Recent Tube

আহা, দু:খিনী মা আমার! জিয়াউল হক

         আহা, দু:খিনী মা আমার!
           
(পূর্বপ্রকাশিতের পর) এতোক্ষণে তিনি বিষয়টা খুব ভালো করে খেয়াল করলেন। অথবা বলা চলে, ভালোভাবে উপলব্ধিতে ধরা পড়লো! ভাতিজা তাকে ছাড়তে চাইছে না। তিনি যে দূরে কোথাও যাচ্ছেন, একটা লম্বা সময় যে তিনি থাকবেন না, এটা তার এগারো বছর বয়সের ভাতিজা ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

   অথচ পাড়া পড়শিদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি, নিজের বাড়িতেই হেসে খেলে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে দেবার মতো সমবয়স্ক ছেলে, তার নিজেরই সন্তান; তালিব রয়েছে। তালিব ও ভাতিজা মুহাম্মদ সমবয়সী, মাত্র কয়েকটি মাসের ছোট বড়ো তারা। রয়েছে দুধের শিশু আক্বিল, মাত্র কয়েক মাস বয়স তার। কিন্তু ছোট্ট মাসুম এই এতিম বাচ্চাটার সেদিকে নজর নেই, তার নজর হলো চাচা আবু তালিবের দিকে! 

    আমরা আজ দেড় হাজার বছর পরে এসে যারা সেদিনকার সেই শিশুর জীবনী পড়ি, তাঁকে বুঝতে চাই, তাদের সামনে যথাযথ উপলব্ধি ও ভাবার জন্য বিশাল উপাদান রয়েছে যার সঠিক চিত্র ও প্রকৃতি আমাদের মনস্তত্তে থাকা প্রয়োজন। সেটা এ জন্য যে, এ শিশুর মনস্তাত্বিক, তথা, সাইকোলোজিক্যাল দিক, যা এই বয়সে গড়ে উঠছে, সেটাই পরবর্তিতে তাঁর পুরো জীবন ও কাজকর্মকে একটা বিশেষ ধারায় চালিত করবে।

    মাত্র আটদিন বয়সের এক শিশু গর্ভধারিণী মায়ের কাছ থেকে দূরে ভিন্ন এক পরিবেশে গিয়ে সেখানে বেড়ে উঠতে থাকলো রুক্ষ, উন্মুক্ত ও পাহাড়ি পরিবেশে। বেড়ে উঠার ক্রমধারায় ছেলেটা তার মা হিসেবে পেলো হালিমা নাম্নী ভিন্ন এক নারীকে। বাবা হিসেবে পেলো হারিস ইবনে আব্দুল উজ্জা আবু খাবসা নামক একজন দরদি মানুষকে। বড় বোন হিসেবে পেলো পাঁচ বছরের শায়মা আর ভাই হিসেবে সমবয়স্ক আব্দুল্লাহকে।

    চমৎকার পারিবারিক পরিবেশ! মমতাময়ী মা আছেন, আছেন বাবাও। তিন ভাই বোনের মধ্যে কারো প্রতি অসাদাচারণ বা পার্থক্য নেই। সেবা যতেœর বেলাতেও নেই কোন ভিন্নতা। মা-বাবার পাশাপাশি বড় বোনের আদর ও সমবয়স্ক ভাইটির উচ্ছলতাপূর্ণ সান্নিধ্যে শিশুটা বেড়ে উঠে। তিনজন একইসাথে মাঠে ছাগল চরানোর সাথে সাথে পাহাড়ি প্রান্তরে খেলে বেড়াায়। 

    খেলা, দৌড়াদৌড়ি আর শিশুসূলভ উচ্ছলতায় ব্যস্ত প্রাণচঞ্চল দুই সহোদরের প্রতি তিক্ষè ও সতর্ক দৃষ্টি রাখে বোন শায়মা। মায়ের কড়া নির্দেশ; ভাইদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তারা যেন পাথরের ঘায়ে আঘাত না পায়, যেন পাহাড়ের উঁচুতে উঠতে গিয়ে পড়ে না যায়, নিজেদের মধ্যে মারামারি বাধিয়ে না বসে। 

    সূর্যের উত্তাপ বাড়লে কিংবা সন্ধা হয়ে এলে খেলায় মত্ত ছোট দু’ভাই ও ছাগলগুলোকে নিয়ে যথাযথ সময়ে বাড়িতে ফিরতে হবে, সে নির্দেশ পালনের পাশাপাশি নিজেও ওদের সাথে খেলায় মেতে উঠে। কারণ সেও একজন শিশু, বয়স মাত্র নয় বছর। 

      একদিন তিন ভাই বোনই বাড়ির অদূরে ছাগল চরাচ্ছিলো অন্যান্য দিনের মতো। ছাগলগুলো চরছিল, এক কোণায় বসে সেদিকে নজর রাখছিল শায়মা, সাথে ছোট দুই ভাইয়ের দিকেও। এসময় শিশু মুহাম্মদ বোন শায়মার পেছন থেকে তার ঘাড় জড়িয়ে ধরে। ভাই বোনের চমৎকার খুনসুঁটি! এক পর্যায়ে বোন শায়মার ডান কাঁধে কামড়ও বসিয়ে দেয়! দুধের বাচ্চার মুখে সদ্য গজানো দাঁতের কামড়ে শায়মার কাঁধে কেটেও যায় কিছুুটা। দাগটা সারা জীবন তার কাঁধে বিদ্যমান ছিল। 

     ঘটনার চুয়ান্নো বছর পরে হুনাইনের যুদ্ধশেষে যুদ্ধবন্দী হিসেবে মুসলিম শিবিরে আগত শায়মা কাঁধের ঐ দাগ দেখিয়েই সেদিন প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, তিনি প্রিয় মুহাম্মদ সা: এঁর সেই দুধ বোন!  সেদিনও আজকের এই বালক মুহাম্মদ সে কথা স্মরণে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন বোন শায়মাকে চিনতে পেরে।

       আচ্ছা এবারে ভাবনু তো, পাঁচ বছরের ছেলেটা যখন মক্কায় তার মায়ের কাছে ফিরে জানতে পারলো যে, এতোদিন সে যে বাবা মায়ের কাছে ছিল, তারা তার বাবা’মা নন, এতোদিন যে বোনকে বোন, যে ভাইকে ভাই বলে জেনেছে, খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলা, খুঁনসূটি’সহ একসাথে বেড়ে উঠেছে, তারা তার আসল ভাই বোন নয়!

   এবারে এসে ছেলেটা একটা শহুরে পরিবেশে পড়লো। এখানে ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন মানুষ জন, ভিন্ন জীবনাচার। মাকে চিনলো। চাচা আবু তালিব, আবু লাহাব, আব্বাস, হামজা, ফুফু সাফিয়্যাহ, দাদা আব্দুল মুত্তালিবকেও চিনলো, জানলো। একই বয়সের চাচাতো ভাই; খেলার সাথী তালিবকে পেলো। তখনও আক্বিলের জন্ম হয়নি, বোন উম্মে হানিও পৃথিবীর মুখ দেখেনি। 

   দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু চাচাতো ভাই বোন সব আছে। তবে বাবা নেই! তিনি নাকি ইন্তেকাল করেছেন। আহা, মমতাময়ী মা আমিনা! ছেলে ফিরে আসার এই দিনটা কতো আনন্দময়ই না হতে পারতো স্বামী বেঁচে থাকলে। ছেলেকে বুকে পেয়ে কতোই না স্মৃতিকাতর হয়েছিলেন আপনি! সন্তান ফিরে পাবার এক অপার আনন্দের পাশাপাশি কি দূর্বিষহ কষ্টকরই না ছিল সে কটা দিন!

    একমাত্র আত্মজকে কাছে পেয়ে রুঢ় সত্যটাকে বলতে হয়েছে নিজের মুখেই। একজন মায়ের জন্য কি নিদারুণ কষ্টের, একজন নারীর পক্ষে কি নিমর্ম মনোপীড়নের কারণ! কোলের ভেতরে শুইয়ে কতো রাত বাবার গল্প করেছেন তিনি, নানার বাড়ির গল্প, বাবা কেমন ছিলেন? কি করতেন? কতো শত গল্প!

      একজন বিধবা নারীর পক্ষে পেটের সন্তানকে জীবনে প্রথমবারের মতো ‘বাবা বেঁচে নেই’ খবরটা জানিয়ে মৃত বাবার হাজারো স্মৃতি তুলে ধরে পরম মমতায় তার মানসপটে অদেখা বাবার চিত্র আঁকার সেই কঠিন কাজটাই আপনাকে করতে হয়েছে! 

   আহা, দু:খিনী মা আমিনা! দেড় হাজার বছর পরে আপনার এক সন্তান এই লেখা লিখতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে উঠে, তার হাত নড়ে না কিবোর্ডে। নিথর, অবশ হয়ে আসে যেন!! মা আমার, আল্লাহ যেন আপনার উপরে রহম করেন। (প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘দ্যা চয়েস ইজ ইউরস’ থেকে সংক্ষেপকৃত)
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা, গীতিকার ও  বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments