Recent Tube

এখনও যদি সময় না হয়, তবে আর কবে? জিয়াউল হক।

এখনও যদি সময় না হয়, তবে আর কবে?


          সময়কালটা ছিল ৬৩৮ এর শেষ অথবা ৬৩৯ খৃষ্টাব্দের শুরুর দিক।  খলিফা ছিলেন হজরত ওমর রা:। আরবে একাধারে বেশ কয়েকমাস প্রচন্ড খরা, বৃষ্টির সময় পেরিয়ে গেলেও আকাশে মেঘের কোনো লেশ মাত্র ছিল না। মরুভুমির জীবন এমনিতেই কঠিন ও রুক্ষ। ব্যবসা ও পশুচারণই তাদের আয় উপার্জনের একমাত্র পথ। খরার কারণে মরুময় মাঠে উট, ভেড়া আর দুম্বার খাবারোপোযোগী যে বিশেষ ধরনের কাঁটাওয়ালা গাছ, বিশেষ ধরনের ঘাস উৎপন্ন হতো এ বৎসরে সেগুলোও হয়নি।

     মানুষের খাদ্যগুলো আরবরা সব সময় সমতল আরবভূমি, শাম বা সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন এবং মিশর হতে তেজারতির মাধ্যমে আনতো, নিজেদের প্রয়োজন মেটাতো। এ বসর খরার কারণে মদিনার নিকটবর্তী অঞ্চল ও আশপাশ এলাকাতেও তার প্রভাবে ফসল আশানূরুপ হয়নি।

    দূর্ভিক্ষ প্রায় অবধারিতভাবেই উপস্থিত। মানুষজন আতংকিত হয়ে পড়লো। খাদ্যাভাবে মক্কা, মদিনার উপকন্ঠে মুসলমান এবং দূর দূরান্তের বেদূঈনরাও মদিনায় এসে হাজির। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মদিনার জনসংখ্যা বেড়ে গেল অবিশ্বাস্যভাবে!

     হজরত ওমর রা: ত্বরিৎ প্রাশাসনিক উদ্যোগ নিয়ে সিরিয়া, মিশর ও ইয়েমেন থেকে খাদ্য সামগ্রী আনার ব্যবস্থা করলেন। তিনি সে সব অঞ্চলের শাসকদের কাছে নির্দেশসহ দূত পাঠালেন তারা যেন যত দ্রুত সম্ভব চাহিদামত শষ্য সামগ্রীর চালান মদিনায় প্রেরণ করেন।

      তিনি আরও একটা কাজ করেছেন। সেটাই আমার আলোচনার বিষয়। সে কাজটির ভেতরে আমাদের জন্য, পুরো মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য এক বিরাট শিক্ষা রয়েছে।

    হজরত ওমর রা: খেলাফতের প্রতিটি আঞ্চলিক শাসকদের নিকট ফরমানে পরবর্তি নির্দেশ জারি না করা পর্যন্ত চুরির শাস্তি হিসেবে কুরআনে বর্ণিত ও নির্দেশিত চোরের হাত কাটা স্থগিত করলেন।

এ নির্দেশ ও সময়কালটা এবং তার তাৎপর্য অনুধাবন করাটা প্রতিটি মুসলমানের জন্যই জরুরি। প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: ইন্তেকালের সাথে সাথে আল্লাহর নিকট থেকে অহী আসা বন্ধ হয়েছে চিরস্থায়ীভাবে। আর আল কুরআনও ততদিনে পরিপূর্ণভাবেই নাজিল হয়ে গেছে। এই আল কুরআনে কোনো কিছুই সংযোজন বা বিয়োজন করার কোনো রাস্তা আর খোলা নেই।

ঠিক এরকমাবস্থায় হজরত ওমর রা: চোরের হাত কাটার শাস্তি হিসেবে সুরা মায়েদার ৩৮ ও ৩৯ নম্বরে নির্দেশিত আল্লাহর হুকুমটাকে সাময়িকভাবে স্থগিত করার ঘোষণা জারি করলেন, তাও আবার সরকারিভাবে, লিখিত নির্দেশ আকারে!

তখনও হজরত ওসমান রা:, হজরত আলি রা: হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা: এবং উম্মাহাতুল মু'মিনিনসহ লক্ষাধিক সাহাবী, হাজার হাজার ত্বাবেয়ী বেঁচে আছেন।

অবাক করার ব্যপার হলো এই যে, হযরত ওমর রা: কুরআনে স্বয়ং আল্লাহপাক  নির্দেশিত একটা হদ পরবর্তি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ করতে বললেন, অথচ এই সব সম্মানিত সাহাবাগণ রা: এর একজনও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন নি।

এর কারণ কি? এর কারণ হলো তাঁরা প্রত্যেকেই কুরআনের যথাযথ শিক্ষাটাকে পুরোপুরিভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য। যদি কোনো রাষ্ট্র কোনো কারণে সে প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়, এবং মৌলিক প্রয়োজন না মেটার কারণে যদি কোনো নাগরিক জীবন বাঁচাতে অন্যায় করেও ফেলে, তবে রাষ্ট্র তার উপর মৃত্যুদন্ড বা হাত কাটার মত কঠোর শাস্তিগুলো কার্যকর করতে পারে না। পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট এবং অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় রাষ্ট্র ভিন্ন কোনো শাস্তির বিধান করতে পারে কিংবা অপরাধীকে কোনো শাস্তি নাও দিতে পারে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে এতটাই লিবারেল!

বিশ্বকে মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম মানুষকে শাস্তির মুখোমুখি করতে আসে নি, বরং ইসলাম এসেছে মানুষকে যেন শাস্তির মুখোমুখি হবার মত পরিস্থিতিরই উদ্ভব না হয়, সে পরিবেশ তৈরি করতে।

হযরত ওমর রা: যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে কুরআনের এই হদটাকে (চোরের হাত কাটার শাস্তি) সাময়িকভাবে রহিত করেছিলেন, সেই একই রকম পরিস্থিতি যদি আমাদের মত মুসলিম দেশে সৃষ্টি হয়, আর সরকার যদি সাময়িকভাবে (দুর্ভিক্ষ দূরিভূত হয়ে প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র সক্ষম ও প্রত্যেকের খাদ্য চাহিদা মিটছে, এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ) আল্লাহপাক কর্তৃক নির্দেশিত হদ স্থগিত করে, তবে আমি নিশ্চিত যে, বায়তুল মুকাররম থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি অলি-গলি সরকারকে কাফের, মুরতাদ ফাতওয়া দিয়ে সংশ্লিষ্ঠদের ফাঁসির দাবীতে মূখরিত থাকবে। জ্বালাও পোড়াও আর ভাংচূরতো আছেই!

এমন কী, স্বয়ং হযরত ওমর রা: নিজেও যদি উঠে এসে আমাদের রাষ্ট্রের হাল ধরতেন এবং এরকম নির্দেশ জারি করতেন, তবে আমার ধারণা, কুরআনের যে জ্ঞান আমাদের রয়েছে, তার উপরে ভিত্তি করে আমরা হয়ত তাঁকেও ওরকম মুনাফিক ফতওয়া দিতে কুন্ঠিত হতাম না!

আমরা একটাবারও ভাবতাম না যে, এই ওমর ইবনে খাত্তাব  ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে করণীয় হিসেবে তাঁর নিজের মত প্রকাশ করেছেন আল্লাহর রাসুল সা: এর সামনে, আর আল্লাহ আকাশ হতে জিবরাইল আ: মারফত অহী পাঠিয়ে সেই মতকেই কুরআনে এন্ডোর্স করে দিয়েছেন। ( বদরের যুদ্ধবন্দীদের ব্যপারে ফয়সালা, পর্দার স্বিদ্ধান্ত, মুনাফিকের শাস্তি ইত্যাদি)

অর্থাৎ হযরত ওমর রা: এর ব্যক্তিগত মতামতকেই মহান আল্লাহপাক কুরআনে আয়াত হিসেবে নাজিল করে দিয়েছেন। সারা বিশ্ব আজও এবং কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর সেই সিদ্ধান্তসমূহকে কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে জানছে, জানবে ।

এ  দ্বারা প্রমাণ হয় যে, আমরা কুরআন তেলওয়াত করি বটে, তবে কুরআন যে শিক্ষা ও দর্শন তার পাঠকের মনে জাগাতে চায়, তা হতে আমরা যোজন যোজন দূরে। 

সময়টা বড়ই মোক্ষম, করোনা মহামারীর কারণে ঘরে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে, তার উপরে চলছে কুরআনেরই মাস; রামাদ্বান।  কুরআন খতমের চেয়ে কুরআন বুঝে পড়া ও অনুধাবনে গুরুত্ব দেয়াটা খুবই জরুরি আমাদের জন্য। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এখনও যদি আমাদের সময় না হয়, তবে আর কবে হবে?
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments