Recent Tube

লকডাউন, গলদা চিংড়ি ও জীবনের শিক্ষা : জিয়াউল হক।

লকডাউন, গলদা চিংড়ি ও জীবনের শিক্ষা 

   আমাদের অনেকেরই প্রিয় গলদা চিংড়ি। সুস্বাদু গলদার স্বাদের কথা মনে আসতেই মুখে পদ্মার প্রবাহ নেমে আসে যেন! গলদা চিংড়ি খ্যাতি পেয়েছে তরল সোনা হিসেবে। সারা বিশ্বের ভোজনপ্রিয় মানুষের কাছে গলদা চিংড়ি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবারের চাহিদা ব্যপাক। জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী। 

   বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গলদা চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ হয়ে  ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে রপ্তানী হচ্ছে। চাষী ও উৎপাদকরা যেমন সাবলম্বী হচ্ছেন তেমনি দেশও প্রতি বৎসর শত শত কোটি টাকার মুল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে।

       গলদা চিংড়িকে ইংরেজি ভাষায় Lobster বলা হয়। আর চিংড়িকে Shrimp। আমাদের কাছে উভয়ই হলো চিংড়ি। আমরা চিংড়ি বা Shrimp বলে জানি সাধারণত ছোট ও মাঝারি সাইজের চিংড়ি মাছকে। আকারে বড়গুলোকেই বলে থাকি গলদা চিংড়ি বা Lobster। সম্ভবত দুই ধরনের নামকরণের পেছনে বৈজ্ঞানীক আরও কারণ রয়েছে যা জীববিজ্ঞানী বা মৎসবিজ্ঞানীরা আরও ভালো বলতে পারবেন।
   এরা প্রধানত নদী নালা ও সমুদ্রের তলদেশে মাটি ঘেঁষে বাস করে। এদের গঠন ও জীবন প্রবাহ এক দারুণ বৈচিত্রতায় ভরা। এর পাঁচ জোড়া পা রয়েছে। মাথার উপরে রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী দুটো এ্যন্টেনা। এই এ্যন্টেনা দিয়ে সে সামনে, উপরে বা আশে পাশে অন্যান্য জীব জন্তুর অবস্থান ও গতি প্রকৃতি অনুধাবন করে। চিংড়ি বা গলদা চিংড়ির কোনো মেরুদন্ড নেই। এরা হলো মেরুদন্ডহীন প্রাণী। শরীরে কপারের উপস্থিতির কারণে এদের রক্ত হয় নীল বর্ণের, লাল নয়।

   আকারে ছোট চিংড়ি অহরহই দেখতে পাই। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ বড় বড় গলদা চিংড়ি দেখতে পাওয়া যায়, যা সাধারণত বিদেশে রপ্তানী হয়। দশ থেকে বারো ইঞ্চি লম্বা গলদা চিংড়িরও দেখা মেলে। কানাডায় একবার বিরাট গলদা চিংড়ির দেখা পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, সেটার ওজন ছিল ২০ কেজিরও বেশি।

   এরা সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বৎসর পর্যন্ত বাঁচে। এদের মধ্যে এক বিচিত্র বৈশিষ্ঠ রয়েছে, এরা হাঁটা বা সাতার কাটার সময় সামনের দিকে নয়, বরং পেছন দিকে যায়। বুকে বা পেটের উপর ভর করে এরা ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১১ মাইল পর্যন্ত যেতে পারে।

   এদের জীবন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে চমৎকার দিক হলো, এদের শরীরের বাইরের দিকে একটা শক্ত খোলশ গড়ে উঠে। এদের শরীর বাড়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, সাথে সাথে এই খোলস কিন্তু বাড়ে না। ফলে বাড়ন্ত শরীর এক সময় ঐ খোলসের মধ্যে নিজেকে ছোট্ট মনে হয়, আঁটো সাঁটো মনে হয়। তারা ব্যথায় কাতর হয়, ছট ফট করে।

   জীবন বাঁচাতে এরা তখন সমাজ থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়ে কোনো নির্জন জায়গায়, পাথরের নীচে , কোনো গর্তের মধ্যে লকডাউনে চলে যায়। সেখানে তারা নিজেদের গা থেকে এই শক্ত খোলস, যার কারণে তার চলা ফেরাসহ জীবন ধারন অসম্ভব হয়ে উঠছে, সেটাকে কুরে কুরে ছেঁটে ফেলে। শরীরের উপর থেকে এই শক্ত আচ্ছাদনটি ছেঁটে ফেলায় এরা খুব দূর্বল ও শিকারী মাছের সামনে ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

    এর জন্য এদেরকে প্রথম কিছুদিন সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয়। মানুষের শরীরে যেমন নখ বাড়তে থাকে ঠিক তেমনি সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে এদের শরীরেও আবার একটা শক্ত আবরণ বা খোলস গড়ে উঠে, এরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

   এরকম একটা চক্র এদের জীবনে বেশ কয়েকবার ফিরে আসে। প্রতিবারই এরা ঐ একই নিয়মে নিজেদেরকে আলাদা করে নির্জনে লকডাউনে নিয়ে গিয়ে খোলসটা ঝেড়ে ফেলে দেয়। এভাবেই তারা বেড়ে উঠে।

     এবারে একটা বিষয় কল্পনা করুন। এদের সমাজে যদি ডাক্তার, কবিরাজ, ফিজিওথেরাপিস্ট থাকতো যেমনটা আমাদের সমাজে রয়েছে, তা হলে এরা শরীরে ব্যাথার জন্য ডাক্তারের কাছে বা কবিরাজের বা ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যেতো, ঔষধ খেয়ে ব্যাথা কমাতো অথবা খোলস বৃদ্ধির প্রবণতাকে রোধ করতো কৃত্রিমভাবে। এক্ষেত্রে তাদের বৃদ্ধি ঘটতো না। সাইজে পুঁচকে রয়ে যেতো এবং অল্প বয়সেই মারা যেতো। 

   আমরা নিজেদেরকে ঐ গলদা চিংড়ির জায়গায় কল্পনা করি আসুন। জীবনে চলতে ফিরতে আমরা বারংবার মানসিক, শারীরিক ও সামাজিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হই। আমাদের আঘাত ও বাধাটা যদি শারীরিক বা মানসিক হয়, তা হলে ডাক্তারের কাছে যাই, ঔষধ ও সেবা নেই। মানসকিভাবে ভেঙ্গে পড়ি, হতাশ হই। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ি, হতোদ্যম হয়ে পড়ি।

   আমরা যদি ঐ গলদা চিংড়ির জীবন থেকে শিক্ষা নেই, বাধা ও বিপত্তি, ব্যর্থতা ও বৈরিতা, কষ্ট ও ক্লেশ, হতাশা ও হতোদ্যমের সময় যদি চিংড়ির মত করে নিজেদেরকে লকডাউনে রেখে ভেবে দেখি, আমাদের ব্যর্থতার কারণগুলো,  এ থেকে উত্তরণের পথই বা কি? আমাদের অনুসৃত কর্মপন্থার কোথায় কোন গলদ ছিল? সেগুলো খুঁজে বের করে চিংড়ির খোলস ঝেড়ে ফেলার মত করে সেই কর্মপন্থাগুলো ঝেড়ে ফেলে নতুন কর্মপন্থা নিয়ে মাঠে নামি, তা হলে সাফল্য ঠেকায় কে?

   লকডাউন আমাদের সামনে সে সময় ও সুযোগটা এনে দিয়েছে।  এ সময় ঘরের কোণে আটকে থাকতে বাধ্য আমরা যদি গলদা চিংড়ির জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ভুলগুলো শুধরে নিজেদের পূনর্গঠিত করে নিতে পারি, তা হলে আগামি বিশ্ব, করোনা পরবর্তি বিশ্ব আমাদের, ইনশআল্লাহ সেটা নিশ্চিত।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও  বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments