Recent Tube

সেদিনের ‘ওটা বেংগা’- আজকের জর্জ ফয়েড এবং আমেরিকাঃ জিয়াউল হক।

সেদিনের ‘ওটা বেংগা’- আজকের জর্জ ফয়েড এবং আমেরিকা,

   ‘ওটা বেংগা’ একজন মানুষ। একজন হতভাগ্য আফ্রিকান কালো মানুষ ছিলেন । ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছেন ভাগ্যচক্রে। আধুনিক সভ্যতার কপালে এক কলংকতীলক হয়ে আছে এই হতভাগা নির্দোষ মানুষটির নাম।

  আফ্রিকায় গিয়েছিলেন এক আমেরিকান ব্যবাসায়ী, মিশনারী ধর্মযাজক ও গবেষক Samuel Phillips Verner (স্যামুয়েল ভার্নার) ১৯০৪ সালে চার্লস ডারউইন এর ‘থিওরী অব ইভোলিউশন’ নিয়ে গবেষণার জন্য। বিখ্যাত(?) এই গবেষক বানর আর মানুষের মধ্যে যোগসুত্র খুঁজে পেতে তার গবেষণা পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন!
‘ওটা বেংগা’ ছিলেন একজন বিবাহিত পুরুষ। দুই সন্তানের জনক। অথচ তাকে তার নিজ দেশ কংগো থেকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায়। তার স্ত্রী’সহ দুই সন্তানকে হত্যা করে তাকে চালান করে দেয়া হয় দাস ব্যবসায়ীদের সাথে আমেরিকায় গবেষণা কাজের সহায়তার জন্য।

  কারণ, ওটা বেংগা দেখতে মানুষের মত ছিলেন! ‘গবেষক’ স্যামুয়েল বিশ্বাস করতেন, ‘ওটা ব্যংগো’ বানরেরই বংশধর!  বিবর্তনের ক্রমধারায় মানুষের কাছাকাছি (!) পর্যায়ে পৌছে গেছেন! অতএব, ডারউইনের বিবর্তন বাদ প্রমাণে তাকে কাজে লাগানো যাবে,  ওটা বেংগা’ বানর আর মানুষের মাঝামাঝি একটা জীব হিসেবে বিবর্তনবাদের সাক্ষাৎ প্রমাণ!

  এ গবেষণায় সফলতার প্রমাণ হিসেবে আমেরিকার লুসিয়ানা অংগরাজ্যে এক প্রদর্শনী প্রদর্শনীতে বিবর্তনবাদের অকাট্য প্রমাণ (!) হিসেবে বড় গর্বভরে প্রদর্শন করা হয় ‘ওটা ব্যংগো’কে। সভ্য (!) শিক্ষিত (!) ও বিজ্ঞানমনস্ক (!) আমেরিকান নাগরিকরা দলে দলে এই ‘আবিস্কার’কে দেখতে ভীড় করে! বানরের খাঁচায়, চিড়িয়াখানায় বিশেষ তত্ববাধানে রাখা মানুষের মত(!) এই জীব (?)কে দেখতে।

   এক রবিবার সর্বোচ্চ প্রায় চল্লিশ হাজার দর্শক ভীড় করে আজব এই প্রাণী(!)টিকে দেখতে। এইসব দর্শক সেই রবিবার’টায় কি বিশেষ আনন্দ উপভোগ করেছে, তার একটা বিবরণ আমরা দেখতে পাই তথাকথিত এক বিজ্ঞানীর লেখায়;

  'There were 40,000 visitors to the park on Sunday. Nearly every man, woman and child of this crowd made for the monkey house to see the star attraction in the park? The wild man from Africa. They chased him about the grounds all day, howling, jeering, and yelling. Some of them poked him in the ribs, others tripped him up, all laughed at him.' ( Phillip V. Bradford and Harvey Blume, Ota Benga: The Pygmy in the Zoo, St Martins, 1992, 269pp.)

   উক্ত বিবরণীতে পরিস্কার যে, ৪০ হাজার আমেরিকান সভ্য পুরুষ, নারী, আর শিশু, তরূণ, যুবক, যুবতী মিলে ‘মানুষের মত’ দেখতে এই আজব জীবটি (!)কে সারাটা দিন তেড়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, আমাদের দেশে যেমন ছোট ছোট শিশুরা খোলা মাঠে মালিকবিহিন বানর বা নেড়ি কুকুরকে তেড়ে নিয়ে বেড়ায়, ঢিল ছোঁড়ে, খোঁচা দেয়, মজা করে, খেলা করে, ঠিক সেভাবেই!
   আধুনিক বিশ্বে মানবতার তীর্থভূমি (!)আমেরিকার বুকে এই জঘণ্যতম কান্ডটি কিভাবে ঘটতে পারল আমেরিকান সরকার ও জনগণের চোখের সামনে, সে প্রশ্ন আজও এক বিষ্ময় বটে!
হতভাগা ‘ওটা ব্যংগো’কে নিউইয়র্কের Bronx Zoo চিড়িয়াখানায় বানরের সাথে, বানরের খাঁচায় একটা জীব(!) হিসেবেই রাখা হয়!
অনেকটা মানুষের মত (!) দেখতে নতুন এই জীব! এর আগমণের সুসংবাদটি চিড়িয়াখানার তৎকালীন পরিচালক Wiliam T. Hornaday আমেরিকার Zoological Society's Bulletin এ নিজের লেখায় তুলে ধরেন এভাবে;

  'On September 9, a genuine African Pygmy, belonging to the sub-race commonly miscalled "the dwarfs,". . . Ota Benga is a well-developed little man, with a good head, bright eyes and a pleasing countenance. He is not hairy, and is not covered by the "downy fell" described by some explorers…. He is happiest when at work, making something with his hands.' ( Wiliam T. Hornaday, 'An African Pygmy', Zoological Society Bulletin, No. 23, October, 1906, pp. 301-302.)

   চিড়িয়াখানার যে অংশে বানর, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং’দের রাখা হয়, সে অংশেই একটা বানরের খাঁচায় এই আজব জীব ‘ওটা ব্যংগো’কে রাখা হয়!! তার সাথে একই খাঁচায় তার সাথী হিসেবে একটা টিয়া পাখি এবং Dohong' নামক একটা শিশু ওরাং ওটাংকেও রাখা হয়! উৎসুক দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে তার খাঁচার সামনে পরিচিতি হিসেবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ লিখে রাখেন;

  The African Pigmy, "Ota Benga."
Age, 23 years. Height, 4 feet 11 inches.
Weight, 103 pounds. Brought from the Kasai River, Congo Free State, South Central Africa, by Dr. Samuel P. Verner.

  ধীরে ধীরে এই খবর পুরো আমেরিকা জুড়ে রটে গেলে কোন কোন বিবেকবান ব্যক্তি এ নির্মম ও লজ্জাকর ঘটনার নিন্দায় মূখর হন। বিশেষ করে, আমেরিকার নিগ্রোরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। আমেরিকার বিশ্বখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসে ১৯০৬ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর এইসব বিরোধিতাকারীদের সমালোচনা করে এক উপসম্পাদকীয়তে লিখেছিল;

  We do not quite understand all the emotion which others are expressing in the matter ... It is absurd to make moan over the imagined humiliation and degradation Benga is suffering. The pygmies ... are very low in the human scale, and the suggestion that Benga should be in a school instead of a cage ignores the high probability that school would be a place ... from which he could draw no advantage whatever. The idea that men are all much alike except as they have had or lacked opportunities for getting an education out of books is now far out of date. 

   ভাবানূবাদ: এ বিষয়ে কেন যে আবেগ দেখানো হচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য হয় না।  ওটা বেংগকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে মর্মে এ আবেগ কল্পিত ও অবাস্তব। বস্তুত পিগমিরা মানুষ বিবেচনায় খুবই নিম্নমানের।  ওটা বেংগাকে খাঁচায় বন্দি রাখার পরিবর্তে  স্কুল দেয়া উচিৎ মর্মে যে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে তা অবাস্তব, কারণ, স্কুল থেকে সে  লাভবান হতে পারবে না। সব মানুষই সমান এবং শিক্ষাকার্যক্রমের সুযোগ না পেয়েই তারা পশ্চাতে পড়ে থাকে, এমন ধারণা এযুগে অচল ও সেকেলে।  ("Man and Monkey Show Disapproved by Clergy." The New York Times, September 10, 1906, pg. 1)

  দীর্ঘ বাদ-প্রতিবাদের পরে অবশ্য ‘ওটা বেংগা’ মুক্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। নিজ দেশ কংগোতে আর ফেরা হয়নি তার। চিড়িয়াখানা থেকে মুক্তি পাবার কিছুদিনের মধ্যেই আক্রান্ত হন ডিপ্রেশনে। এক পর্যায়ে চুরি করা এক রিভলবার দিয়ে নিজের মাথায় নিজেই গুলি চালান। ১৯১৬ সালের ২০শে মার্চ মাত্র ৩২ বৎসর বয়সে তিনি সভ্যতাগর্বীত আমেরিকার গালে এভাবেই চপেটাঘাত করেন আত্মহত্যার মাধ্যমে।

  মাত্র একটি শতাব্দী আগেও আমেরিকার শিক্ষিত ও সভ্যতাগর্বীত জনগণ একজন কালো মানুষকে নিয়ে এই জঘণ্য ও লজ্জাকর কাজটি করেছে, বা করতে পেরেছে, আজও যে তাদের অধিকাংশই সে মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, প্রকাশ্যে জর্জ ফয়েডকে হত্যা ও তৎপরবর্তি সময়কালে মার্কিন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া থেকে সেটাই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ,গ্রন্থপ্রনেতা,গীতিকা, ও বিশ্লেষক।         

Post a Comment

0 Comments