Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৩৩ ; জিয়াউল হক।

     
         দ্যা চয়েস ইজ ইউরস;
                                      পর্ব- ৩৩;
                                              
  বস্তুত এই একটা মৌলিক প্রশ্ন ও তার সদুত্তর আমাদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর সেটা করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। বিশেষ করে, যারা তাদের জীবন ও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামি মূল্যবোধের উপরে প্রতিষ্ঠিত করতে চান কিংবা সেই মুল্যবোধকে জীবনের প্রতিটি স্তরে ধরে রাখতে চান, তাদের জন্য এ প্রশ্নের উত্তরটা না জেনে টিকে থাকা সম্ভবপর নয়।

   হযরত ইব্রাহিম আ: কে মুসলমান ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মতো ইহুদিদেরও আদিপুরুষ হিসেবে দেখা হয়। তাঁর এক স্ত্রী বিবি হাজেরা ও সন্তান ইসমাইলকে তিনি আল্লাহর নির্দেশে বিরাণ মক্কায় বসতি গড়ে দেন। ইব্রাহিম আ: অপর স্ত্রী সারা ও তাঁর গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তান ইসহাক বসতি গাড়েন কেনান, তথা ফিলিস্তিনে। তিনি উভয়স্থানেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন। আল্লাহর নির্দেশে পরিবর্তিতে তিনি সন্তান ইসমাইলকে সাথে করে কাবা নির্মাণ করেন। সে কথাটা আমরা ইতোমধ্যেই বলেছি।

      তার মানে হলো, হজরত ইব্রাহিম আ: এবং তাঁর স্ত্রী সন্তানদের হাতে মক্কা নগরী প্রতিষ্ঠিত হয় আর তাঁর সন্তান ইসমাইল আ: ও তাঁর মা বিবি হাজেরা এখানকার স্থায়ী ও আদিবাসিন্দা। হযরত ইব্রাহিম আ: অস্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। তবে তিনিই এ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। এ নগরীর নগরপিতাও তিনি আর এর আদর্শিক পিতাও তিনিই।

     ইব্রাহিম আ: এঁর শিশু সন্তান ইসমাইল (ইসমাইল আ:) বেড়ে উঠলে তাঁর বিয়ে হয় জুরহাম গোত্রের নেতা মু’দাদের মেয়ে রায়লার সাথে। উল্লেখ্য এই জুরহাম গোত্র ছিল ইয়েমেন থেকে উদ্গত হওয়া কাহতানি আরব। এদের একটা অংশ বাণিজ্য বহর নিয়ে যাবার সময় মক্কার মরুভূমিতে পানির অস্তিÍত্ত দেখতে পেয়ে ইসমাইল আ: এঁর মা বিবি হাজেরার সাথে মৈত্রি স্থাপন করে এবং জমজমের মালিকানা ও তার পানি ব্যবহার নিয়ে বিশেষ কিছু সুনির্দিষ্ঠ শর্তে সম্মত হয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করে।

   আরব গোষ্ঠীর মধ্যে মৌলিক ও আদি আরব যারা, তাদেরকে দু’টো ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। একটি হলো এই কাহতানি আরব আর অপরটি আদনানি গোষ্ঠী। আদনানি আরব গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় ইসমাইল আ: এঁর যে বারো সন্তান জন্ম নিয়েছিল, তাদের মধ্যে আদনানের বংশ ও অধস্থনদের পরিচিতি হিসেবে।

        ইসমাইল রায়লা দম্পতির বারো’জন সন্তানের প্রথম সন্তান ছিলেন ‘নেবোজত’ (ঘবনধলড়ঃয)। নবজাতক বাংলা ভাষার বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। ‘নবজাতক’ মানে হলো নতুন জন্ম গ্রহণকাারী। আমরা অহরহ এ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। প্রায়ই পত্রিকার পাতায় খবর দেখি ডাক্তারের ভুলে ‘নবজাতকের প্রাণহানী’ কিংবা ‘মা ও নবজাতক’ সুস্থ আছে ইত্যাদি। এই ‘নবজাতক’ শব্দটি এসেছে ইহুদিদের ভাষা ও সমাজ থেকে।
 
      ইসমাইল আ: ও তাঁর অধস্তনরা কাবার রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকেন। আগত হাজীদের দেখা শোনাও করতেন। কিন্তু পরবর্তিতে উত্তর আরবের আমালিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন গোত্র উপগোত্রের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সুত্র ধরে তা ছড়িয়ে পড়ে খোদ মক্কায়। এরই সুত্র ধরে খৃষ্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার বছর পুর্বে তারা মক্কা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। 

    ইসমাইল আ: এর বংশধরদের অনেকেই মরুভূমির মধ্যে যাযাবর জীবন বেছে নেয়। আর তাঁর প্রথম সন্তান নেবোজতের অধস্তনরা গিয়ে উঠে উত্তর আরবে আধুনিক জর্ডানের কাছাকাছি এবং সিনাই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দিরও আগে। এরাই ইতিহাসে ‘নাবাতিয়ান’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্ব ইতিহাসে নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও ঐতিহ্যমন্ডিত একটি সভ্যতা হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে আজও। 

     আধুনিক সিরিয়ার দামেশক থেকে শুরু করে সউদি আরবের পুরো উত্তরাংশ’সহ বিশাল অংশ এই  সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণে তারা ছিল অসাধারণ দক্ষ। তাদের তৈরি করা ইমারাতের ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান রয়েছে আরবের উত্তরাংশ’সহ জর্ডানের আনাচে কানাচে। সেগুলোর অনেকগুলোই আবার ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষিত। আজও পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় বস্তু ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

     মক্কা থেকে ইসমাইল আ: এঁর বংশধরদের বিতাড়নের ফল হলো এই যে, মক্কার (এবং কাবাও বটে) পরিবেশ আর একেশ্বরবাদী রইলো না। সেখানে দিনে দিনে এর পরে নানা ধরনের মুর্তিপূজার প্রচলন হলো। কাবা ঘরের মধ্যেও মুর্তি স্থাপিত হলো। এই সময়কালে প্রতিটি গোত্রই নিজ নিজ উপাস্য দেবদেবির মুর্তিকে এনে স্থাপন করেছে কাবা প্রাঙ্গনে, কেউ কেউ তা আবার কাবার ভেতরেও বসিয়েছে।

     জুরহাম, কেদার, নিজার, সাক্বিফ, খোজার এবং সাবিয়ান গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন, শত শত, এমনকি, হাজার বছর ধরে অন্তর্দ্বন্দ আর সংঘাতের ধারা চলে এসেছে। একের পর ক্ষমতার পালাবদল হলেও শেষ পর্যন্ত বলা চলে খোজার বংশই সেখানে মোটামুটি দাপটের সাথে বসবাস করতে থাকে। 

    কাবায় মুর্তিপূজা ও মুর্তির প্রচলন কবে শুরু হয়েছিল, সে বিষয়ে ইতিহাসের পাতায় সুনির্দিষ্ঠ তথ্য খুঁজতে গেলে আমরা খৃষ্টিয় প্রথম শতাব্দির একেবারে শুরুর দিকে তার অস্তিত্ত দেখতে পাই। আর এ কাজের সূচনা করেছিলেন মক্কার খোজা বংশের একজন গোত্র নেতা।
লুহাই ইবনে আ’মর ছিলেন সেই গোত্রনেতা। ব্যক্তি হিসেবে তিনি অত্যন্ত স্বজ্জন বলে পরিচিত ছিলেন সর্বমহলে। কাবায় আগত হাজীদের আপ্যায়ন ও সেবা প্রদানে তিনি ছিলেন অগ্রগামী একজন। তিনিই উত্তর আরবাঞ্চলের নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া হোবল মুর্তি এনে সর্বপ্রথম কাবা ঘরে স্থাপন করেন।

    হোবল ছিল লাল আকিক পাথরের নির্মিত। এটাই সেখানে সবচেয়ে বড়ো মুর্তি এবং কাবায় স্থাপিত সর্বপ্রথম মুর্তি। হোবলের মূর্তি যখন লুহাই পেয়েছিলেন নাবাতিয়ানদের কাছ থেকে তখন তার একটি হাত ভাঙ্গা ছিল (ডান হাত)। লুহাই ভক্তির আতিশয্যে নিজের সম্পদ থেকে সেই ডান হাতটি সোনা দিয়ে বানিয়ে দেন। হোবল ছাড়াও লুহাই আরও বেশ কয়েকটা মুর্তি সেখানে স্থাপন করেন। 

      সময়ের ব্যবধানে হোবল মক্কার অন্যতম প্রধান মুর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একেকটি অঞ্চল একেকটি দেবতাকে প্রাধান্য দিত। অর্থাৎ প্রতিটি অঞ্চল তাদের নিজ নিজ দেবতাকে ঠিক করে নিয়েছিল নিজেদের পছন্দমত। আবার অন্যান্য গোত্রগুলোও নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা মুর্তি বানিয়ে কিংবা আনিয়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন মুর্তি ছিল উপাস্য হিসেবে। (ক্রমশ, সংক্ষেপকৃত)।
----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments