দ্যা চয়েস ইজ ইউরস্
পর্ব- ২৬,
ইয়াসরিবের ধুলিময় পথে এক সকালে নয় দশ বৎসরের উচ্ছল ও প্রাণবন্ত মেয়ে একলা হেঁটে চলেছে। অনতিদূরে এক এক বান্ধবীর বাড়ি। হঠাৎ লক্ষ্য করলো মাটির উপরে কিছু একটা পড়ে আছে, চক চক করছে। বসে চোখদুটোকে আরও কাছে নিয়ে দেখলো; আরে! এ যে একটা স্বর্ণমুদ্রা! ব্যবসায়ী বাবার বড় আদুরে মেয়ে স্বর্ণমুদ্রাকে দেখামাত্রই চিনেছে, বেগ পেতে হয়নি। স্বর্ণমুদ্রাটাকে হাতে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলো। এক সময় বান্ধবীর বাড়িতে এসে হাজির।
মেয়েটা এখানে প্রায়ই আসে। একত্রে খেলা ও গল্পে কিছুটা সময় কাটিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। বান্ধবীও ঠিক একইভাবে তার বাড়িতে যায়, সেখানে তারা দুজনে একইভাবে গল্প ও খেলাচ্ছলে সময় কাটায়। পাড়ার সবাই তাদের খুব ভালো মেয়ে হিসেবে যেমন জানে, ঠিক এটাও তারা জানে যে, দু জনে পরষ্পর পরষ্পরের খুবই ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও বটে।
মেয়েটা’র আজ খেলায় মন বসছে না। ছোট্ট মনের ভেতরটায় এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বার বার মনে ভেঁসে উঠছে একটা প্রশ্ন, আচ্ছা, পথে পড়ে পাওয়া এই স্বর্ণমুদ্রাটা কার? সেকালে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রাই ছিল কেনা বেচা বা লেন দেনের মাধ্যম। প্রচন্ড অভাবী এ জনপদে একজন মানুষ একটা রৌপ্যমুদ্রার জন্যই সারাদিন, এমনকি, কখনও কখনও পুরো সপ্তাহ অমানুষিক খাটুনি খাটে। সেখানে একটা স্বর্ণমুদ্রা হাতে পাওয়া যেমন তেমন, চোখে দেখাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
কারো কাছে একটা স্বর্ণমুদ্রা থাকা মানে সে মোটামুটি স্বচ্ছল। ঐ সমাজে খুব কমসংখক লোকই স্বর্ণমুদ্রা মালিক হতো। কারো কাছে স্বর্ণমুদ্রা থাকা মানেই হলো তার কাছে উদ্ধৃত অর্থ মওজুদ থাকা। এতসব সামাজিক ও র্অথনৈতিক বাস্তবতা ছোট্ট ঐ মেয়ের জানার কথা নয়। তবে সে তার ব্যবসায়ী বাবার সুত্রে এতটুকু অন্তত জানে যে, এটা খুব দামী, মহার্ঘ ও মূল্যবান একটা সম্পদ।
এটাই পথে অবহেলায় পড়ে ছিল! মানে এটা কারো কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। না জানি, স্বর্ণমুদ্রাটা কার? আহারে, বেচারা হয়তো খুজে খুজে হয়রান হয়ে গেছে। মনের কোণে জেগে উঠা এই বেদনাবোধেই সে খেলা বা গল্পে মন বসাতে পারছে না। শেষে বান্ধবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। যে পথ দিয়ে এসেছিল, ঠিক সে পথেই চলছিল। এবারে তার নজর অন্য দিকে। ছোট্ট মেয়েটার বুদ্ধির প্রখরতটা বুঝা যায় এ ঘটনায়, সে ধীর পায়ে চলতে চলতে আশে পাশে চলমান লোকজনকে খেয়াল করতে লাগলো, কেউ কি কিছু একটা খুঁজে ফিরছে পথে?
আসার সময় যেখানে স্বর্ণমুদ্রাটা পেয়েছিল সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো মেয়েটা। একবার ভাবলো স্বর্ণমুদ্রাটা সেখানেই আবার সে ফেলে রেখে দেবে। পরক্ষণেই ভাবলো, না, অন্য কেউ যদি কুড়িয়ে নিয়ে যায় আর মালিকের সন্ধান না করে নিজেই খরচ করে ফেলে, তা হলে তো এর মালিক আর কোনদিনই তা ফিরে পাবে না। এর চেয়ে বরং সে নিজেই খোঁজ করে দেখবে, মালিক পাওা যায় কিনা, পেলে তাকে ফেরত দেবে, আর না পেলে বাড়িতে মা’কে বলবে পুরো বিষয়টা।
ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিল ধীর পায়ে। হঠাৎ নজরে পড়লো, এক অতিশয় দূর্বল বৃদ্ধ শুকনো খেজুরের ডাল ভর করে, মাটির দিকে দু’চোখ জড়ো করে দেখতে দেখতে রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে আসছেন। দূর্বল বুড়োটা ঠিক মত হাঁটতেও পারছেন না, যেন কাঁপছেন।
মেয়েটা দ্রুত এগিয়ে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো তিনি কি খুঁজছেন? বৃদ্ধ হতাশ কন্ঠে জানালেন; বাছা, আজ দু’টো দিন একটা দানাপানিও পেটে পড়েনি দেখে অনেক দিনের সঞ্চিত একটা স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলাম যব কিনতে, সেটাই হারিয়েছি, আর খূঁজেই পাচ্ছি না। এ পথেই তো যাচ্ছিলাম----। বলেই বৃদ্ধ হাঁপাতে লালেন।
এতক্ষণে মেয়েটা বুঝলো, যে, তার পাওয়া স্বর্ণমুদ্রাটা এই বৃদ্ধেরই। কিন্তু লোকটা যে বললেন, দুটো দিন কিছুই খাননি! আহারে, তিনি ক্ষুধায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন! মেয়েটার খুব মায়া হলো বৃেদ্ধর জন্য। সে বলে উঠলো, আমার সাথে আসুন, আমি আপনার স্বর্ণমুদ্রাটা খুঁজে দেবো। চলুন আমার বাড়িতে, আমার মায়ের কাছে।
বৃদ্ধ দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে বসা চোখজোড়া কুঁচকে মেয়েটাকে খুব ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটা তার হাত ধরে এগোতে শুরু করেছে, বাড়ির দিকে। বাড়িতে এনে বৃদ্ধকে বসিয়ে মেয়েটা তার মাকে আদ্যোপান্ত জানিয়ে তার হাতে স্বর্ণমুদ্রাটাও তুলে দিল। মা তার ছোট্ট মেয়েটার বুদ্ধিমত্তা, সততা দেখে খুবই খুশি হলেন। মেয়েকে বললেন, বৃদ্ধের হাতে স্বর্ণমুদ্রাটা ফেরত দিতে, ততক্ষণে তিনি ঐ বৃদ্ধের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছেন।
মায়ের নির্দেশে এক দৌড়ে এসে সেই বৃদ্ধের হাতে তুলে দিল স্বর্ণমুদ্রাটা; দেখুন তো এটাই আপনার হারানো সেই স্বর্ণমুদ্রা কি না।বৃদ্ধ আগ্রহভরে বাচ্চা মেয়েটার হাত থেকে স্বর্ণমুদ্রাটা নিয়ে চোখজোড়া খুব কাছে নামিয়ে আনলেন, আরে, এটা তো তারই সেই স্বর্ণমুদ্রাটা! বৃদ্ধ খুব খুশি হলেন তার হারানো ধন ফিরে পেয়ে, মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন, দেখলেন ততক্ষণে তাঁর সামনে এক থালা খাবার।
আজ দু’দিন বৃদ্ধ অভুক্ত, ক্ষুধায় কাতর । ছোট্ট মেয়েটার অনুরোধে বৃদ্ধ খাবারটুকু তৃপ্তি ভরে খেলেন, আর এর পরে যাবার আগে বার বার মেয়েটার হাত দিয়ে দোওয়া করলেন। এই যে ছোট্ট মেয়েটা, যার সততা, আর আমনতদারীতা, ক্ষুধার্তের প্রতি সহমর্মীতা, বাড়িতে ডেকে এনে খাবার খাইয়ে দেওয়া, এইসব গুণাবলী খুব অচিরেই তার গর্ভের সন্তানের মধ্যেও দেখা যাবে। এই মেয়েটা আর কেউ নন, তিনি আমাদের মা আমিনা। ( সংক্ষিপ্তকৃত, ক্রমশ)
----------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments