Recent Tube

খোলা চিঠি: হে যুবক - ৩; জিয়াউল হক।

   খোলা চিঠি: হে যুবক -৩;


জ্ঞানের দায়:

  জ্ঞান একটা সম্পদ। সবচেয়ে বড়ো এবং দামী সম্পদ। আল্লাহ পাক মানুষ সৃষ্টির পরে সর্বপ্রথম তাকে যে জিনিসটি দিয়েছেন, তা হলো; জ্ঞান। কোন জ্ঞান? কিসের জ্ঞান? পৃথিবীর জ্ঞান। পৃথিবীতে যা কিছু আছে, থাকবে, তার জ্ঞান।
জ্ঞান মানুষকে কি দেয়? উত্তর একটাই, সবাই জানলেও নানাজন নানাভাবে উপস্থাপন করবেন ব্যক্তির উপলব্ধী ও চিন্তায় ভিন্নতার কারণে। কেউ বলবেন; জ্ঞান শক্তি জোগায়। কেউবা বলবেন; সাহস। কেউ বলবেন; জ্ঞান সম্পদ ও সম্মান জোগায়, সাফল্যের পথ দেখায়। সফলভাবে পথ চলতে সাহায্য করে। প্রত্যেকের জবাবই সত্য। তবে তার বাইরে আরও দু’টো সত্য আছে।

    প্রথম সত্য হলো; জ্ঞান মানুষকে এই অনেক কিছু দেবার ক্রমধারায় সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন জিনিসটা জোগায়? সেটি। জ্ঞান মানুষকে সর্বপ্রথম আত্মমর্যাদা দেয়, নিজ আত্মপরিচয়ে পরিচিত করে তোলে। সে নিজেকে চেনে, নিজের অবস্থান ও মর্যাদা, স্বকীয়তা ও শক্তি, উৎস এবং গন্তব্য নিয়ে সচেতন হয়।

   এ সচেতনতার প্রমাণও তাকে দিতে হয়। কি ভাবে? আল্লাহ পাক আদম আ:কে ফেরেশতাদের সামনে দাঁড় করিয়ে হুকুম করেছিলেন প্রত্যেকটি বস্তুর নাম ও পরিচিতি জানিয়ে দিতে। এর আগে আল্লাহ পাক যখন ঐসব বস্তু ও জিনিসের নাম, পরিচিতি ফেরেশতাদের কাছ থেকে জানতে চাইলে তারা তা জানাতে ব্যর্থ হয়ে সোজাসাপ্টা বলেছিলেন; হে আল্লাহ! আপনি যা আমাদের শেখান নি, তার কোন জ্ঞান আমাদের কাছে নেই।
অর্থাৎ জ্ঞানের উৎস আল্লাহ পাক জ্ঞান দেননি বলেই ফেরেশতাদের কাছে কোন জ্ঞান ছিল না। কিন্তু ঐ একই জ্ঞান আল্লাহপাক আদমকে শেখালেন। এবং তার সেই জ্ঞানের ডেমোনেন্সেট্রশনটা ফেরেশতাদের সামনে করালেন তাকে দিয়েই। ফেরেশতাদের তুলনায় জ্ঞানী হিসেবে তার স্বীকৃতি ও মর্যাদাটাও আদায় করিয়ে দিলেন সকল ফেরেশতা কর্তৃক তাকে সিজদাহ করিয়ে।

    এটা ছিল আদম আ: এর জন্য, তার আত্মপরিচিতি পাবার সূচনা ও প্রক্রিয়া। এই আত্মমর্যাদা নিয়েই তিনি পৃথিবীতে এলেন নিজের উৎস, কর্তব্য ও গন্তব্য জেনে। যে জ্ঞান তাকে আত্মপরিচয় দিয়েছে, সেই জ্ঞানই তাকে আত্মবিশ্বাসী করেছে, উৎস ও গন্তব্যও চিনিয়েছে।

   তার মানে হলো; জ্ঞান মানুষকে আত্মপরিচয় যেমন দেয়, তেমনই পথও দেখায়। এই জন্যই জ্ঞান এতোটা দামী ও মহার্ঘ জিনিস। অর্থাৎ যিনি প্রকৃতই জ্ঞানী হবেন, তাকে আত্মমর্যাদাশীলও হতে হবে। আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তি জ্ঞানী নন, প্রকৃত জ্ঞানী আত্মমর্যাদাহীন হন না। এটাই হলো প্রথম সত্য।
দ্বিতীয় সত্যটা হলো; জ্ঞানের একটা দায় রয়েছে। এ দায় মেটাতে হয়। এ দায় না মেটাতে পারলে বা না মেটালে সেটা তার ধারক, তথা, জ্ঞানীর জন্য ধ্বংসের কারন হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে তার জন্য জ্ঞান সম্পদ ও আশীর্বাদ না হয়ে বরং অভিশাপ হয়ে উঠে।

   আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন, একজন কুরআনের হাফেজ। অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। ইসলাম বুলন্দ করার ব্যাপারে তার সদিচ্ছার ঘাটতি ছিল না। নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিজীবনে কোনরকম ঘাটতি ছিল বলে শুনিনি। রোজার মাসে প্রতিদিন একটা করে খতম দিতেন বলে বলা হয়।

    গ্রিক দর্শন পাঠে মামুন উজ্জীবিত হলেন। দর্শন তার খুব প্রিয় সাবজেক্ট হয়ে উঠলো। খলিফার মনে হঠাৎ করেই প্রশ্ন জাগলো; আচ্ছা, কুরআন কি আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মতোই একটা সৃষ্টি? তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন কুরআন আল্লাহপকের অন্যান্য সৃষ্টির মতোই একটা সৃষ্টি। সমকালীন সবচেয়ে বড়ো আলেম ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল’সহ বেশিরভাগ আলেমই এটা মানতেন না।
মামুন জোর করে আলেমদের মানাতে গিয়ে কুখ্যাত ‘আল মিহনা’ চালু করলেন। এরই সুত্র ধরে ইমাম ইবনে হাম্বল দীর্ঘ আঠাশ মাস জেলে খেটেও নতী স্বীকার করেন নি। দীর্ঘ ষেলোটি বসর অপ্রয়োজনীয় এ বিতর্কে শত শত আলেম ওলামাকে অবর্ণনীয় জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এই জুলুমের দায় কি মামুনকে নিতে হবে না?
    হামদান কারমাত কর্তৃক ৮৯৪ খৃষ্টাব্দে সমাজে ইসলামের সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কারামাতী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদ্দেশ্যটা খুবই ভালো। কিন্তু এই গোষ্ঠীই কি না ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরতার জন্ম দিয়েছে। তারা কাবা প্রদক্ষিণ বা তাওয়াফ করাটাকে জাহেলি যুগের পৌত্তলিক নিদর্শন মনে করতো।

     এরকম আরও অনেক প্রথাকে অপ্রয়োজনীয়, কুফরি মনে করে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছে। ৯০৬ খৃষ্টাব্দে ইরাক থেকে হজ্জে যাবার পথে ২০ হাজার এবং ৯৩০ খৃষ্টাব্দে খোদ ক্বাবা চত্তরে ৩০ হাজার হাজীকে হত্যা করেছে। আল্লাহর কাছে এর জবাব কি শেখ হামদান কারমাত কিংবা শেখ আবু তাহিরকে দিতে হবে না?
ইতিহাসে এরকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। প্রশ্ন হলো, এরকম হতে পারলো কেন? উত্তর হলো; জ্ঞানের যে একটা দায় রয়েছে, সে ব্যাপারে সচেতন না হওয়া।
  
   জ্ঞানের দায়টা কি? জ্ঞানের দায় হলো; নিজের জ্ঞানের উপরে সর্বদা স্বনিয়ন্ত্রণ (Self-Censorship) আরোপ করে রাখা। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে; সেটা জেনে অসীম জ্ঞানের পেছনে না ছোটা (সুরা আলে ইমরান:৭)।
অর্থাৎ একজন জ্ঞানীকে জানতে হবে কোথায় থামতে হয়। এটা খুবই জরুরী, তা না হলে অর্জিত জ্ঞান তখন তার নিজের জন্যই মারাত্মক বিপর্যয়কর হিসেবে দেখা দিতে পারে। ইতিহাসই তার স্বাক্ষী । আল কুরআনও সেটাই বলে। (সংক্ষেপকৃত)।
----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments