Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ২৯-৩১ ;৷ জিয়াউল হক।

      দ্যা চয়েস ইজ ইউরস;
                    পর্ব- ২৯-৩১ ;

    আগেরদিন ২৬ শে এপ্রিল রবিবার কাবার অনতিদূরেই আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে এক বিরাট খাওয়া দাওয়ার আয়োজন ছিল। বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব নেতৃস্থানীয়দের ডেকে খাইয়ে দিয়েছেন। সেদিন তার নবজাতক নাতী মুহাম্মদের বয়স সাতদিন।এদিকে ঐ সময়ই ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর তায়েফ থেকে একদল নারী এসেছেন মক্কা শহরে জন্ম নেওয়া নবজাতকদের পোষ্য হিসেবে নিতে। প্রতিবছরই আসেন তারা। নবজাতককে বুকের দুধপান ও লালনপালন করানোর বিনিমেয় পারিশ্রমিক পান। এ প্রথার পেছনে সামাজিক ও মনস্তাত্তিক কারণ আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি।

      বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিবের নাতীটার বাবা নেই, এতিম। নানার বাড়িও দুরে; ইয়াসরিব। কুরাইশ গোত্রপ্রধান দাদা আব্দুল মুত্তালিব পুরো আরবের মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবশালী হলেও বিগত কয়েকটি দশক ধরে ক্রমাগতভবে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা পড়তির দিকে।
তায়েফ থেকে  আগত নারীদের মধ্যে ছিলেন বনু সাদ গোত্রের হালিমা সাদিয়া। মক্কা পর্যন্ত আসতে এই নারীকে অত্যন্ত বেগ পেতে হয়েছে, কারণ তাঁর বাহন গাধাটা এতোটাই দূর্বল ও রুগ্ন ছিল যে, তারা তো দল থেকে পিছিয়ে পড়েছিলেনই, কখনও কখনও এমনও মনে হচ্ছিল যে, হয়তো গাধাটা তাঁকে নিয়ে মক্কা পর্যন্ত পৌছুনোর আগে পথেই মারা যাবে।

      মাশা স্বামী হারেস ইবনে আব্দুল উজ্জাও ভয় পাচ্ছিলেন, না জানি, গাধাটা কখন মারা যায় আর বাঁকিপথটা তাদের হেঁেটই পাড়ি দিতে হয় কোলে শিশুসন্তান আব্দুল্লাহ এবং ছয় বৎসরের শিশুকন্যা শায়মা নিয়ে! কপাল ভালোই বলতে হবে, পথে গাধাটা মারা গেল না। সঙ্গী সাথীদের থেকে পেছনে পড়ে গেলেও তারা শেষ পর্যন্ত মক্কায় পৌছুলেন। দেরিতে হলেও এসেই তারা পুরো মক্কা চষে বেড়িয়েছেন কার বাড়িতে সদ্যপ্রসুত সন্তান আছে, কে তার সন্তানের জন্য ধাত্রী খুঁজছেন? তা জানতে।

     বিবি হালিমার সাথে আগত প্রত্যেকেই খুঁজে খুঁজে ধনী পরিবারের বাচ্চাদেও নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রাও শুরু করেছেন। এখন আর অবস্থাসম্পন্ন ধনী পরিবারের বাচ্চা নেই যাকে তিনি পালক হিসেবে নেবেন। একমাত্র আব্দুল মোত্তালেবের সেই এতিম নাতি ছাড়া।
বিবি হালিমার মন খারাপ। ভাবলেন ফিরে যাবেন। আবার ভাবলেন; খালি হাতে ফিরে গেলে সঙ্গী-সাথী, পাড়া প্রতিবেশিরা কি বলবে? এটা ঠিক যে, হালিমা কিছুটা রুগ্ন, তাই বলে কি মা হিসেবে তিনি এতোটাই অদক্ষ যে, পুরো মক্কার একজন মা’ও তাকে নিজের সন্তান দেবার মত ভরসা পান নি!

      অনেকটা অনিচ্ছাসত্তেও হালিমা স্বামী হারেস’সহ সেই এতিম বাচ্চাটাকেই দেখতে গেলেন। মা আমিনার কোলে শুয়ে থাকা মাত্র সাতদিনের ঘুমন্ত বাচ্চাটা কোলে নিলেন। নামটাও নতুন; মুহাম্মদ। কি অবাক কান্ড! কালে নিতেই বাচ্চাটার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বাচ্চটার ঠোঁটজুড়ে মিষ্টি হাসি! আহা, কি নিস্পাপ মায়াবী মুখ! বাচ্চার সাথে একবারমাত্র দৃষ্টিবিনিময় হতেই হালিমার পুরো অন্তরটা মায়ায় তোলপাড় হতে লাগলো!
পাশেই দা্ড়াঁনো স্বামী হারেসের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন; ওয়াআল্লাহি, তেমন কোন পারিশ্রমিক পাবো না জেনেও বাচ্চাটাকে নিতে আমার অন্তর ছটফট করছে! হারেসও বাচ্চাটার মায়াবি চোহারায় বিমোহিত। বলে উঠলেন; মনে হয় বাচ্চাটাকে নিলে তুমি ভূল করবে না।’ পাশ থেকে ছয় বৎসরের মেয়ে শায়মাও খুশিতে বার বার বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে।

    পারিশ্রমিক নিয়ে কোনো দেন দরবারই করতে হলো না। কিছুই বলতেও হলো না মুখে। পরম মমতায় বিবি হালিমা শিশুটির মুখে নিজের ডান স্তন তুলে দিলেন। বাচ্চাটাও পরম পরিতৃপ্তিতে দুধ পান করতে লাগলো। তা দেখে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বাচ্চার মা আমিনা বুঝলেন; এর আগে অনেকে এতিম বাচ্চাটাকে না নিলেও বিবি হালিমা তার বাচ্চাকে নিচ্ছেন।
তারা সেরাত মক্কাতেই থাকলেন। পরদিন ভোরে হালিমা যখন ঘুম থেকে উঠলেন, কিছুটা অবাক হলেন। বহুদিন ঠিকমত ঘুমুতে পারেন নি। কারণ অবশ্য তাঁর নিজের অসুস্থ ও দূর্বল শরীর। তা ছাড়া, তাদের দূর্বল উঠটাও বেশি দুধ দিতে না পারায় স্বামী ও সন্তানদের খাওয়ানোর পর নিজের জন্য যথেষ্ট পরিমান দুধ অবশিষ্ঠ থাকতো না, ফলে পেটে সবসময়ই কিছুটা ক্ষুধা রয়েই যেতো। এটাই তাকে ক্রমাগতভাবে দূর্বল করে দিয়েছে যেমনি, তেমনি, রাতের পর রাত তিনি ঐ ক্ষুধার কারণেই ঠিকমত ঘুমাতে পারেন নি।

      তবে গেল রাতে তিনি বেঘোরে ঘুমিয়েছেন। অনেক দিন পর কালকেও তাদের উঠনিটাও দুধ দিয়েছিল যথেষ্ঠ পরিমানে। স্বামী হারেস, মেয়ে শায়মা তারা তো পেট পুরে খেয়েছেই, এমনকি, তিনি নিজেও বহুদিন পরে পেট পুরে খেয়েছেন। সম্ভবত সে কারণেই রাতে ভালো ঘুম হয়েছে।
স্বামী হারেসকে সে কথা বলতেই তিনি কিন্তু ভিন্নকথা বলে উঠলেন, গতকাল পালক নেয়া শিশুটিকে দেখিয়ে বলেলেন; আমার কি মনে হয় জানো হালিমা; আল্লাহ হয়তো এই ছেলেটির কারণে আমাদের বরকত দেবেন।’
স্বামীর কথাগুলো শুনলেন বটে তবে কিছুই বললেন না। তিনি পরিতৃপ্ত, তা ছাড়া তাঁর শরীরটাও আজ বেশ ভালো লাগছে। সুস্থ বোধ করছেন, মনেও প্রফুল্লতা।  এবারে ফেরার পালা। বিবি হালিমা মা আমিনার নয়নের ধনকে নিয়ে নিজের মহল্লার পথ ধরলেন। সেই অসুস্থ ও রুগ্ন গাধাটার পিঠে চড়েই। দিনটা ছিল ২৭ শে এপ্রিল, সোমবার, ৫৭১ খৃষ্টাব্দ। শিশু মুহাম্মদের জীবনের প্রথম যাত্রা, ‘দি গার্ডেন অব হেজাজ’ খ্যাত তায়েফ অভিমূখে।
অদ্ভূত ব্যাপার! দু’দিন বিশ্রামের কারণেই কি তাঁদের অসুস্থ গাধাটাও হৃতশক্তি ফিরে পেয়েছে? তা না হলে সে এতো দ্রুত কিভাবে ছুটছে? মনেই হয় না যে, এই গাধাকে নিয়েই তারা আসার সময় এতোটা ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। আগের দিন যারা মক্কা থেকে বাড়ির পথ ধরেছে, একদিন পর রওয়ানা হয়েও সেই তাদেরকেই পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে চললেন।
কি মনে হয়? নবুওয়তের বরকত? না, কেবল তা নয়। এতিমের প্রতি সদয় যেই হবে, তার বা তাদের জন্যই এই বরকত। এতিমের প্রতি দয়াদ্র হবেন? দ্যা চয়েস ইজ ইউরস। (ক্রমশ. সংক্ষেপকৃত)
--------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।           

Post a Comment

0 Comments