Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৩৪; -- জিয়াউল হক।

  
           দ্যা চয়েস ইজ ইউরস
                              পর্ব-৩৪;
                                             

নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন দেবতা থাকলেও তারা প্রত্যেকেই জানতো ও মানতো যে, আল্লাহই হলেন সবচেয়ে বড়ো স্রষ্টা, উপাস্য ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক। এইসব দেবদেবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে ছোটখাটো কাজগুলো, কিংবা তাদের গোত্রের লোকজনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো তদারকি করে থাকে। যে ঘরের ভেতর বা চারিপাশে তারা মুর্তিগুলোকে স্থাপন করেছে, সেই ঘরের মালিক মুর্তিগুলো নয়, বরং আল্লাহ। তাই তারা কাবাকে বায়তুল্লাহ বলেই ডাকতো।

কাবা ঘরে লুহাই কর্তৃক মুর্তি স্থাপন করাটা কেবল লুহাই কিংবা তার গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। গোত্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় তার এ পদক্ষেপ অন্যান্য আরব গোত্রের মধ্যেও নিজ নিজ দেবদেবী সংগ্রহ করা ও সেগুলোকে কাবা’র ভেতরে বা বাইরে’সহ নিজ নিজ অঙ্গনে স্থাপন করার এক অলিখিত প্রতিযোগীতা শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে প্রতিটি গোত্রই নিজেদের মুর্তি স্থির করে নেয়, যেমনটা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি।
উল্লেখযোগ্য বেশকিছু দেব দেবী সকলের কাছেই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল, যেমন; আল-লাত, উজ্জাহ ও মানাত দেবীকে তারা দেখতো আল্লাহর কন্যা হিসেবে! কোন কোন গোত্র আবার লাত দেবিকে আল্লাহর কন্য নয়, বরং স্ত্রী ভাবতো। 

হোবল যেমন বাইজান্টাইন সংষ্কৃতি প্রভাবিত ও উত্তর আরবের নাবাতিয়ান সাম্রাজ্য থেকে আগত, ঠিক তেমনি অন্যান্য দেব দেবীরাও সবাই আরবভূমির বাইরে থেকে আনিত হয়েছে। সূর্যের দেবতা ‘মানাফ’ কিংবা বাজপাখির আকৃতিতে রংধনূ হাতে ধরা ‘নাসর’ মুর্তি; এসবই গ্রিক হেলেনিক এবং একইসাথে পারসিক সংস্কৃতির প্রভাব নির্দেশক।
এই যে মুর্তি এসেছে, তার মানে দর্শন এসেছে। বোধ বিশ্বাস এসেছে। মুর্তির সাথে সাথে তার নাম, পরিচিতি, তাকে ঘিরে যে ধ্যান ধারণা, চিন্তা চেতনা, তার ক্ষমতা ও প্রভাব সন্মন্ধ্যে প্রচলিত বিশ্বাসও এসেছে। সেই সাথে তাকে উপাসনার নির্দিষ্ঠ রসম রেওয়াজও এসেছে। 

অর্থাৎ হেজাজ বা মক্কায় বাইরের, তথা, অনারব দেশ ও জনপদের সাংষ্কৃতি এসেছে। সেগুলো আরব সমাজেরই কিছু নেতা ও তাদের অনুসারীরা এনেছে, আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এর সাথে জড়িয়ে ছিল মক্কারই কোন না কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ফলে সাধারণ লোকজন না প্রতিহত করতে পেরেছে, আর না তাকে অস্বীকার করতে পেরেছে। বরং তারাও গোত্রনেতাদের সাথে তাল মিলিয়েছে। 

এভাবে মক্কা’সহ পুরো আরবের জনগণই বিদেশি দেব দেবীদের সাথে নিজেদের কোন না কোন ধরনের সম্পর্ক বানিয়ে নিয়েছিল। যেমন, সুমেরীয় দেবী আশেরাহ আর আসিরাত থেকে আল-লাত দেবী, মেসোপটেমিয়ান দেবী ইশ্তার থেকে দেবী উজ্জাহ, আর গ্রিক দেবী নেমেসিস থেকে কোনোভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে আসে দেবী মানাত। এদের কেউ ছিল ভাগ্যের দেবী, কেউ বা প্রেমের, কেউ ছিল সন্তানদানের, আবার কেউবা রুটি রুজি জোগানের।

দেব দেবীদের মধ্যেও শ্রেণিবিন্যাস ছিল পুরো দস্তুর। সকল গোত্রের দেবদেবীর একই রকম সমান মর্যাদা ছিল না। তাদের মর্যাদা, ক্ষমতা আর কার্যপরিধীর ক্ষেত্রেও ছিল ব্যপক তারতাম্য। তবে কাবার ৩৬০ দেবদেবীর মাঝে প্রধান ছিল লুহাই কর্তৃক স্থাপিত দেবতা হুবাল। 

আরেকজন জনপ্রিয় দেবতা ছিল সূর্যদেবতা ‘মানাফ’। ঋতুবতী নারীদের জন্য এই দেবতার কাছে ঘেঁষা ছিল নিষেধ। ‘আব্দে মানাফ’ বা ‘মানাফের দাস’ নামটা মক্কায় বেশ জনপ্রিয় ছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর নিজের একজন প্রপিতামহের নাম ছিল আব্দে মানাফ বা মানাফের দাস। 
দিদান গোত্রের মুর্তির নাম ছিল গাদ। রাবিয়া গোত্রের মুর্তির নাম রোদা, কিনানা গোত্রের মুর্তির নাম সা’আদ, মুনিব ইবনে দাউস গোত্রের মুর্তির নাম ছিল জুলকাফাইন। দক্ষিণ আরবের কিছু গোত্র হোবাস নামক মুর্তির উপাসনা করতো। একইভাবে দক্ষিণে ইয়েমেনের আরবরাও নানা মুর্তির উপাসনা করতো। কেবল মুর্তিরই নয়, তারা গাছ, পাথরেরও পুজা করতো। এসব পাথর কোন কোনটা উল্কাপিন্ডের টুকরো ছিল। 

 দূরে কোথাও যাবার আগে তারা কাবায় তাদের মুর্তির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যেতো, আবার সফর থেকে এসে বাড়ি যাবার আগে কাবায় এসে তাদের দেব দেবিদের উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা নিবেদন করে নিজ নিজ বাড়িতে যেতো। কেউ কেউ তো আবার যেখানেই যেতো, সাথে করে একটা মুর্তি নিয়ে যেতো এই বিশ্বাসে যে, যাত্রাপথে মুর্তিটি তাকে নিরাপদ রাখবে।

দেব দেবীগুলো কেবলমাত্র ভক্তি আর উপাসনার জন্যই প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, এসবের পেছনে আর কোন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল না, তা নয়। বরং এইসব দেব দেবীকে কেন্দ্র করেই এখানকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম গড়ে উঠেছিল। সেই অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে একটা ক্ষমতাধর শ্রেণিরও উদ্ভব হয়। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে আয় উপার্জন, কেনা বেচা ও লাভ লোকসানের উপস্থিতি এবং সেসব নিয়ন্ত্রণ, ব্যবহার ও অপব্যবাহার রোধের প্রশ্নও জড়িত রয়েছে।

ব্যবসা ও বাণিজ্যের সাথে গড়ে উঠে ভোগের আয়োজন, উপায় এবং উপকরণ। নানা রসম রেওয়াজ চলতো ধর্মীয় ভাবাবেগে, অর্থাৎ  আমরা বলি ধর্মীয় জীবন। পাশাপাশি চলতো বাণিজ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা, চলতো নানা রসম রেওয়াজ, তথা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, সামাজিক জীবনের অংশ হিসেবে। 

ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী এবং সমাজ জীবনের এই তিন (সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক) কার্যক্রমকে ঘিরে ঘোষিত, অঘোষিতভাবে জড়িয়ে থাকতো ক্ষমতা অর্জনের বিষয়; রাজনীতি। এভাবে সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি কর্মকান্ড ও রাজনীতি, চারটিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুর্তিপূজার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাই মক্কার সমাজব্যবস্থা ছিল শতভাগ পৌত্তলিক সমাজব্যবস্থা। কায়েমি শক্তির এটাই আসল চিত্র।   

ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী এবং সমাজ জীবনের এই তিন (সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক) কার্যক্রমকে ঘিরে ঘোষিত,অঘোষিতভাবে জড়িয়ে থাকতো ক্ষমতা অর্জনের বিষয়; রাজনীতি। এভাবে সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি কর্মকান্ড ও রাজনীতি, চারটিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুর্তিপূজার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাই মক্কার সমাজব্যবস্থা ছিল শতভাগ পৌত্তলিক সমাজব্যবস্থা। কায়েমি শক্তির এটাই আসল চিত্র।   

এখন ঐ সমাজকে মুর্তিপূজা বর্জন করতে বলা মানেই হলো ক্ষমতার নিয়ামক ঐ চারটি ক্ষেত্রই তাদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া। --- আধুনিক যুগে প্রচলিত গণতন্ত্র যদি 'হোবল' হয়ে থাকে, সমাজতন্ত্র তবে 'মানাত', জাতিয়তাবাদ হলো 'লাত'। 

পুরো বিশ্বটাই এরকম কোন না কোন উপাস্যচেতনার উপরে প্রতিষ্ঠিত। নেতা ও বুদ্ধিজীবিরাই তা সমাজে আনে, প্রতিষ্ঠা করে ও টিকিয়ে রাখে। একটি সমাজ কাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়?  ইসলামি আন্দোলনের বিরোধিতা কেন হয়? বুঝতে হলে পুরো চক্রটাকে বুঝতে হবে বৈকি!  (ক্রমশ, সংক্ষেপকৃত)
---------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments