Recent Tube

খোলা চিঠি: হে যুবক- ৬ ; জিয়াউল হক।

  
  
   খোলা চিঠি: হে যুবক- ৬
   --------------------------------- 
মুসলিম উম্মাহর পতনের কারণ-

হে যুবক, উঠে দাঁড়াতে চাইলে আগে পতনের কারণগুলো জানতে হবে। পতনের এ অতল গ্হবর থেকে উম্মাহকে যে যুবসম্প্রদায় তুলে আনবে, তারা সবার আগে পতনের কারণগুলোকে যথাযথভাবে সনাক্ত করবে। এ ছাড়া উঠে দাঁড়াবার কোন পথ নেই।

মুসলিম উম্মাহর পতনের কারণগুলো একটামাত্র বক্তব্যে নির্দেশ করাটা সহজ নয়। তবে দেড় হাজার বসরের ইতিহাস বিচার করলে উম্মাহর পতনের প্রকৃত কারণগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। আল্লাহপাক আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন এই দুনিয়ার ধন-সম্পদ ক্ষণস্থায়ী, তা অর্জন করাটাই জীবনের আসল লক্ষ্য নয়। আমাদেরকে পরকালমুখী হতে বলেছেন। তাঁর প্রিয় হাবিব সা: স্বয়ং এবং সম্মানিত সাহাবীরাগণও পরকালমূখী জীবনের সর্বোত্তম উদাহারণ পেশ করেছেন। 

ইসলামের প্রথম শতাব্দি অতিবাহিত হতেই এই মৌলিক লক্ষ্যটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। প্রখ্যাত সাহাবি হযরত ওমর রা:, হযরত আবুজর গিফারি রা: প্রমূখ এই পরিবর্তনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে, হিজরী চতুর্থ দশকেই তা উপলব্ধী করতে পেরেছিলেন। 

সম্পদ আহরণ করা ইসলামে অবৈধ নয়, নিরুৎসাহিতও নয়। কী প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে, কিভাবে তা খরচ হচ্ছে, সেটাই হলো আসল বিচার্য। অনিয়ন্ত্রিত লোভ ও চাহিদা যখন সম্পদ আহরণের পেছনে কাজ করে তখন তা আত্মঘাতী হয়ে দেখা দেয়, এটাই ইসলামের দৃষ্টিভংগী।

কাদ্বেসীয়ার যুদ্ধের (জুলাই ৬৩৬ খৃষ্টাব্দ) ধারাবাহিকতায় ৬৫৩ পর্যন্ত চলে আসা সংঘাতের মাধ্যমে পারস্য বিজয় হয়। প্রায় একই সময়কালে সংঘটিত অপর বিজয়াভিযান,ইয়ারমুকের যুদ্ধের ( আগষ্ট, ৬৩৬) ফলে রোমান কালচারসমৃদ্ধ সিরিয়া মুসলিম সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। এরপর থেকে কল্পকথার রোমান ও পারস্য সম্রাজ্যের সেই জৗলুসপূর্ণ বিলাসী জীবনধারা এক এক করে ইসলামি সমাজে বানের পানির মত ঢুকে পড়ে দুই জনপদ থেকে আসা ধর্মান্তরিত নওমুসলিমদের মাধ্যমে।

ইসলাম সাংস্কৃতিক আগ্রসনের মুখে পড়ে। ধীরে ধীরে সুক্ষ কিন্তু গতীশীল পরিবর্তন ঘটতে থাকে পরবর্তি প্রজন্মের মুসলিম মানসে। বিলাসী জীবন যাপনের প্রবণতা সৃষ্টির ফলে তার চাহিদা বেড়েছে, কৃচ্ছতাপূর্ণ সাধারণ জীবনটা অসহনীয় ঠেকেছে। তার চাহিদা ও প্রয়োজনে বেড়েছে। সম্পদের প্রতি লোভ বাড়িয়েছে।

ব্যক্তিমানসে সম্পদের প্রতি সীমাহীন লোভ (Materialism) পরিবারে আপোষকামীতা এনেছে, ফলে সে নীতি নৈতিকতার সাথে আপোষ করে সম্পদের পেছনে ছুটেছে, ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করেই। এটা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক) এটাই হলো পতন প্রক্রিয়ার সূচনা বিন্দু ।

ব্যক্তিচরিত্রে আপোষের এ ধারা ব্যক্তি, পরিবার এবং বংশের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন সংকুচিত করেছে, মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সমাজে 'Individualism' এর পথ খুলে দিয়েছে। এরই হাত ধরে নারীর সম্মান, প্রকৃতিগত অবস্থান, তার অধিকার ও মহান দায়িত্ব সম্পর্কে বিভ্রান্তি নারী মানসেও জন্ম নিয়েছে রমণীয় ধাঁচের 'Individualism' ('Feminism') ।
 
Feminism 'নারী স্বাধীনতা'র আড়ালে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভাঙ্গার সবচেয়ে বড় উপকরণ। ফলে ইসলামের সবচেয়ে বড় বুনিয়াদ; পারিবারিক বন্ধন ভাঙ্গনের পথ ক্রমেই বাড়তে থেকেছে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

বস্তুবাদীতার (Materialism) প্রসার, তার পথ ধরে ব্যক্তিস্বাধীনতার ('Individualism') বিস্তার, Feminism’ কে ভিত্তি করে পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনকে শিথিল করে দেয়ায় পারষ্পরিক দায়ীত্ববোধ ও সহমর্মীতার লোপ প্রথমে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্তির মনে এবং পরে গোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনায় পূঁজিবাদকে (Capitalism) উস্কে দেয়। 

Capitalism এর হাত ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে Corporate Business Monopoly 'র মত চিন্তাধারা এবং সম্পদ কুক্ষিগতকরণ, তার উপরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম ও রক্ষার অসুস্থ ও মানবতাবিধ্বংসী প্রতিযোগীতার উদ্ভব ঘটে।

এই প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন ও প্রতিষ্ঠা ছাড়া অসম্ভব হলে রাষ্ট্র তখন অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগ করে আগ্রাসী হয়। শক্তি অর্জন ও প্রদর্শনের অসুস্থ প্রতিযোগীতা, অস্ত্র উৎপাদন, অর্জন ও প্রয়োগ, পরের রাজ্য দখল বা পদানত করা, এসব হয় তার নেশা ও লক্ষ্য! রাষ্ট্র পরিচালকদের মনে জন্ম নেয় Expansionism এর চেতনা।

নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বাড়ানো এবং পররাজ্যের সম্পদের উপরে নিজেদের অধিকার স্থাপনে রাষ্ট্র আগ্রাসী হতে বাধ্য হয়। এভাবেই মুসলিম বিশ্বকে উপনিবেশ করে অমুসলিম দুনিয়া; সূচীত হয়েছিল উপনিবেশবাদ বা Colonialism।

এভাবে পুরো মুসলিম ঐক্যকে ধ্বংস করেছে, এর জন্য মুসলিম সমাজ, এর কর্ণধার এবং নেতারাই দায়ী। এত কিছুর পরেও ইসলামের যে ছিটে ফোটা অংশ সমাজ ও রাজনীতিতে টিকে ছিল, তা শেষ করেছে Secularism। এ চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই কামাল পাশা, নাসের, বেনবেল্লা'রা মুসলিম সমাজ থেকে ইসলামের নাম গন্ধটুকু দূর করতে সচেষ্ট হয়েছে।

অনেকে Communism এর কথা বলবেন। অবশ্যই Communism একটা কারণ মুসলিম মানসে বিভ্রান্ত ও পতনের জন্য। কিন্তু এই Communism এর উৎপত্তিই হতো না যদি Secularism দৃশ্যপটে না আসতো। বলা চলে, Secularism থেকে আরও কট্টরতার দিকে বিচ্যুত হয়েই Communism এর উদ্ভব ঘটেছে।

ব্যাখাটাকে পুরোপুরি অনুধাবন করতে হলে ফিরে যেতে হবে উমাইয়া বনাম আব্বাসীয়, হাশেমী ও ফাতেমি খেলাফত থেকে শুরু করে তেইশ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া স্পেনের মূর শাসনসহ বিশাল মুসলিম জনপদের প্রতিটি শাসনকার্যের গতিধারা পর্যবেক্ষণ শেষে ফরাসী বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থা বিচার করতে।
এটাই কথা। এই পাঁচটিই উম্মাহর পতনের আসল কারণ; 
১. Materialism, 
২. Individualism, 
৩. Capitalism, 
৪. Expansionism এবং 
৫. Secularism
কারণগুলোর রুপ প্রকৃতি ও গতিপ্রবাহকে বুঝতে পারার মধ্যেই রয়েছে মুক্তির খোঁজ। (সংক্ষেপকৃত)
--------------------------------------------------------------
লেখকঃ  ইসলামি  চিন্তাবিদ  গ্রন্থপ্রনেতা  গীতিকার  ও  বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments