Recent Tube

ইসলামকেন্দ্রিক পুনর্গঠনের চার তরঙ্গ~ --আনোয়ার শামছি শাখাওয়াত।

 
  ইসলামকেন্দ্রিক পুনর্গঠনের চার তরঙ্গ~

  ইউরোপের উপনিবেশিক শক্তিগুলি একের পর এক উপমহাদেশ ও মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। উনিশ শতক থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সামরিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক আধিপত্য তো ছিলই। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মনৈতিক বলয়ে একটা বড় তোলপাড় হয়েছিল।

উপরে উল্লেখিত ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বেশ কয়েকটি প্রবণতা বা তরঙ্গ তৈরি করেছিল। 
এর প্রথম তরঙ্গ ছিল মুখোমুখি সংঘর্ষ বা হেড-অন-কলিশন। যা ছিল সরাসরি জিহাদ। শাহ আবদুল আজীজ থেকে সৈয়দ আহমদ শহীদ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ থেকে দুদু মিয়া এই প্রথম তরঙ্গের সারথী।

এর পরে এল দ্বিতীয় তরঙ্গ। এই তরঙ্গে দেখা গেল দুটি পরস্পর বিপরীত প্রবণতা। দুটিই ছিল প্রথম তরঙ্গের নেতিবাচক ফলাফলের প্রতিক্রিয়া। একটি প্রবণতা ছিল পরাজয় বুঝতে পেরে উপনিবেশিক শক্তির থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে মাদরাসার গন্ডীতে "বিশুদ্ধ" ইসলামকে সংরক্ষণে নিয়োজিত থাকা। এই প্রবণতার ফলাফল হল দেওবন্দ মাদরাসা এবং আন্দোলন। 
এই দ্বিতীয় তরঙ্গে আরেকটি প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। যা ছিল দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রথম প্রবণতার বিপরীত প্রকৃতির। এই প্রবণতা বা প্রতিক্রিয়াটি ছিল পরাজয়ের তাৎপর্য বিচার বিশ্লেষণ করে আত্মসমালোচনা ও সংস্কারের প্রবক্তা হয়ে ওঠা। সেটা করতে গিয়ে এমনকি বেশ কিছুটা এপলোজেটিক বা কৈফিয়তি হয়ে ওঠা। খানিকটা অনুতপ্ত হয়ে বিজয়ী শক্তির শক্তিমত্তার মাহাত্ম্য গাওয়া। এই প্রবণতার ফসল ছিল স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন।
এরপরে এল তৃতীয় তরঙ্গ। এই তরঙ্গের প্রবণতা ছিল প্রথম দুই তরঙ্গ থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এই প্রবণতা পাশ্চাত্য অভিঘাত থেকে নিজেকে দূরে রেখে না গুহাবাসী হতে চেয়েছে, না অনুতপ্ত হয়ে বিজয়ী শক্তির গুণকীর্তনে ধন্য হতে চেয়েছে। এই প্রবণতা বরঞ্চ পাশ্চাত্য জ্ঞানকান্ডের সঙ্গে সর্বতোভাবে নিষ্ঠ হয়ে এর সার্বিক পর্যালোচনায় নিয়োজিত হতে চেয়েছে। যেমন আল্লামা ইকবালের 'রিকন্সট্রাকশন অফ রিলিজিয়াস থ্যট ইন ইসলাম'। এই প্রবণতা বা প্রতিক্রিয়ার পরবর্তী পর্যায়ে আরেকটু ভিন্নতর মাত্রায় দেখতে পাওয়া গেছে মওলানা মওদূদী এবং সাইয়্যেদ কুতুবের পাল্টা প্রত্যাঘাতের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক আন্দোলন। 
একবিংশ শতকের এক ঐতিহাসিক ঘটনা হল ৯/১১। একে কেন্দ্র করে আমেরিকা এবং ইউরোপে ইসলামোফোবিয়ার এক নব উত্থান ঘটেছে।  'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নামক এক বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিধ্বংসী প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় একটি চতুর্থ তরঙ্গ মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোথাও দেখা দিচ্ছে। এটি অনেকটা দ্বিতীয় তরঙ্গের দ্বিতীয় প্রবণতারই মত। অর্থাৎ তীব্র আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিক্রিয়ায় একধরণের আপসকামিতা বা কৈফিয়তি মনোভাব। এর ফলে পাশ্চাত্য জ্ঞানকান্ড ও রাষ্ট্রকাঠামোর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যকে ইসলামের পরিভাষা দিয়ে আত্মীকরণের একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। যেমন আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও শান্তি, গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও নারী স্বাধীনতা ইত্যাদিকে মজলুম ও জালিমের লড়াই থেকে আলাদা করে সর্বকালীন আবশ্যক হিশেবে গ্রহণযোগ্য করার একটা চেষ্টা চলছে। এই প্রবণতায় উপমহাদেশ ও মুসলিম বিশ্ব উভয় ক্ষেত্রেই কেউ কেউ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক অবদান রাখার চেষ্টা করছেন। যেমন উপমহাদেশের ক্ষেত্রে আছেন ওয়াহিদউদ্দীন খান (জন্ম ১৯২৫), জাভেদ আহমদ গামিদী (জন্ম ১৯৫১) প্রমুখ। আর বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের প্রেক্ষিতে আছেন মুহম্মদ আরকুন (১৯২৮-২০১০), ফেতুল্লাহ গুলেন (জন্ম ১৯৪১), রশীদ ঘানুষী (জন্ম ১৯৪১) ।

Post a Comment

0 Comments