Recent Tube

আহা, ব্যাথাতুর সেই ঠোঁটজোড়া! (-২), জিয়াউল হক।

  আহা,ব্যাথাতুর সেই ঠোঁটজোড়া!।
                  
     আবু তালিব প্রথমে খেয়াল করেন নি। তিনি ব্যস্ত হয়ে সারা বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজে ফিরছেন তাঁর উটের হাওদা, হাওদা বাঁধার রশিগুলো। মালামাল নেবার টুকরি, পানির মশক, একটা একটা করে খুঁজে পাচ্ছেন আর সেগুলো ঝেড়ে মুছে এক জায়গায় জড়ো করতেই ব্যস্ত। 

   বহুদিন হাওদাটা ব্যবহার করা হয়নি। ঠিক সে কারণেই হাওদা বাঁধার কাজে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ছোটখাটো এবং টুকিটাকি জিনিসগুলোরও কোন খোঁজ নেই। দীর্ঘদিন সে সবের কোন ব্যবহার না হওয়ায় পড়ে আছে বাড়ির এখানে সেখানে অযত্নে অবহেলায়। সেগুলোই খুঁজে খুঁজে বের করতে হচ্ছে। 

      বাস্তবিকই অনেকদিন হলো এগুলোর ব্যবহার হয়নি, প্রয়োজনও পড়েনি। আগে যখন শাম কিংবা ইয়েমেনে বাণিজ্য সফরে যেতেন তখন নিয়মিত ব্যবহার হতো। ব্যবহার হতো বলে সে সব জিনিসগুলোর যত্ন হতো, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণও হতো। কিন্তু এখন তাঁর আগের সেই অর্থনৈতিক অবস্থা নেই, সেই পুঁজিও নেই। অর্থনৈতিক অবস্থা তার ক্রমাগতভাবে গেল কয়েকটা বছর খারাপ থেকে খারাপ হয়েই চলেছে। আয় রোজগার কমেছে। সংসার চালাতে এখন তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। 

     এভাবে তো আর চলতে পারে না। দিনে দিনে সংসার বাড়ছে। স্ত্রী ছাড়াও ইতোমধ্যেই ঘরে তার তিন তিনটি সন্তান এসেছে, তার উপরে এতিম ভাতুষ্পুত্র। বছর তিনেক আগে বাবা আব্দুল মুত্তালিবের শেষ সময় ঘনিয়ে আসলে মৃত্যুর আগে তিনি তার আদরের এই এতিম নাতির অভিভাবকত্ব ও লালন পালনের সকল দায়িত্ব তার উপরেই অর্পণ করে যান। সেই থেকে ছেলেটা তার কাছেই আছে, তারই পরিবারের একজন সদস্য হয়ে।

     এভাবে সংসারে মোট পাঁচজনের মুখের খাবার জোগাড় করা মক্কার এই পরিবেশে চাট্টিখানি কথা নয়! বিশেষ করে, আবু তালিবের মতো মধ্যবয়স্ক একজন লোকের পক্ষে (তিনি তখন তেতাল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করেছেন)। 

     ক্রমেই আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ বেড়ে চলেছে গেল কয়েকটা বছর। এবারে বোধ হয় আর পারলেন না। এর আগেও তিনি শাম, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে গিয়েছেন ব্যবসার কাজে। ভালো লাভও হয়েছে। ব্যবসার পূর্ব অভিজ্ঞতার রয়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে সুনামও রয়েছে। তা ছাড়া, কুরাইশ বংশের একজন নেতা হিসেবে হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব (সিকায়া) পালনকারী হিসেবে পুরো আরব জনপদ জুড়ে তিনি অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্রও বটে। 

       তার উপরে বছর তিনেক আগে বাবা আব্দুল মুত্তালিব মারা যাওয়ায় এখন তিনি কুরাইশ গোত্র প্রধান হিসেবেও আরবে বিশেষ সম্মানের আসনে আসীন। তবে সমস্যা হলো, অর্থ বিত্ত ও সম্পদ না থাকলে মানুষের প্রভাব আর প্রতিপত্তির সেই জোর থাকে না, বা তার পূর্ণ প্রকাশও থাকে না। নিজের স্ত্রী সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য যাকে সারাদিন চিন্তায় বিভোর থাকতে হয়, ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়, তার পক্ষে সমাজের অন্যান্য কাজে অখন্ড ও নিরবিচ্ছিন্ন সময় দেয়া কি সম্ভব?

      ফলে একান্ত নিরুপায় হয়েই তাকে ভিন্ন চিন্তা করতে হয়েছে। অভাবের কারণে ইতোমধ্যেই তিনি হাজীদের পানি পান করানো’সহ অন্যান্য সেবা প্রদানের সম্মানজনক দায়িত্বটা ছোট ভাই আব্বাসের হাতে অর্পণ করেছেন। আব্বাস ছিলেন সেকালে মক্কার অন্যতম একজন সফল ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং ব্যংকার। 

     এভাবে কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ ও ত্বত্তাবাধানের দায়িত্ব থেকে তিনি অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছেন। ফলে এখন অনেকটা নিশ্চিন্তে মালামাল নিয়ে কাফেলার সাথে ব্যবসার জন্য শাম ও ফিলিস্তিনে যেতে পারবেন। 
    ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছেন মক্কা থেকে একটা বাণিজ্য কাফেলা খুব শিঘ্রই শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে, সেই কাফেলার সাথে তিনিও নিজের রসদ ও মালামাল নিয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন। উঁটও প্রস্তুত। এখন সেই উটের পিঠে মালামাল বহনের হাওদা’সহ অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ ও যাত্রার উপযোগী করে প্রস্তুত করার আয়োজনেই তিনি ব্যস্ত।

     আবু তালিব যখন ব্যতিব্যস্ত হয়ে এক মনে বাড়ির এখানে সেখানে বিভিন্ন উপকরণ খুঁজে ফিরছেন। সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করার স্বার্থেই এক কোণা থেকে বাড়ির অন্য কোন এক কোণায় যাচ্ছেন। যেখানেই যাচ্ছেন না কেন, তার সাথে সাথে এতিম ভাতুস্পুত্র মুহাম্মদও ছাঁয়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করছে!

    বাস্তবিকই আবু তালিব আর তাঁর এই ভাতিজা একে অপরের সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতেন সব সময়। তার নিজের সন্তান তালিব ভাতিজা মুহাম্মদের প্রায় সমবয়স্ক; কয়েকমাসের ছোট মাত্র। সেই ছেলে তালিব কিংবা তারও ছোটটা মাত্র বছরখানেক বয়সের আক্বিলকে তিনি নিজের কাছে এতোটা সময় রাখেন না, যতোটা সময় ভাতুস্পুত্র মুহাম্মদকে রাখেন। দু’জনে একত্রে খাওয়া দাওয়া করবেন, যেখানেই যাবেন না কেন, ভাতিজাকে সাথে করেই নিয়ে যাবেন। রাতের বেলাতেও নিজের কাছে, নিজের বিছানার পাশেই শোয়াবেন।

   শান্ত, সুবোধ ও স্বল্পবাক এতিম ভাতিজাকে তিনি এভাবেই সব সময়ই চোখে চোখে রাখেন। বাবা আব্দুল মুত্তালিব যতোদিন বেঁচে ছিলেন তিনিও এই ছেলেটাকে এভাবেই সব সময় নিজের কাছে কাছেই রাখতেন। একটা মহুর্তের জন্যও কাছ ছাড়া তো দূরের কথা, এমনকি, চোখের সামনে থেকে সরতেও দিতেন না। 

  হঠাৎ করেই তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তিনি যেখানে যেখানে যাচ্ছেন, ভাতিজাও সেখানে তার পিছে পিছে যাচ্ছেই না কেবল, বরং সে আবু তালিবের কোর্তার একটা কোণাও নিজের হাতের মধ্যে ধরে রেখেছে। বিষয়টা লক্ষ্য করে তিনি থমকে দাঁড়ালেন, ভাতিজা মুহাম্মদও চাচার দিকে চোখ তুলে তাকালো। 

  অসমবয়স্ক দু’জন মানব সন্তান, দুই আত্মজের চারটা চোখের সম্মিলন হলো একটা মহুর্তের জন্য। আবু তালিব দেখলেন ভাতিজার মলিন মুখ, তার চোখজোড়া টলটল করছে অশ্রুতে, যে কোন সময় যেন উপচে পড়বে! ঠোঁটদুটোও থর থর করে কাঁপছে! এ দৃশ্য দেখে আবু তালিবের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, তার নিজের চোখজোড়াও জ্বালা করে উঠলো! (ক্রমশ)
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments