দ্যা চয়েস ইজ ইউরস:
পর্ব ২১-২২,
আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব যে, তাকে দেখলে শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে মানুষ প্রথম দর্শনেই বিমোহিত হতো। সম্মান না করে পারা যেতো না। আবরাহাও আব্দুল মুত্তালিবের ব্যাপারে খুব ভালো করেই জানতো। তিনি হলেন সেই নেতা, যাকে খোদ রোমান সম্রাটও সম্মান ও সমীহ করে। আবরাহাও তাই করলো। আব্দুল মুত্তালিবকে যথেষ্ঠ সমীহ করে তাঁর সকল উটগুলোক ফেরত দিলো বটে, তবে কাবা ধ্বংসে তার দৃড় প্রতিজ্ঞাটাও স্পষ্ট জানিয়ে দিলো।
আবরাহার দৃড়তা দেখে আব্দুল মুত্তালিব হতাশ হলেও তাঁর কোন উপায়ও ছিল না। তিনিই এ ঘরের ত্বত্তাবধায়ক, এর পক্ষে কোন আবেদন নিবেদন যদি করতে হয়, তবে সেটা তাকেই করতে হবে। তা ছাড়া, মক্কাবাসীর কাছে এমন কোন সম্পদও নেই, যে সম্পদকে আবরাহার সামনে তুলে ধরা যায়। শেষ পর্যন্ত আব্দুল মুত্তালিব আরবের তিহামাহ উপত্যকায় উৎপাদিত শষ্যের এক তৃতিয়াংশ প্রতি বৎসর আবরাহাকে প্রদান করার প্রস্তাব দিলেন কাবা ঘর রক্ষার বিনিময়ে। কিন্তু আবরাহা সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করলো।
আবরাহা ছিল একজন নিষ্ঠাবান খৃষ্টান। খৃষ্টবাদে তার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। খৃষ্টবাদকে সমুন্নত করতে সম্মান ও জনপ্রিয়তা বাড়াতে সে ইতোমধ্যেই বেশুমার অর্থব্যয়ে গির্জা বানিয়েছে। খৃষ্টবাদকে তুলে ধরার তার এ প্রচেষ্টা তা ইতোমধ্যেই বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এ অঞ্চলে সমকালীন সমাজে আবরাহার সবচেয়ে বড়ো অর্জন ও কৃতিত্ব ছিল যে, তারই নেতৃত্বে আকসুম বাহিনী ইয়েমেনের বুকে হঠাৎ গজিয়ে উঠা ইহুদি রাষ্ট্রটিকে উৎখাত করেছে, এর শাসককে তাড়িয়েছে, পলাতক সে শাসক শেষপর্যন্ত হতাশায় আত্মহত্যাও করেছে। ইয়েমেনি সমাজ, আকসুম রাজ্য, সুদান ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য’সহ উত্তরের আরব খৃষ্টান অঞ্চলের সকলের কাছেই আবরাহা এক ধর্মীয় বীর।
তাই একজন অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী হলেও শেষপর্যন্ত খৃষ্টসমাজে সে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তার বড়ো প্রমাণ হলো ঘাসানাইড খৃষ্টান রাজা হারিস, বাইজান্টাইন সম্রাট জাষ্টিনিয়ান, পারস্যের খসরু, উত্তর আরবের প্রভাবশালী তৃতিয় মুনজির, এমনকি, যে আকসুম সম্রাটের বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করেছে, সেই সম্রাটও তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
ইয়েমেনের আভ্যন্তরীণ সামাজিক ও সমকালীন আঞ্চলিক রাজনীতির এই বাস্তবতা আমাদের সামনে আবরাহার মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের একটা চিত্র তুলে ধরে। এরকম একটা মানসিক অবস্থায় সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাবা ধ্বংসের। ব্যর্থ হলে এ পর্যন্ত তার সকল অর্জনই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ হবে না, বরং তার রাজনৈতিক মৃত্যুটাও নিশ্চিত হবে।
এইসব বিবেচনায় সে কোন প্রচেষ্টাই বাঁকি রাখেনি মক্কা, তথা, কাবা থেকে আরবদের মনযোগ তার তৈরি করা গির্জার দিকে ফেরাতে। কিন্তু এখন তার স্পষ্ট উপলব্ধী হলো, তার পরিকল্পনার কোনটাই বাস্তবায়িত হবার আদৌ কোন সম্ভাবনা নাই, যতোদিন মক্কার কাবা স্বস্থানে টিকে থাকবে। অতএব, সবার আগে কাবার একটা সুরাহা করতে হবে। এই চেতনা থেকেই তার এতো বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আগমণ।
তার সম্পদের কোন অভাব নেই, অন্তত আব্দুল মুত্তালিবের প্রস্তাবকৃত তিহাম এলাকার শষ্যের এক তৃতিয়াংশ তার কাছে নস্যি মাত্র! তবে একেবারে খালি হাতেও ফেরালো না সে। আব্দুল মুত্তালিবের যে উটগুলো ধরে আনা হয়েছিল, সেগুলোকে ফিরিয়ে দিল। তবে একইসাথে বিষ্ময় প্রকাশও করলো এ কারণে যে, আব্দুল মুত্তালিব আল্লাহর ঘরের তত্তাবধায়ক হয়েও সেই ঘরকে বাঁচাতে (আবরাহার ভাষায়) তেমন কোন প্রচেস্টা করলেন না, যেটা করলেন নিজের উটগুলো বাঁচাতে। এতে নাকি সে হতাশও হয়েছে। প্রাজ্ঞ আব্দুল মুত্তালিবও কম যান না। তিনি জবাব দিয়েছেন; ‘আমি উটের মালিক আমাকে উটগুলো ফিরিয়ে দিন। ঐ ঘরের মালিক যিনি, তিনি তার ঘরের বিষয়টা দেখবেন।’
ঘরের মালিক কে? আবরাহার প্রশ্ন।
‘আল্লাহ’। আব্দুল মুত্তালিবের জবাব। আবরাহও পাল্টা জবাবে দেরি করেনি; ‘আমার হাত থেকে ঐ ঘর কেউ বাঁচাতে পারবে না।’
আবরাহার কাছ থেকে বিফল হয়ে ফেরত এলেন আব্দুল মুত্তালিব। মক্কাবাসীকে বাড়ি ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন। গেলেন মা আমিনার কাছেও। প্রায় সাড়ে সাত মাসের অন্তস্বত্তা আমিনা ও দাসী উম্মে আইমানকেও পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন।
এখানে, এ পর্যায়ে এসে তিনি আমিনার কাছ থেকে সেই ব্যবহার পেলেন যা মক্কার কোন লোক তো দূরের কথা, পুরো আরব উপদ্বীপ, ইয়েমেন, এমনকি, রোমান সম্রাটও তার সাথে করার সাহস করেনি কোনদিন! কোনদিনও নয়।
মা আমিনা অত্যন্ত কঠোরভাবে অসম্মতি জানালেন (Outright refusal) বাড়ি ছেড়ে যেতে। স্পষ্ট বললেন; ‘আমার কিছু হবে না। আমি কোথাও যাবো না।’ বার বার বলা সত্তেও মা আমিনা বাড়ি থেকে বেরই হলেন না। আমিনার এধরনের কঠোর জবাব ও অবিচলতায় আব্দুল মুত্তালিব অত্যন্ত বিচলিত হলেন। কিন্তু কিছু বলতেও পারলেন না, কারণ, সম্ভবত তিনি ততোদিনে মানসিকভাবে এই নারীর সামনে দূর্বল হয়ে পড়েছেন !
এই নারীর বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই তিনি তার স্বামী, নিজ পুত্রকে বাণিজ্যে পাঠিয়েছেন, আজ সেই পুত্র মৃত। আমিনা কি তার ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য আব্দুল মুত্তালিবকে দায়ী করেন? তিনি কি তার উপর রুষ্ঠ? এরকম অনেক প্রশ্নই আব্দুল মুত্তালিবের মনে জাগা স্বাভাবিক। যদিও তার কোন সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। একমাত্র আমিনার রুঢ় আচরণের তথ্যটা ছাড়া, যা আব্দুল মুত্তালিবের মতো ব্যক্তিত্বের জন্যে ছিল অপ্রত্যাশিত ও অভাবনীয় একটা বিষয়। এ ঘটনা আমাদেরকে অনেক কিছুরই ইংগিত দেয়
মা আমিনার কাছ থেকে পাওয়া মানসিক কষ্ট নিয়েই তিনি কাবা চত্তরে গেলেন। কাবার দেয়াল ধরে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন কেঁদে কেঁদে; ‘আয় আল্লাহ তোমার ঘরটা ঐ জালিমের হাত থেকে তুমিই রক্ষা করো।’
সম্ভবত দোওয়া চলছিল অত্যন্ত নিষ্ঠাবান খৃষ্টান আবরাহার তাঁবুতেও। এই সম্ভবনার কথা বলছি কারণ যে, ১লা মার্চ ৫৭১ ছিল রবিবার, খৃৃষ্টানদের সাপ্তাহিক প্রার্থনার দিন। দুই’জন নেতা আল্লাহর কাছে দোওয়া করছেন। পরদিন ২ রা মার্চ সোমবার আল্লাহ তাদের একজনের দোওয়া কবুল করে বিশ্বের বুকে তাঁর শক্তির সামান্যটুকুই দেখিয়েছেন।(ক্রমশ, প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে সংক্ষিপ্তকৃত)
------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments