Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস্ - ২৫, জিয়াউল হক।

      দ্যা চয়েস ইজ ইউরস্্
                                পর্ব - ২৫
   
     ইয়াসরিবে খুবই স্বজ্জন বলে পরিচিত ওয়াহাব যুহরি’র বাড়িতে ভীড় জমেছে। রাত থেকেই শুরু হওয়া প্রসব বেদনায় স্ত্রী সারাটা দিন বেদনায় ছটফট করেছেন। নিকটাত্মীয়া’সহ কয়েকজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ ধাত্রীও হাজির। প্রসুতির প্রসব প্রক্রিয়াটা সহজ, সাবলীল ও ঝামেলামুক্ত করতে। 
ওয়াহাব স্ত্রীকে প্রাণপণ ভালোবাসেন। তাঁরা সূখী দম্পতি। বিশাল অর্থ বিত্ত না থাকলেও মোটামুটি স্বচ্ছলতার মধ্যেই তাদের দিনগুলো কেটে যায়। 

  তবে একটা অপূর্ণতা আছে। তাদের কোনো সন্তান নেই। একটা সন্তানের জন্য তারা মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন। এটা এমন একটা সময় ও সমাজের কথা বলছি, যে সমাজে কন্যা শিশু জন্ম নেওয়াটা বাবা-মা ও পরিবারের জন্য অলুক্ষুণে ভাবা হতো। কদাচিৎ ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জন্মমহুর্তেই সদ্যভূমিষ্ঠ কন্যা শিশুটিকে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা বা কোন পাহাড়ের গা ঘেঁষে ফেলে আসা হতো। 

আবার অনেক সময় জন্মের পরে রাখা হলেও পরবর্তিতে বাবা স্বিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলতো। ততদিনে মেয়েটা হয়তো কিছুটা বড় হয়েছে। সময় ও সুযোগ বুঝে সে মেয়েকে মরুভূমির কোন গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হতো। এর জন্য তাকে কোন জবাবদিহী করতে হতো না। মেয়ের ব্যাপারে যে কোন স্বিদ্ধান্ত নেবার নিরংকুশ ক্ষমতা, অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল তার।

এরকম আবহ্যেই ওয়াহাব যুহরী দম্পতি একটা সন্তানের জন্য পেরেশান। সংসারে একটা সন্তান এলে তাদের জীবনটাকে আক্ষরিক অর্থেই পরিপূর্ণ করে তুলতো। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর এক সময় ওয়াহাবের স্ত্রী বাররা সন্তানসম্ভবা হলে ন। সারা বাড়ি’সহ তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে দিন গোনেন সেই শুভক্ষণে, কবে একটা সন্তাানের গর্বিত বাবা হবেন! আজ সেই ক্ষণ! স্ত্রী’র প্রসব বেদনায় স্ত্রী’সহ তিনিও সারারাত ঘুমাননি। অবশেষে অনেক কষ্ট সহ্যের পরে স্ত্রী সন্তান প্রসব করলে ধাত্রী তাকে এনে বাইরে উৎকন্ঠিত ওয়াহাব যুহরির কোলে দিলো। 

ধাত্রী’র মুখটা মলিন, উপস্থিত অন্যান্য আত্মীয়াদেরও। কারণ, সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুটি কন্যা শিশু! সবার মনে অজানা আতংক, না জানি সন্তানের জন্য দীর্ঘদিন অধির প্রতিক্ষায় থাকা পিতা ওয়াহাব যুহরির কি প্রতিক্রিয়া দেখান কন্যাটির প্রতি! তিনি কি শিশুটিকে গ্রহণ করবেন? না, হত্যার মাধ্যমে তাকে বর্জন করবেন?

ঘটনার আকষ্মিকতায় অনেকটা নির্বাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় ওয়াহাব যুহরি নিজেও। তিনি নির্বাক। যে সমাজে বাস করছেন, বড় হয়েছেন, সে সমাজের রসমকে একা কিভাবে ভেংগে চূরমার করবেন? মনের ভেতরে ঝড় বইছে। নিশ্চুপ ধাত্রীর কোল থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যাকে কোলে তুলে নিলেন।

জীবনে প্রথমবার নিজ আত্মজের দিকে, জন্মদাতা পিতা নিজ সন্তানের দিকে চোখ মেলে দেখলো! সারাটা শরীরজুড়ে এক অজানা, অচেনা শিহরণ খেলে গেল যেন! আহা, কি নিস্পাপ স্বর্গীয় চেহারা, কি মায়াবী মিষ্টি মুখ! কন্যার দিকে পলকহীন চেয়েই রইলেন তিনি। অনতিদূরেই দাঁড়িয়ে ধাত্রীসহ জনাকয়েক নিকটাত্মীয়া প্রতিবেশি নারী, উৎসুক দৃষ্টিতে বাবা সদ্যজাত কন্যাটির সাথে কেমন আচরণ করেন? কি স্বিদ্ধান্ত নেন কন্যার জীবন সন্মন্ধ্যে তা জানাতে।  

ওদিকে ঘরের ভেতরে সদ্য কন্যার মা’ও নিজের প্রসব বেদনা ভূলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে স্বামীর স্বিদ্ধান্তটা জানার জন্য! এটা এমন একটা যুগের কথা, যখন স্বামীর স্বিদ্ধান্তই শেষ ও চুড়ান্ত। গর্ভধারিণী মা সন্তানকে দশ মাস পেটে টানলেও, তারই গর্ভে সন্তান বেড়ে উঠলেও তাকে গ্রহণ করা বা না করা, বাঁচিয়ে রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত নেবার একক ও একচ্ছত্র ক্ষমতা কেবল সদ্যজাত সেই সন্তানের বাবার। আর কারও নয়। এমনকি, মায়েরও না। সেই মা’ই ভেতরে কান পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন স্বামীর স্বিদ্ধান্তটি জানার জন্য। 

সবাই অধির আগহে, একরাশ উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে। কয়েকটি মহুর্ত কেটে গেলো এরকম নীরব কিন্তু অধীর প্রতিক্ষা আর টান টান উত্তেজনার মাঝেই। এদিকে ওয়াহাব যুহরি অপলক দৃষ্টিতে কন্যাটির দিকে চেয়ে যেন নিজের জগতেই মজে আছেন।  তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না কি স্বিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন কন্যার ভাগ্য নিয়ে।  

এই একটা সন্তানের জন্য স্ত্রী’সহ তিনি কি ব্যগ্রতার সাথেই না অপেক্ষা করেছেন! স্বামী-স্ত্রী মিলে মানত করেছেন; আল্লাহ যদি একটা সন্তান তাদের দেন তা হলে তারা ক্বাবা তাওয়াফ করবেন আর সেখানে অবস্থানরত দেব-দেবিদের উদ্দেশ্যে নজরানাও দেবেন। এই সেই সন্তান, যার জন্য তাদের দু’জনের জীবন নিরস, নিরানন্দময় হয়ে উঠেছিল। আহা, তাদের বহুকাংক্ষিত সেই সন্তানই কি মায়াবী নিস্পাপ চোখজোড়া নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে!
 
এক অব্যক্ত মায়া আর স্নেহে ওয়াহাব যুহরির সারাটা অন্তর উথলে উঠলো। না, তিনি এ সন্তানকে হত্যা করতে পারেন না। তার চোখ বেয়ে দরদর করে তপ্ত অশ্রু নেমে দু’গাল ভিজিয়ে দিল। আত্মজের ললাটে একটা স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলেন গভীর মমতায়। এরপরে পিাশে দন্ডায়মান ধাত্রীর দিকে বাচ্চাকে স্বস্নেহে এগিয়ে দিলেন। 

জাহেলি আরব সমাজে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী সদ্যভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুটির বাবার এ আচরণ, তার দু’চোখে প্রবাহমান অশ্রুর ধারায় ধাত্রী বুঝলেন এর অর্থ কি? তেমনি বুঝলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই। আনন্দে সকলেই উলুধ্বনী দিয়ে উঠলেন। 

কিছুই বলতে হলো না কাউকে, কিন্তু সকলেই বুঝলেন; কন্যার বাবা সদ্য ভুমিষ্ঠ কন্যা সন্তানটিকে ত্যাজ্য করেন নি, মাটি চাপায় বা গলা টিপে হত্যার স্বিদ্ধান্ত নেননি, কোন পাহাড়ের পাদদেশে ফেলে আসতে নির্দেশও দেননি। বরং তিনি কন্যাটিকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। 

সমস্বরে উলুধ্বনী শুনে ঘরের ভেতরে এতক্ষণ ধরে আশা নিরাশার দোলচালে দুলতে থাকা প্রসুতি, শিশুটির মায়ের দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো আনন্দের তপ্তধারা। আহা, পৃথিবীটা এতো সুন্দর! (ক্রমশ, সংক্ষিপ্তকৃত)
--------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।             

Post a Comment

0 Comments