ ব্যতীত সকল শাসনকর্তাদের তাগুত আখ্যা দেন। লেখক বলেন – তাগুতের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা প্রতিটি মুসলমানের জন্যে ঈমানের শর্ত। তিনি ভাষা, গাত্রবর্ণ, বংশ, অঞ্চল ইত্যাদির ভিত্তিতে ঐক্যবোধকে ভ্রান্ত আখ্যা দিয়ে ইসলামী আকীদার ভিত্তিতে ঐক্য গড়া এবং এ মতবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করার জন্যে মুসলিমদের উস্কানী দিচ্ছেন।

লেখক তাঁর ঐ পুস্তুকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা, সারা মিসরে ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করা ও প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা পেশ করেন।”

ভুমিকা,
মানবতার দুরবস্থা,
মানবজাতি আজ একটি অতলান্ত খাদের প্রন্তদেশে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান কালের ধ্বংসলীলা তাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ণ করে দিতে উদ্যত হয়েছে বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। বরং এ অবস্থাটা রোগের একটা লক্ষণ মাত্র। প্রকৃত রোগ এটা নয়। মানবজাতি আজ যে বিপদের সম্মুখীন তার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের সার্বিক উন্নয়ন ও সত্যিকার অগ্রগতির জন্য জীবনের যে মূল্যবোধ প্রয়োজন, তা হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি পাশ্চাত্য জগতের কাছে তাদের আধ্যাত্মিক দেউলিয়াপনা সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছে এবং তারা আজ অনুভব করছে যে, মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালানার উপযোগী জীবনের কোন মূল্যবোধ তাদের কাছে নেই। তারা জানে যে, তাদের নিজেদের বিবেককে পরিতুষ্ট করা ও তার স্বকীয়দা টিকিয়ে রাখার মত কোন মূলধনই তাদের কাছে নেই।

পাশ্চাত্য দেশে গণতন্ত্র নিস্ফল ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে; যার ফলে প্রাচ্যের চিন্তাধারা, মতবাদ ও জীবন বিধান গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হচ্ছে বলে মনে হয়। তার সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এই যে, সমাজতন্ত্রের নামে প্রচ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তারা পাশ্চাত্যে চালু করছে। প্রাচ্যজোটেরও ঐ একই দশা। তারা সমাজ বিধান, বিশেষত মার্কসীয় মতবাদ সূচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিপুল সংখ্যক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কারণ এ মতবাদ একটা সুনিদিষ্ট মৌল বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত হয়।

কিন্তু চিন্তার সমতল ভূমিতে মার্কসীয় মতবাদ পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। একথা বলা আজ মোটেই অত্যুক্তি নয় যে, বর্তমান দুনিয়ায় কোন একটি দেশও সত্যিকার মার্কসপন্থী নয়। এ মতবাদ সার্বিকভাবে মানুষের জন্মগত স্বভাব ও তার মৌলিক প্রয়োজনের পরিপন্থী। মার্কসীয় আদর্শ শুধুমাত্র অধঃপতিত অথবা দীর্ঘকাল যাবত একনায়কত্বের যাতাকলে নিস্পিষ্ট নিস্প্রাণ সমাজেই প্রসার লাভ করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে এরূপ সমাজেও এর বস্তুবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমস্যার সমাধান দানে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ বস্তুবাদী অর্থনীতিই মার্কসীয় মতবাদের ভিত্তি। কম্যুনিষ্ট দেশগুলোর উস্তাদ রাশিয়াই আজ খাদ্যাভাবের সম্মুখীন। জারের শাসনামলে যে রাশিয়া উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন করতো, সে দেশই আজ তার সংরক্ষিত স্বর্ণের বিনিময়ে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানী করছে। সমবায় খামারভিত্তিক চাষাবাদই এ ব্যর্থতার কারণ। অন্য কথায় বলা যায় মানব স্বভাবের বিপরীতধর্মী ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলেই মার্কসীয় মতবাদ ব্যর্থতার সম্মুখীন।

নয়া নেতৃত্বের প্রয়োজন,
মানবজাতি আজ নতুন নেতৃত্ব চায়। পাশ্চাত্যের নেতৃম্ব আজ ক্ষয়িষ্ণ। এর কারণ,পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বস্তুগত দারিদ্র অথবা আর্থিক ও সামকরিক শক্তির দুর্বলতা নয়। পাশ্চাত্য জগত মানবজাতির নেতৃত্বের আসন এ জন্যে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে যে, জীবনী শক্তি সঞ্চারকারী যেসব মৌলিক গুণাবলী তাকে একদিন নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠত করছিল, সেসব গুণ আজ তার কাছে নেই।

অনাগত দিনের নতুন নেতৃত্বকে ইউরোপের সৃজনশীল প্রতিভার অবদানগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের সাথে সাথে মানবজাতির সামনে এম ন মহান আদর্শও মূল্যবোধ পেশ করতে হবে, যা আজ পর্যন্ত অনাবিস্কৃতই রয়ে গেছে। আর ভবিষ্যতের নেতৃত্বকে মানবজাতির সামনে একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক ও বাস্তব জীবন বিধান পেশ করতে হবে, যা মানব স্বভাবের সাথে সস্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যশীল।

একমাত্র ইসলামী ব্যবস্থাই উল্লিখিকত মূল্যবোধ ও জীবন বিধান দান করতে সক্ষম।

বিজ্ঞানের প্রতাপও ষেষ হয়ে এসেছে। ষোড়শ শতকে যে রেনেসা আন্দোলন সূচিত হয়ে আঠারো ও উনিশ শতকে বিজয়ের উচু শিখরে পৌছে গিয়েছিল, তা আজ নিস্প্রভ হয়ে পুনরুজ্জীবন শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আধুনিক যুগে যেসব জাতীয়তাবাদী ও উগ্র স্বাদেশিকতাবাদী মতবাদ জন্ম নিয়েছে এবং এগুলোকে ভিত্তি করে যেসব আন্দোলন ও জীবনযাত্রা প্রণালি গড়ে উঠেছে, সবগুলোই আজ নির্জীব হয়ে পড়েছে। সংক্ষেপে বলতে হয়, মানুষের তৈরী সকল জীবন বিধানই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

এ নাজুক ও বিভ্রান্তিকর ক্রান্তিলগ্নে ইসলাম ও মুসলিম সমাজের নিজ দায়িত্ব পালনের সময় এসেছে। ইসলাম কখনো সৃষ্টজগতকে বস্তুসম্ভার আবিস্কারে বাধা দেয়নি। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে মানুষকে খিলাফতের দায়িত্বসহ প্রেরণের সময়ই মানবজাতিকে সৎপথ দেখানোর দায়িত্ব পালনকে কয়েকটি শর্তাধীনে আল্লাহর ইবাদত বলেই ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই নয়, এটাই মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেনঃ
------------------------------------------------  
আর তোমার প্রতিপালক এয সময় ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি ধরা পৃষ্ঠে আমার খলীফা প্রেরণকরতে যাচ্ছি।-আল বাকারা: ৩০
------------------------------------------------  

আর জ্বিন ও মানবজাতিকে আমি আমি আমার বন্দগী ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। – আয যারিয়াত: ৫৬

এতো গেল খিলাফত ও বন্দগীর কথা। কিন্তু সাথে সাথে মানবজাতির প্রতি আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাহদের উপর যে দায়িত্ব পালনের ভার দিয়েছেন, তাও পূরণ করার সময় এসেছে।
------------------------------------------------  
এভাবে তোমাদেরকে মধ্যবর্তী উম্মাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি যেন তোমার মানবজাতির প্রতি স্বাক্ষী হতে পার এবং রাসূল তোমাদের উপর স্বাক্ষী থাকতে পারেন। — আল বাকারা:১৪৩

তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাত, মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্যেই তোমাদের উত্থান। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেবে, অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাসী হবে।

--আলে ইমরান:১১০

ইসলামের ভুমিকা, 
কোন একটি সমাজ তথা জাতির বুকে বাস্তবে রূপ লাভ না করে ইসলাম তার ভুমিকা পালন করতে পারে না। বিশেষভাবে বর্তমান যুগের মানুষ নিছক প্রশংসা শুনে কোন মতবাদ গ্রহণ করতে রাযী হয় না। তারা বাস্তবে রূপায়িত ব্যবস্থাকেই সহজে বিচার করতে পারে। এ দৃষ্টিবংগী থেকে আমরা বলতে পারি যে, বিগত কয়েক শতব যাবত মুসলিম জাতি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। আর ঐ কারণেই বর্তমানে তারা এমন একটি ভূখণ্ড দেখাতে সক্ষম হবে না যেখানে ইসলাম তার পূর্ণ সত্তায় বিরাজমান। আজকের মুসলমানদেরকে দেখলে একথা বিশ্বাসই হয় না যে, তাদের নিকট অতীতের পূর্বপুরুষেরা ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মসলমান এমন একদল লোকের নাম, যাদের চাল-চলন, ধ্যান-ধারণা, আইন-কানুন ও মূলবোধ সবকিছুই ইসলামী উৎস থেকে গৃহীত। যে মুহূর্তে থেকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মুসলিম দল ধরা পৃষ্ঠ থেকে বিলীন হয়ে গেছে।

ইসলামকে পুনরায় মানবজাতির নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মুসলিম উম্মাতকে তার আসল রূপ পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুসলিম উম্মাত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানব রচিত রীইতনীতির আবর্জনায় চাপা পড়ে রয়েছে। ইসলামী শিক্ষার সাথে যেসব ভ্রান্ত আইন-কানুন ও আচার-আচরণের দূরতম সম্পর্কও নেই, সেগুলোরই গুরুভারে আজ মুসলমান উম্মাত নিষ্পষ্ট। তবু মুসলমানেরা নিজেদের এলাকাকে ইসলামী জগত আখ্যা দিয়ে আত্ম প্রসাদ লাভ করে।

আমি জানি, নিজেদের পুনগঠন ও মানবজাতির নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার করণ- এ দুটো কাজের মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। কারণ, দীর্ঘকাল যাবৎ মুসলমান উম্মাতের অস্তিত্ব দৃশ্যমান জগত থেকে বিলুপ্ত। এবং মানবগোষ্ঠীর নেতৃত্ব অনেক আগেই অন্যান্য আদর্শ, অনৈসলামিক ধ্যান-ধারণা, ভিন্ন ধরনের জীবন বিধান ও অমুসলিম জাতিগুলোর করায়ত্ব হয়ে রয়েছে।

আলোচ্য সময়ে ইউরোপীয় প্রতিভা বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, আইন-কানুন ও বস্তুতান্ত্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে চমৎকার উন্নতি সাধন করেছে এবং এরই ফলে মানব সমাজ সৃষ্টি শক্তি ও বস্তুগত সুবিধার উপকরণ নির্মাণ কৌশল অনেক উপরে উঠে গেছে। এসব চমৎকার উপকরণ আবিস্কারের দোষত্রুটির প্রতি ইশারা করা সহজ নয়। বিশেয় করে ইসলামী জগত যখন সৃজনশীল প্রতিভা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত, তখন পাশ্চাত্য দেশীয় যান্ত্রিক উপকরণ আবিস্কারকদের সমালোচনা আরও বেশী কঠিন।

কিন্তু এসব বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ইসলামী ইনকেলাব অত্যাবশ্যক। ইসলামী আদর্শের পুনরুজ্জীবন ও বিশ্বনেতৃত্বের আসন পুনরুদ্ধারের মধ্যে বিরাট ব্যবধান ও অশেষ বাধা-বিঘ্ন অবশ্যই আছে। তবু প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামী আদর্শের পুনরুজ্জীবন সাধনের জন্যে সময় নষ্ট না করে কাজ শুরু করা দরকার।

বিশ্ব নেতৃত্বের জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাবলী
যদি জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি সহকারে আমকরা কাজ করতে চাই, তাহলে মুসলিম উম্মাতের উপর আল্লাহর প্রদত্ত বিশ্ব নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের জন্যে কোন্‌ কোন গুণাবলী অর্জন করা দরকার, তা আমাদের অবশ্যই জেনে নিতে হবে। সংস্কার ও পুনগঠনের কাজ শুরু করতে গিয়ে যেন হোঁচট থেতে না হয়, সে জন্যেই আমাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা দরকার।

আজকের মুসলিম উম্মাত মানবজাতির সামনে বস্তুতান্ত্রিক আবিস্কারের যোগ্যতা অথবা সম্ভাবনাময় প্রতিভা প্রদর্শনে অক্ষম। বর্তমান দুনিয়ার মানবসমাজ মুসলিম উম্মাতের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে তাকে নেতৃত্বের আসন দান করবে, এ অক্ষমতার জন্য তার এরূপ আশা বাতুলতা মাত্র। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের সৃজনশীল মস্তিক অনেক দূর অগ্রসর এবং পরবর্তী কয়েক শতক পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় ইউরোপকে পরাজিত করে যান্ত্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার কল্পনাও আমরা করতে পারিনা। তাই আমাদেরকে এমন সব গুণাবলী অর্জন করতে হবে যা আধুনিক সভ্যতায় বিরল।

তাই বলে বস্তুতান্ত্রিক উন্নতির বিষয়টিকে আমরা মোটেই অবহেলা করবো না। বরং আমরা পার্থিব সুখ-সুবিধার প্রতিও যথাযোগ্য গুরুত্ব আরোপ করবো। কারণ শুধু মানবজাতির নেতৃত্ব প্রদানের জন্যই বৈষয়িক উন্নতি জরুরী নয়। উপরন্তু নিজেদের এবং ইসলামের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যেও এটা অপরিহার্য। ইসলাম মানুষকে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর খলীফার মর্যাদা দিয়েছে এবং খলীফার দায়িত্ব পালন ও আল্লাহর বন্দেগী করাকে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা করেছে। তাই আল্লাহর খলীফা হিসেবে তাঁর দুনিয়ার উন্নতি সাধন আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

মানবজাতির নেতৃত্বদানের জন্যে আমাদের বৈষয়িক উন্নতি ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু পেশ করতে হবে। তা হচ্ছে মানব জীবন সম্পর্কে মৌলিক বিশ্বাস (ঈমান) এবং সে বিশ্বাসের ভিত্তিতে রটিত একটি জীবন বিধান। এও বিধান আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার সকল অবদান সংরক্ষণ করবে। সাথে সাথে মানবজাতির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের আরাম-আয়েশের যে চমৎকার উদ্যোগ আয়োজন করেছে, তার মান বজায় রাখতে সক্ষম হবে। আর এ বিশ্বাস (ঈমান) ও জীবন বিধান মানব সমাজে তথা মুসলিম সমাজে বাস্তব রূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করবে।

আধুনিক যুগের জাহেলিয়াত,
আধুনিক জীবন যাত্রার উৎসমূলের দিকে লক্ষ্য করলে এটা পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, গোটা বিশ্বই আজ জাহেলিয়াতের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং সুখ-সুবিধার সকল আধুনিক উপায় উপকরণ ও চমৎকার উদ্ভাবনী প্রতিভার পাশাপাশি অজ্ঞাতাও সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণই জাহেলিয়াতের প্রমাণ। এর ফলে আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ সার্বভৌমত্ব মানুষের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক মানুষ মানব সমাজের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। অবশ্য এ জাহেলিয়াত প্রাচীন ও প্রাথমিক যুগের মত আল্লাহকে সরাসরি অস্বীকার করে না। বরং বাস্তবে ভাল-মন্দর মান নির্ণয়, সমষ্টিগত জীবনের জন্যে আইন প্রণয়ন, জীবন বিধান রচনা ও নির্বাচনের অধকার দাবীর মাধ্যমে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়। কারণ, আলোচ্য বিষয়গুলোতে আল্লাহ যে নির্দেশাবলী দিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যান করেই কোন মানুষ এ কাজগুলো করতে পারে। আল্লাহর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহের অনিবার্য পরণতিই হচ্ছে তার সৃষ্টির উপর যুলুম ও নির্যাতন।

কম্যুনিষ্ট সমাজে মানবতার প্রতি করা হয় চরম লাঞ্ছনা এবং পুঁজিবাদী সমাজের অর্থলোভ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের দরুন সাধারণ মানুষ ও দুর্বল জাতিগুলোর প্রতি করা হয় নির্মম শোষণ নিষ্পেষণ। আল্লাহর কর্তৃত্বের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা এবং মানুষের আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা অস্বীকার করার এ হচ্ছে অনিবার্য পরিণতি।

    এ আদৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, ইসলামই, একমাত্র জীবন বিধান। কারণ অন্যান্য জীবন বিধানের অধীনে কোন না কোন প্রকারে মানুষ মানুষেরই দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। একমাত্র ইসলামী জীবন বিধানেই মানুষের দাসত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে শুধু মাত্র আল্লাহরই বিধি-নিষেধ মুতাবেক শুধু তারই সমীপে নতি স্বীকার কের তাঁর বন্দেগী করতে সমর্থ হয়।

ইসলাম ও জাহেলিয়াতের পার্থক্য,
এখান থেকেই ইসলামের যাত্রাপথ অন্যান্য জীবন বিধান থেকে পৃথক হয় যায়। জীবন সম্পর্কিত এ নতুন দৃষ্টভংগীর ভিত্ততে রচিত ও বাস্তব জীবনের পরিপূর্ণ উপযোগী বিবন বিধানই আমরা মানব সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারি। বর্তমান মানব সমাজ ইসলামের এ মৌলবাণী সম্পর্কে অজ্ঞ। পাশ্চাত্যের আবিস্কারকগণ ইউরোপীয় অথবা প্রাচ্য প্রতীচ্যের প্রতিভাধর ব্যক্তিদের চিন্তাপ্রসূত এ জীবন দর্শন নয়।

      এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা যে জীবন দর্শনে বিশ্বাসী, তা সকল দিক থেকেই পূর্ণাংগ। বিশ্ববাসীর নিকট ইসলামের এ বৈশিষ্ট্য আজও অজ্ঞাত। আর তারা এর চাইতে উত্তম বা এর সমকক্ষ কোন জীবন বিধান পেশ করতে সক্ষম নয়।

  আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, বিশেষ এলাকায় ইসলাম বাস্তবে রূপায়িত না হলে এ ব্যবস্থার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না। তাই এ ব্যবস্থার অধীনে একটি সমাজ গড়ে তুলে দুনিয়ার সামনে নমুনা পেশ করা একান্ত প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই কোন একটি মুসলিম দেশে ইসলামী সমাজের পুনঃপ্রবর্তন জরুরী। অদুর ভবিষ্যতে ইসলামী সমাজের পুনরুজ্জীবনকামী দলই বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করবে।

ইসলামী সমাজের পুনরুজ্জীবন,
ইসলামী সমাজের পুনরুজ্জীবন কিভাবে সম্ভব? এ জন্যে একিট অগ্রগামী দলকে নিজেদের গন্তব্যস্থল ঠিক করে নিয়ে জাহেলিয়াতের বিশ্বগ্রাসী অকুল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। চলার পথে এ দলের সৈনিকরা সর্বব্যাপী জাহেলিয়াতের ছোঁয়া থেকে নিজেদের হেফাযত করে চলবেন এবং একই সাথে তা থেকে সাহায্যও নেবেন।

এ অগ্রগামী দলকে অবশ্যই যাত্রা শুরু করা সঠিক স্থান, সার্বিক পথের দিশা, এর গলি, উপগলি, চলার পথের সকল বিপদ-আপদ এবং দীর্ঘ ও কষ্টকর সফরের উদ্দেশ্য জেনে নিতে হবে। শুধু তাই নয়, সারা দুনিয়ার জাহেলিয়াত কোথায় কি পরিমাণ শিকড় বিস্তার করেছে, কখন কার সাথে কি পরমাণ সহযোগিতা করতে হবে এবং কোন সময় তাদের নিকট হতে পৃথক হতে হবে, কোন কোন্‌ গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা প্রয়োজন এবং পরিবেষ্টনকারী জাহেলিয়াতের কি কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, জাহেলিয়াতের ধারক বাহকদের সাথে কোন্‌ ভাষায় আলাপ করতে হবে, কোন কোন বিষয় ও সমস্যা আলোচ্য সূচীতে স্থান লাভ করবে এবং কিভাবে কোথা থেকে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ গ্রহণ করতে হবে; এসব বিষয়েই পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে ময়দানে নামতে হবে।

আমাদের ঈমানের শক্তির উৎস হচ্ছে পাক কুরআনের মৌলিক শিক্ষা। যে কুরআনের শিক্ষা ও বাণী থেকে স্বর্ণ যুগে ইসলামের পতাকাবাহীগণের মনে আলোর মশাল জ্বলে উঠেছিল – তাই হবে আমাদের পাথেয়। এ পাথেয় সন্বল করেই অতীতে আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তিগণ আল্লাহরই নির্দেশে মানব ইতিহাসের গিত পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আমি এ বিপ্লবের অগ্রনায়কদের উদ্দেশ্যেই এ গ্রন্থ রচনা করেছি এবং এতে প্রয়োজনীয় বাস্তব কর্মপন্থাও পেশ করার চেষ্টা করেছি।

‘ফী যিলালীল কুরআন’ শীর্ষক আমার লেখা অপর একখানা গ্রন্থের চারটি অধ্যায়কে আলোচ্য বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল করার উদ্দেশ্যে দু’চার জায়গায় সামন্য পরিবর্তন করে এ গ্রন্থের রূপ দেয়া হয়েছে।

এর ভূমিকা এবং অন্যান্য অধ্যায়গুলো আমি বিভিন্ন সময়ে লিখেছিলাম, পবিত্র কুরআনের উপস্থাপিত জীবন দর্শন সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করার সময় আমি যে সুগভীর সত্য উপলব্ধি করেছি, তাই এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। আমার এ চিন্তারাশি আপাত দৃষ্টিতে এলোপাতাড়ি এবং পরস্পর যোগসূত্রবিহীন মনে হতে পারে। তবে একটি সত্য কথা এই যে, আমার চিন্তাগুলো চলার পথের পাথেয় এবং পরিত্যাজ্য পথের পরিচায়ক। আমার এ লেখাগুলো এক ধারাবাহিক রচনার প্রথম কিস্তি মাত্র। ভবিষ্যতে আল্লাহ তাআলার সাহায্যে আমি এ বিষয়ে আরও কিছু লেখার ইচ্ছা পোষণ করি।

আর আল্লাহ তাআলার রহমতই এ কাজের প্রধান সম্বল।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক, কলামিস্ট ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।          

Post a Comment

0 Comments