পর্ব -২৪,
মক্কা একটা ভয়ংকর বিপদ থেকে বেঁচে গেল। আব্দুল মুত্তালিবের মর্যাদাও এক অনন্য উচ্চতায় গিয়ে পৌছুলো। এর আগে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সবার আপত্তি উপেক্ষা করে কেবলমাত্র স্বপ্নে দেখা ইংগিতকে ভিত্তি করে পুত্র হারিস‘সহ মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে যমযম কূপ খুঁজে বের করেছেন। এর ফলে পুরো মক্কাবাসীর পানির সমস্যা দূর হয়।
একবার জমজমের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ চলকালীন কোন এক গণকের মধ্যস্থতা মেনে সেই দ্বন্দ সমাধানে কয়েকজন কুরাইশ নেতাসহ তাদের একটা কাফেলা শামে যাচ্ছিল। পথে মরুভূমিতে পথ হারিয়ে পানির অভাবে মরতে বসেছিলেন সকলেই। এমনকি, প্রত্যেকে নিজের কবর খুঁড়ে মৃত্যুর অপেক্ষাও করছিলেন।
এরই মধ্যে হঠাৎ করেই আব্দুল মুত্তালিবের উটের পায়ের আঘাতে মরুভূমির মধ্যেই তারা পানির সন্ধন পেলে সকলেরই জীবন বেঁচে যায়। সেখানেও পুরো কাফেলার জীবন বেঁচে যাবার ক্ষেত্রে আব্দুল মুত্তালিব একজন উপলক্ষ্য হিসেবে আবির্ভূত হন। এভাবে তিনি বার বার মক্কাবাসীর জীবনে নাটকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন বা উপলক্ষ্য হয়েছেন। এছাড়া কুরাইশ নেতা ও কাবা ঘরের তত্তাবধায়ক হিসেবে তার সম্মান ও অবস্থান আগে থেকেই সুসংহত ছিল। আর এবারের ভয়ানক বিপদেও নেতৃত্বটা দিয়েছেন তিনিই, ফলে তার সম্মান ও মর্যাদা স্বাভাবিকভাবেই এক অনন্য উচ্চতায় ঠেকলো।
পৃথিবীর কোন ব্যাখা দিয়েই আবরাহার পরাজয়ের কোন বোধগম্য ব্যখা দেয়া সম্ভবপর নয়। ঘটনাটা ছিল সকল ব্যাখার অতিত, বিষ্ময়কর ও অভূতপূর্ব। আজও ঘটনাটা একইরকম বিষ্ময়করই রয়েছে। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের অনেক মুসলিম বা অমুসলিম গবেষক কোনরকম বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখা ও প্রমাণ ছাড়াই নানারকম যুক্তি ও মতবাদ উপস্থাপন করেছেন । ইদানিং বলা হচ্ছে, আবরাহা ও তার সৈন্যবাহিনীর মধে গুটিবসন্তের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়ায় আবরাহাকে অভিযান বাতিল করে ফিরে যেতে হয়েছে (সুত্র: Foundation of Islam; The making of a world faith, Benjamin Walker, পৃ:৭৪)।
বেঞ্জামিন ওয়াকার একাই নন, এরকম আরও অনেক অমুসলিম পশ্চিমা ঐতিহাসিক এরকম ভিত্তিহীন মন্তব্যের মাধ্যমে মূলত যে কাজটা করতে চেয়েছেন তা হলো, কাবা রক্ষায় আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন যে বিষ্ময়কর সাহায্য পাঠিয়েছেন মক্কাবাসীদেরকে, সেটাকে খাটো করে দেখিয়েছেন।
নিরস্ত্র, বিপন্ন ও অসহায় মক্কাবাসীকে আবরাহার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য পাখি দিয়ে সহায়তা প্রদান ও পুরো সৈন্যবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়াটা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ও বিষ্ময়কর ছিল যে, সেই বিষ্ময়কে এক আল্লাহ তাঁর সীমাহীন ক্ষমতা ও কৌশলের নিদর্শন হিসেবে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। সেটাকেই খাটো করার একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা রয়েছে পশ্চিমাই এইসব অমুসলিম ঐতিহাসিক ও গবেষকদের গবেষণার মধ্যে।
পরিতাপের বিষয় হলো, তাদের সেই মতবাদ ও ব্যাখাকে অনেক মুসলিম গবেষকও গ্রহণ করে নিয়েছেন (উদাহারণস্বরুপ বলতে পারি; আমেরিকান গবেষক ড: শাব্বির তার Islam: The True History and False Beliefs নামক বইতে উপস্থাপন করেছেন)।
বস্তুত আল্লাহ পাক সারা বিশ্বের যে কোন কিছুকেই যে কোন ঘটনার পেছনে উপলক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, সেটা মুসলমানরা জানে ও স্বীকারও করে। কিন্তু যখন কোন উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই অবলীলায় বলে দেয়া হয় যে, অমুক ঘটনার পেছনে বিশেষ কোন মোজেজা নয়, বরং একটা সুনির্দিষ্ঠ কারণ বিদ্যমান, তখন সেটা বিবেচনা ও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত’ই যদি কারণ হতো, তা হলে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেতে হবে। গুটিবসন্ত রোগটি ১৯৭৭ সালের পর থেকে পৃথিবীতে আর নেই। এর আগে আমরা নিজেরাই দেখেছি এ রোগের প্রকোপ আর ভয়াবহতা। অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগটি আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকেও বিদ্যমান ছিল। গুটিবসন্তের সুপ্তিকাল হলো ১০ থেকে ১৪ দিন, ( কখনও কখনও ৭ থেকে ১৯ দিন পর্যন্তও হতে পারে)।
আবরাহা তার বাহিনী নিয়ে প্রায় একমাস বা তার কাছাকাছি সময়ে দীর্ঘ ছয়শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এসেছে। মক্কায় যখন তার বাহিনীর মধ্যে গুটিবসন্তের (যদি গুটিবসন্তই থাকে) প্রকোপ দেখা দিল, তা দেখা দিল রাতারাতি! এবং সকল সৈন্যদের (৬০ হাজার) মধ্যে এক বা দুই দিনেই! এটা অবাস্তব।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্যানুযায়ী রোগটির সুপ্তিকাল জানলাম। আবরাহা আসার পথে ইয়েমেন বা দক্ষিণ আরবের কোন জনপদ থেকেই রোগটা নিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হলো, ঐ সময় ইয়েমেন বা আরবের দক্ষিণাঞ্চলে কি এরকম কোন মহামারীর কথা ইতিহাসে কারো জানা আছে?
যদি বলা হয়, তারা মক্কায় এসেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তাহলে প্রশ্ন জাগে, মক্কায় কি এ সময় এ রোগটির মহামারী চলছিল? মক্কায় এসে তৃতিয় বা চতুর্থ দিনে তারা রোগটিতে আক্রান্ত হলো, তা হলে সুপ্তিকালের গড়ে যে ১১ বা ১২ দিন প্রয়োজন, সে সময়টাতে তারা তো মক্কায় ছিল না, ছিল পথে। যে পথ দিয়ে তারা এসেছে, সেই পথের কোন জনপদে কি ঐ সময় গুটিবসন্তের মহামারী চলছিল? ইতিহাসে তার কোন প্রমাণ নেই।
আবরাহা তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে পালিয়ে গেল কাবা ধ্বংসের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে। তারা যে দু’ চারদিন মক্কায় বাস করেছে, সেই সময়কাল এবং পালিয়ে যাবার পথে তার সৈন্যদের মধ্যে বহু সৈন্য নিহত ও আহত হয়ে মক্কার আনাচে কানাচে পড়ে থেকে মৃত্যুবরণ করেছে, সেইসব সৈন্য ও তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মাধ্যমেও মক্কায় ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগটি ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ইতিহাসে এমন কোন তথ্য নেই যা আমাদেরকে জানায় যে মক্কা ও তার আশে পাশে ৫৭১ খৃষ্টাব্দে বা সমকালীন সময় গুটি বসন্তের প্রকোপ হানা দিয়েছিল?
অতএব এটা নি:সন্দেহ প্রমাণিত যে, কোন কোন মুসলিম বা অমুসলিম ঐতিহাসিক আবরাহা বাহিনী ধ্বংসের পেছনে গুটি বসন্তের প্রকোপকে দায়ী করে যে ইতিহাস লিখেছেন, তার কোন যৌক্তিকতা নেই। আসল সত্য হলো, আবরাহা বাহিনী ধ্বংস হয়েছে এক আল্লাহার বিষ্ময়কর কৌশলে। আর সেই বিষ্ময়কর কৌশলের গুরুত্বের কারণেই বিষয়টি কুরআনুল কারিমে এতোটা গুরুত্বের সাথে ঠাঁই পেয়েছে। ( সংক্ষিপ্তকৃত, ক্রমশ)
0 Comments