Recent Tube

মানুষের দায়িত্ব দুটি : ইবাদত ও খেলাফত.

    মানুষের দায়িত্ব দুটি : ইবাদত ও খেলাফত

   আল্লাহ তাআলা মানুষকে দুটি দায়িত্ব দিয়েছেন : একটি হচ্ছে ইবাদত, দ্বিতীয়টি খেলাফত। এ দুটি উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন।  

  মানুষ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য সৃষ্টিকর্তার ভাষায় শুনুন। তিনি ইরশাদ করেন : 
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (৫৬) مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ
“আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে কোনো রিজক চাই না, আর আমি চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিবে।” [সূরা জারিয়াত : ৫৬—৫৭]
মানুষের দ্বিতীয় দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে অন্য এক আয়াতে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : 
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
“আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি বানাতে চাচ্ছি।” (সূরা বাকারা : ৩০)

  এ আয়াত প্রমাণ করে মানুষকে খেলাফতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষ কার খলিফা? আল্লাহর খলিফা, আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর কাজের প্রতিনিধি। প্রশ্ন হয় আল্লাহর কাজ কী? আল্লাহর কাজ হচ্ছে সৃষ্টিকে প্রতিপালন করা, তারবিয়ত করা, হেদায়াত করা। অর্থাৎ হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে আমার প্রতিনিধি বানিয়েছি, তাই আমি যেভাবে কার্যপ্রণালী গ্রহণ করেছি তোমরাও কার্যপ্রণালী গ্রহণ করো। আমি মাখলুককে রিজিক দিয়ে থাকি, তোমরাও মানুষের রিজিকের ব্যবস্থা করো। আমি সঠিক পথে পরিচালিত করি, তোমরাও মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করো। আমার যেসব বিধিনিষেধ রয়েছে, হুকুম আহকাম রয়েছে, সেগুলো তোমরা আমার প্রতিনিধি হয়ে বাস্তবায়ন করো। 

   নবী—রাসুলগণ ইবাদতের দায়িত্ব পালনের সাথে—সাথে খেলাফতের দায়িত্বও পালন করেছেন। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করেন। জিহাদ করেন। রাসুল সা. এর পরে খোলাফায়ে রাশেদীন রাজ্য পরিচালনা করেছেন, আল্লাহর বিবিধবিধান বাস্তবায়ন করেছেন, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন, রাজ্য জয় করেছেন। এসবই ছিল খেলাফতের দায়িত্ব পালন। খেলাফতের দায়িত্ব পালন না করলে মানুষের সংশোধন হবে না, মানুষের প্রকৃত কল্যাণ হবে না। আমরা রাসুল সা. ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, একদিকে তাঁরা রাতের গভীরে চাটাই ও চটের উপরে বসে বিনম্রভাবে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল, অপরদিকে প্রশাসনের উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে মাখলুকের সংশোধন ও সেবায় মগ্ন। তাঁরা একসাথে উভয় দায়িত্ব পালন করেছেন। ইবাদত ও খেলাফত উভয় দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়েছেন। 
.
  সাহাবায়ে কেরাম দুটি দায়িত্বই যথাযথ পালন করেছেন

   সাহাবায়ে কেরাম গেলেন পারস্য বিজয় করতে। মুসলিমদের সৈন্যসংখ্যা ছিল সাকুল্যে ত্রিশ বা বত্রিশ হাজার মাত্র। আর পার্সিয়ান তথা ইরানিদের সৈন্য ছিল তিন লাখ। শুধু সৈন্যসংখ্যাই বেশি ছিল না, বরং তারা ছিল অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত, সামরিক পোশাক ও বর্মপরিহিত, রসদ ও খাদ্যদ্রব্য ছিল প্রচুর। বিপরীতে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সকলের গায়ে পরার মতো পূর্ণ কাপড়ও ছিল না। এমনও লোক ছিল যার গায়ে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না, শুধু লুঙি পরে আছেন। কারও হাতে বর্শা, কারও হাতে তরবারি, কারও হাতে খঞ্জর। অস্ত্র, খাদ্য, সরঞ্জাম কিছুই পর্যাপ্ত নেই। 
   এতৎসত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম যেদিকেই যাচ্ছিলেন বিজয় তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়ছিল। সাহাবায়ে কেরাম পারস্যে যুদ্ধের জন্য যাওয়ার পর পার্সিয়ান সৈন্যদের মাঝে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। তারা তটস্ত হয়ে গেল। পারস্যের প্রধান সেনাপতি ছিল মহাবীর রুস্তম। রুস্তমের বীরত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে আজও রয়ে গেছে। 
রুস্তম তার সেনানায়ক, জেনারেল ও অধিনায়কদের একত্রিত করে বলল, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, তোমার সবাই ভয়ে তটস্ত হয়ে গেছ। আমাদের সৈন্যসংখ্যা তিন লাখ আরা আরব্য গেঁয়োদের সৈন্য ত্রিশ হাজারের বেশি না। তাদের কাছে অস্ত্রসস্ত্র ও সরঞ্জাম নেই, আমাদের কাছে এসবের অভাব নেই। তারা আমাদের দেশে এসেছে যুদ্ধ করতে, তাদের কাছে সাহায্য আসার কোনো পথ নেই; আর আমাদের পেছনে আমাদের দেশ, যে কোনো সময় সাহায্য পৌঁছতে পারে; এতকিছুরও পরেও তোমার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেলে কেন? 

    অধিনায়করা বলল, আপনি আমাদেরকে জীবনের নিরাপত্তা দিলে কিছু কথা বলতে পারি। রুস্তম জীবনের নিরাপত্তা দিলে তারা বলতে লাগল, হে রুস্তম! এ নগণ্যসংখ্যক আরব আমাদের উপর বিজয়ী হবেই। তারা আমাদের উপর বিজয় লাভ করবে। আমাদের দেশ তাদের দখলে চলে যাবে। পুরো ইরান তাদের করতলগত হবে। তারা পরাজিত হবে না, আমরাই পরাজিত হবো। রুস্তম জিজ্ঞেস করল কেন? তারা বলল, আগত আরবদের অবস্থা হল : 
هم بالليل رهبان وبالنهار فرسان
“তারা রাতের বেলায় জায়নামাযে পড়ে কান্নাকাটি করে আর দিনের বেলায় অশ্বপিঠে আরোহণ করে।” 
    সৃষ্টিকর্তার কাছে রাতের বেলায় বলতে থাকে, তোমাকে ছাড়া আমাদের কোনো শক্তি নেই, তুমিই শক্তিশালী। আমরা তোমার সৈনিক, তুমি আমাদেরকে বিজয় দিলেই আমরা বিজয়ী হতে পারব, নইলে আমরা পারজয় বরণ করব। এভাবে তারা রাতভর কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করতে থাকে। আর দিনের বেলায় তারাই বীরবিক্রমে যুদ্ধে করতে বেরিয়ে পড়ে। 
তারা তাদের শত্রুদের নারী ও শিশুদের নিজেদের নারী ও শিশু মনে করে হেফাজত করে থাকে; আর আমাদের বাহিনী কোথাও গেলে সবাইকে নারীদের ইজ্জত লুটে। তারা কোনো বিরাণভূমিতে গেলেও সেখানে শস্যশ্যামল হয়ে উঠে; আর আমাদের বাহিনী কোনো বাগান ও খামারে গেলেও সেখানকার ফল ও ফসল উজার হয়ে যায়। এই হল দুই বাহিনীর পার্থক্য। তাই বিজয় তো তাদেরই হবে, আমাদের বিজয় হবে না। পরিশেষে তাই হয়েছিল। পুরো পারস্য ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে। 

     সাহাবারে কেরামের দুটি অবস্থা উঠে এসেছে। প্রথম তাঁরা সঠিকভাবে ইবাদত পালন করতেন; দ্বিতীয়ত তাঁরা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর সংশোধনের কাজে মশগুল। সুতরাং তাঁরা দুটো দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করেছেন। ইবাদতও করেছেন আবার খেলাফতের দায়িত্বও আঞ্জাম দিয়েছেন। 

পবিত্র কুরআনে ইবাদত ও খেলাফতের দায়িত্ব

  আল্লাহ তাআলা মানুষকে ইবাদত ও খেলাফতের দায়িত্ব দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনেও এ ব্যাপারেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : 
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
“আমি তাদেরকে পৃথিবীতে শক্তি—সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করবে। প্রত্যেক বস্তুর পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারে।” (সূরা হজ, আয়াত : ৪১)
এ  আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইবাদত ও খেলাফতের কথা উল্লেখ করেছেন। নামায ও যাকাত বলে ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন আর সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ বলে খেলাফতের আদেশ করেছেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে ইবাদত এবং খেলাফত উভয়টির নির্দেশ রয়েছে। একজন মুমিনের দায়িত্ব এ দুটোই। 

   আজকে আমরা ইবাদত করলেও খেলাফতের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন। রাষ্ট্র পরিচালনা ছেড়ে দিয়েছি ফাসেক—ফুজ্জার ও কুফফারদের হাতে; যে কারণে আমাদের সমাজ ইসলাম দ্বারা উপকৃত হতে পারছে না। ইসলামের প্রকৃত ও পরিপূর্ণ উপকারিতা পেতে হলে অবশ্যই ইবাদতের পাশাপাশি খেলাফতও বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু ইবাদত কিংবা শুধু খেলাফত বা রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে মানবতার প্রকৃত কল্যাণ সাধন অসম্ভব। অসম্ভব। অসম্ভব। 

[প্রকাশিতব্য খুতুবাত হতে সংক্ষেপিত]

Post a Comment

0 Comments