Recent Tube

এরদোয়ান, ঘানুসি গংকে বুঝতে হলে এটা আগে বুঝুন- - জিয়াউল হক।

এরদোয়ান, ঘানুসি গংকে বুঝতে হলে এটা আগে বুঝুন-
     
     বৃস্পতিবার, ৬২২ খৃষ্টাব্দের ২০ জুন দিবাগত রাতের প্রথমভাগ পেরুতেই প্রিয় রাসুল সা. আবু বকর রা. কে নিয়ে নিরুপায় হয়ে বেরুলেন হিজরতের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ তেরটা বছর সঙ্গী-সাথী পরিবার পরিজন’সহ দূর্বিষসহ বৈরি পরিবেশে কাটিয়েছেন নিজ জন্মভূমি, বাপ দাদার ভিটায়। কারণ একটাই। তাঁর জীবনদর্শনের সাথে নিকটাত্মীয় ও সমাজবাসীর বিশ্বাস, জীবানাচার ও আদর্শের অমিল। বিপরিতমূখী দুটো আদর্শের সহাবস্থান সম্ভব হয়নি।

আদর্শিক ভিন্নতা সত্তেও সামাজিক সহাবস্থানে প্রিয় রাসুল সা. এর কোনরকম আপত্তি ছিল না, তার প্রমাণ আল্লাহর একত্ববাদে ঈমান পোষণ না করা সত্তেও চাচা আবু তালিবের সাথে তার সুসম্পর্ক ও অভিভাবকত্ব বজায় থাকার ঘটনা। একইরকম উদাহারণ রয়েছে তাঁর বেশকিছু অনুসারীদের ক্ষেত্রেও।

সমস্যাটা ছিল বিপরিত পক্ষের, তথা, আল্লাহর একত্ববাদে অবিশ্বাসী মুশরিকদের। তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও বিশ্বাস করতো না তাঁর একক কর্তৃত্বে। বিশ্বাসের এই বৈপরিত্য আপাতদৃষ্টিতে খুব সামান্য বিষয় মনে হলেও তা সামান্য কোন ঘটনা নয়। এই পার্থক্যটাই মানবজীবনের গতিপথ ও বিশ্বের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণে সবচেয়ে বড়ো অনুঘটক। 

এক পক্ষ যেমন আল্লাহর প্রতি নিরংকুশ বিশ্বাসের এই অবস্থানকে কোনমতেই সহ্য করতে চায়নি তেমনি অপরপক্ষ যতো দূর্বল, অসহায় আর ক্ষুদ্র হোক না কেন, জীবন ও সমাজের সকলকিছু বিসর্জন দিতে হলেও দিয়েছে কিন্তু বিশ্বাসের এই মৌলিক অবস্থানটাকে কোনমতেই বিসর্জন দেয়নি। 

ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। একে অপরের বিপরিত অবস্থানে ঠাঁই নিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষ অত্যচার, নির্যাতন, লোভ প্রলোভনের সকল চেষ্টায় বিফল হয়ে সহাবস্থানের প্রস্তাবও দিয়েছিল। শর্ত হলো; পালাক্রমে একে অপরের জীবনাচার পালন করবে। কিন্তু তাওহিদের ব্যাপারে নিরাপোষকামীদের পক্ষে এই শর্ত মানা সম্ভব হয়নি সঙ্গতকারণেই। শিক্ষাটা সুস্পষ্ট; আল্লাহর একত্ববাদ নিয়ে একমহুর্তের জন্যও কোন আপোষ চলে না। 

এই একটি ক্ষেত্র ছাড়া মুসলমানরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শৃংখলা, সৌহার্দ ও সম্প্রীতি রক্ষা এবং সহাবস্থানের জন্য আপোষ করেই চলেন। যতোক্ষণ তা তাওহিদের সাথে সাংঘর্ষিক না হচ্ছে ততোক্ষণ এটা ইসলামি আন্দোলনের জন্য উত্তম কর্মকৌশলও বটে। এটাই প্রজ্ঞা। এই প্রজ্ঞার উপরে নির্ভর করে আন্দোলন কর্মসূচীর সফলতা বা ব্যর্থতা। এটা বুঝতে ব্যর্থ হলে সাধারণ মুসলমান জনগোষ্ঠীতো বটেই, এমনকি, আন্দোলনের নেতা কর্মীরাও বিভ্রান্ত হবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। 

প্রিয় রাসুল সা: এর জীবনে এরকম ডজন ডজন উদাহারণ রয়েছে। হুদাইবিয়ার সন্ধীচুক্তি লেখার সময় ‘আল্লাহর রাসুল’ মুহাম্মদের পক্ষ থেকে বাক্যটির মধ্যে ‘আল্লাহর রাসুল’ শব্দটির প্রতি কাফেরদের ঘোরতর আপত্তি উঠলে প্রিয় রাসুল সা. নিজ হাতে তা কেটেও দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সহাবস্থানের স্বার্থে এতোটা ছাড়ও তিনি দিয়েছেন। 

আজকের যুগে আমাদের সমাজে এরকম ঘটনা ঘটলে তথাকথিত আশেকে রাসুলগণ (!) লাঠি সোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্রতিপক্ষের উপরে প্রিয় রাসুল সা. এর সম্মান রক্ষার নামে। দেশ ও সমাজ গোল্লায় যাক, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন উচ্ছনে যাক, একে অপরকে কাফের ফতোয়ায় ভাঁসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কসুর করবে না।

যা হোক, যাত্রার নবম দিনে, ২৮ শে জুন (৬২২ খৃ:) শুক্রবার নিরাপদে তাঁরা এসে পৌছুলেন মদিনার তিন মাইল দূরের গ্রাম; কোবায়। সেখান থেকে ১লা জুলাই সোমবার আসেন ইয়াসরিব, তথা মদিনাতুন নবী’তে। সেই শুরু ইসলামি রাষ্ট্র মদিনার। 

এরপরে ঘটনাবহুল দীর্ঘ দশটি বছর কেটেছে। জীবনের শেষ সমাবেশটি ছিল শুক্রবার, ৯ই মার্চ, ৬৩২ খৃষ্টাব্দে; বিদায় হজ্জের ঘটনা। ঐতিহাসিক সে দিনে তিনি একটি ভাষণ দিয়েছিলেন লক্ষাধিক সাহাবির উদ্দেশ্যে। সেই ভাষণেরই একটা অংশ; ‘জাহেলি যুগের সুদ রহিত করা হলো। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি রহিত করছি তা হলো, আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সুদ। এখন থেকে সব ধরনের সুদ হারাম করা হলো।’ (ইবনে হিশাম)।

মানবিতিহাসে সুদ কোনদিনই বৈধ ছিল না। প্রত্যেক নবী রাসুলই এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে দীর্ঘ দশটি বছর প্রিয় রাসুল সা: এর আপন চাচা প্রখ্যাত সাহাবি, মক্কার অন্যতম বড় ব্যংকার আব্বাস রা: লগ্নীকৃত অর্থের সুদ বন্ধ করতে মক্কা বিজয় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো আল্লাহর রাসুল সা. কে! 

জাহেলি যুগে মক্কা’সহ আরবের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহজ আয়ের পথ ছিল এটা। অনেকেই এতে জড়িত ছিলেন। আব্বাস রা: একা নন। বদর যুদ্ধের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। মুহাজিরদের মধ্যে সবার পরে হিজরত করেন। প্রিয় রাসুল সা: এর চেয়ে মাত্র বছর দু’য়েকের বড় চাচার সাথে অত্যন্ত আন্তরিক বন্ধু’র মতো ছিল তাঁর।

তিনি প্রিয় চাচাকে ইসলাম গ্রহণের পরপরই সুদ বর্জনের ঘোষণা দেবার কথা বলতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি। বরং মক্কা’সহ প্রায় পুরো হেজাজে যখন তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক তখন, তাও আবার প্রকাশ্যে, লক্ষ লোকের সামনে তিনি সা: সূদ রহিত করা’সহ সকল পাওনাদারদের নিকট থেকে চাচা আব্বাস রা: এঁর প্রাপ্য সূদ রহিতের ঘোষণা দিলেন! 

   এই পুরো কর্মযজ্ঞের পরতে পরতে রয়েছে প্রজ্ঞা; হেকমত। আজ মুসলমানদের যে বিরাট অংশটি তিউনিশিয়ার ঘানুসি কিংবা তুরস্কের এরদোয়ান বা ইসলামি আন্দোলনের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের গৃহিত কোন কোন স্বিদ্ধান্তের সমালোচনায় ফেটে পড়েন, তাদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা রয়েছে। এরদোয়ান, ঘানুসি গংকে বুঝতে হলে আগে এই কর্মযজ্ঞটাকে বুঝুন- (সংক্ষেপকৃত)
-------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও বিশ্লেষক ।       

Post a Comment

0 Comments