সূখী, সমৃদ্ধশালী ও সম্মানের জীবন চান? তা হলে-
এক দুর্ভিক্ষের বছরে হালিমাতুস সাদিয়া তায়েফ হতে দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে মক্কায় রওনা হন। তাঁর কোলেও এক শিশু ছিল । অপুষ্ঠি আর অনাহারের ফলে যে যথেষ্ট পরিমাণ দুধ না পেয়ে রাতভর চিৎকার করে কাঁদতো । তাদের একটি উটনি ছিল বটে কিন্তু এটারও দুধ ছিল না।
মক্কায় আগত ধাত্রী মাতারা এতিম শিশু মুহাম্মদ (সঃ), শিশুটির পরিবার অভিজাত হলেও মোটেই ধনী বলা যায় না। শিশুটি পিতৃহীন, এতিম জেনে নিতে নেয়নি। অপরদিকে বিবি হালিমার ভগ্নস্বাস্থ্য ও দুধের স্বল্পতার কারণে কেউ তাকে আপন শিশুও দেয়নি।
এতিম মুহাম্মদকে মা আমিনার কোলে দেখে তার বুকে হাত রাখলে আচমকা ঘুমের মধ্যেই শিশুটির মুখে হাসি ফুটে উঠে, চোখে খুলে চায়। হালিমার সাথে তার চোখের সম্মিলন ঘটে, মহুর্তের মধ্যে তার মাতৃহৃদয়কে তা আন্দোলিত করে, তাৎক্ষণিকভাবে মেটারনাল বন্ডিংটা তৈরি হয়ে যায়। নিজের কোলে তুলে নিয়ে তিনি পরম মায়ায় শিশুটির জোড়া ভ্র’র মধ্যে চুমো দিলেন।
স্বামীকে বলেন, আল্লাহর কসম, যদিও ওকে লালন পালন করে তেমন কোন পারিশ্রমিক বা উপহার পাব না, তারপরেও ছেলেটিকে নেয়ার জন্য আমার মন আকুল হয়ে উঠেছে। স্বামী বললেন; তুমি ভুল পথে চলছো বলে আমার মনে হয় না। ঐ শিশুর সাথে সাথে হয়তো আল্লাহর রহমতও আমাদের ঘরে আসতে পারে।
স্বামীর সাথে পরামর্শ করে শূন্য হাতে ফেরার চেয়ে এ এতিম শিশু মুহাম্মদকেই নেন তারা। তাঁবুতে এসে ডান স্তন শিশুটির মুখে দেন এই আশায় যে, আল্লাহ যদি তার ক্ষুধা নিবারণের কোন ব্যবস্থা করেন। অবাক কান্ড, হঠাৎ করেই তার স্তনে দুধের প্রবাহ এতোটা বেড়ে গেল, যে হালিমার বুকের দুধে নিজ সন্তানের ক্ষুধা মিটতো না, সেই হালিমার এক স্তনের দুধেই নবাগত শিশুটি পেট ভরে খাবার মতো দুধ পেলো!
লক্ষ্য করলেন তাদের মাদী উটটার বাঁটেও দুধ এসেছে। অথচ এই উটের দুধ একেবারে শুকিয়ে থাকতো, দুধ না পেয়ে ক্ষিদেয় পুরো পরিবারের পেটের নাড়ি ছেঁড়ার উপক্রম হতো, অথচ আজ সকালে তার স্বামী উটটাকে দহন করে এতো বেশি পরিমান দুধ পেলেন যে তাদের ক্ষিদে দূর হয়ে গেল। ক্ষুধার জ্বালায় কয়েক মাস তাদের চোখে ঠিক মতো ঘুম ছিল না, অথচ সে রাতে তারা তৃপ্তপেটে সুখে ঘুমিয়েছেন। এসব দেখে পরদিন সকালে স্বামী হারেস বলে উঠলেন; হালিমা! যে শিশুকে পালনের ভার আমরা নিয়েছি, মনে হয় তার উপর নিশ্চয়ই আল্লাহর অশেষ বরকত রয়েছে।
এবারে ফেরার পালা। মক্কায় সবার শেষে পৌঁছেছিলেন, শিশু খুঁজে পেতে দেরি হওয়ায় সহযাত্রীদের অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছিলেন। তায়েফ থেকে আগত সকলেই পছন্দমতো শিশু নিয়ে আগেই রওয়ানা হয়ে অনেকদূর, কয়েক মঞ্জিল চলে গিয়েছে।
দলছাড়া হয়ে হালিমা পরিবার’সহ ফিরে চললেন তায়েফের দিকে। কিন্তু এবারে তার দূর্বল গাধাটা যেন দৌড়াতে লাগলো! যে সঙ্গীরা তাদের পেছনে ফেলে অনেকটা পথ চলে এসেছিলেন অচিরেই তাদের ধরে ফেললেন তারা। বিষ্মিত সাথীরাই চেঁচিয়ে বলে উঠে; হালিমা গাধাটাকে একটু আস্তে চালাও বোন, চলো এক সাথেই সবাই ঘরে ফিরি! এটা কি সেই গাধাটাই যাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলে?
হালিমা কি জবাব দিবেন? তাঁর তো কোন জবাব নেই মুখে! তিনি কেবল ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিষ্ময়ের সাথে দেখে চলেছেন। তাদের বিষ্ময়ের এখনো ঢের বাঁকি। তাদের জমিটা ছিল সবচেয়ে ঊষর, কোন ঘাস জন্মাতো না। দুর্ভিক্ষে ভেড়াগুলোরও জীর্ণশীর্ণ অবস্থা হয়ে পড়েছিল। অথচ মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই তার সেই ভেড়া দুম্বাগুলো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠলো, সংখ্যায় তারা বেড়ে চললো। তারা এতো বেশি পরিমান দুধ দিতে লাগলো যে, অত দুধ নিয়ে তিনি কি করবেন সেটাই ভেবে পেতেন না!
সুধী পাঠক, হয়তো বলবেন, জীবন ও পরিবারে বরকত এসেছে কারণ তিনি আল্লাহর নবীকে নিয়েছিলেন। ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে ভাবুন, বার বার ভাবুন। জীবন ও সমাজ সন্মন্ধ্যে দৃষ্টির সামনে এক নবদিগন্ত খুলে যাবে।
বাস্তবতা হলো, প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: তখনও নবী নন, ভবিষ্যতে হবেন সেটা মা আমিনা বা বিবি হালিমা কেউই জানতেন না। শুধুমাত্র একজন নবীর জীবন বলে কথা নয় বরং একজন এতিমের জীবন। এই জীবনের মধ্যেই রয়েছে পুরো মানবতার জন্য এক চমৎকার শিক্ষা।
শিক্ষাটা হলো, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি এতিম, অসহায় দূর্বলদের লালন পালনের ক্ষেত্রে যে বা যারা তাকে, তথা, আল্লাহকে সহায়তা করে (এতিম লালন পালন ও তাদের সহায়তার মাধ্যমে), আল্লাহ তার বা তাদের সম্মান ও প্রাচুর্যের জীবন দেন, সুখ ও সমৃদ্ধির সন্ধান দেন। এটা আমার অকাট্য বিশ্বাস।
বিশ্বাস না হলে সমাজে যে বা যারা নি:স্বার্থভাবে এতিম লালন পালন ও পূনর্বাসনে জড়িত, যারা সমাজের দু:স্থ ও অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়স্থল, অবলম্বন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন, তাদের জীবন ও পরিবারের দিকে লক্ষ্য করুন, দেখবেন আমার কথাটা এক নিরেট সত্য। এক অকাট্য বাস্তবতা। বিশ্বের অনেক দেশে, যেখানেই গেছি, সেখানেই গোপনে, নীরবে বিষয়টাকে লক্ষ্য করেছি। পর্যবেক্ষণটা অতিশয়োক্তি নয়, আমার আক্বিদার অংশ। সূখী, সমৃদ্ধশালী ও সম্মানের জীবন চান? তা হলে পরখ করে দেখতে পারেন নিজেই।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা, গীতিকার, ও বিশ্লেষক।
0 Comments