Recent Tube

ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান দুর্দশা ও তার কারণ; --- সাইয়েদ কুতুব শহীদ। অনুবাদ: হাফেজ মুনির উদ্দিন আহমদ।

 ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান দুর্দশা ও তার কারণ;

   ইসলাম প্রচারকদের কথা ও কাজের অমিল বর্তমান সময়ের ইসলাম প্রিয় লােকদের জন্যে একটা বড় বিপদ। ইসলাম প্রচারকদের কাছে যখন ইসলামের কথা বলাটা জীবনের সাথে মিশে যাওয়া আদর্শ ও আকীদা না হয়ে নিছক পেশা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাদের কথা ও কাজে এবং কথা ও চিন্তায় আর সামঞ্জস্য থাকে না। তারা মুখে বলে ভালাে কথা, কিন্তু কাজের বেলায় নিজেরা তা করে না। তারা মুখে বলে এক কথা, কিন্তু মনে ভাবে অন্য জিনিস। অন্য মানুষকে ভালাে কাজ করার আহ্বান জানায় অথচ নিজেরা তা অবহেলা করে। স্বার্থের টানে আবার কখনাে কখনাে আল্লাহর বাণীকে বিকৃতও করে এবং অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন বাক্যের ঘােরানাে পেঁচালাে অর্থ করে আপন মতলব উদ্ধার করতে চেষ্টা করে। কখনাে কখনাে এমন এমন আজগুবি ফতােয়া দেয়, যা হয় তাে আল্লাহর ওহীর বাণীর সাথে বাহ্যত ও শাব্দিকভাবে মিল খায়, কিন্তু ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সামগ্রিক প্রাণসত্তার সাথে তা সম্পূর্ণ বিরােধী। এটা তাদের নিছক মতলববাজি। সমাজে যারা সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী, তাদের কাছ থেকে হীন স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশেই এরা এরূপ করে থাকে। ইহুদী ধর্মযাজকরাও এ বদভ্যাসে লিপ্ত ছিলাে।

    একজন প্রচারক যখন সকাজ করার জন্যে মানুষকে দাওয়াত দেয়, অথচ নিজে তার বিরুদ্ধাচরণ করে, তখন এটা সাধারণ মানুষের জন্যে মারাত্মক বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা শুধু যে প্রচারককেই সন্দেহের চোখে দেখতে আরম্ভ করে তা নয়; বরং সেই সাথে তার প্রচারিত আদর্শের ব্যাপারেও তারা ঘােরর দ্বিধাদ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এ বৈসাদৃশ্য তাদের মনে ও চিন্তাধারায় অস্থিরতা এবং দ্বিধা সংশয়ের জন্ম দেয়। কেননা তারা শােনে ভালাে কথা অথচ বাস্তবে দেখে মন্দ কাজ কারবার। কাজ ও কথার এই ব্যবধান তাদের দিশাহারা করে ফেলে। প্রচারিত আদর্শ তাদের আত্মায়

    প্রেরণার আগুন জ্বালে এবং অন্তরে ঈমানের জ্যোতি উদ্দীপিত করে ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই তা নিভে যায়। এর ফলে প্রচারকের ওপর তাদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়, সেই সাথে প্রচারিত আদর্শ বা ধর্মের ওপরও সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। 

      যে আদর্শের প্রতি আদর্শের প্রবক্তা ও প্রচারক সর্বান্তকরণে বিশ্বাসী হয় না, প্রচারকের জীবনে যদি সে আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন না ঘটে, তাহলে সে আদর্শের প্রচার যতাে আঁকজমকের সাথে ও সুরেলা গলায় করা হােক না কেন এবং যতাে আবেগ উদ্দীপনা সহকারেই তা পেশ করা হােক না কেন, তা সাধারণ মানুষের কাছে। নির্জীব ও প্রাণহীন থেকে যেতে বাধ্য। প্রচারক তার প্রচারিত আদর্শে আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী সাব্যস্ত হবে কেবল তখনই, যখন সে নিজে সেই আদর্শের জীবন্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারবে, যখন তার কাজ ও চরিত্রে তার কথার পুরােপুরি প্রতিফলন ঘটবে। এরূপ হলেই মানুষ তার প্রতি আস্থাশীল এবং তার আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী হবে। এক্ষেত্রে আদর্শের প্রচারে যদি তেমন কোন লালিত্য ও চমক নাও থাকে, তাতেও কিছু আসে যায় না। আদর্শ তখন তার জীবন্ত বাস্তবতা থেকেই জীবনীশক্তি লাভ করবে এবং তার জ্বলন্ত সত্যতা তাকে সৌন্দর্য সুষমায় মন্ডিত করবে, তখন সুরেলা কণ্ঠ ও আঁকজমকের কোনাে প্রয়ােজন হবে না। সেটা তখন একটা জীবন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে। কেননা জীবন্ত ঈমান থেকেই তা উৎপন্ন।

      এ কথা সত্য, কথা ও কাজের এবং আদর্শ ও চরিত্রের সাদৃশ্য সামঞ্জস্য অর্জিত হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। এটা অর্জন করতে প্রচুর চেষ্টা সাধনা ও অধ্যবসায় প্রয়ােজন। সেই সাথে প্রয়ােজন আল্লাহর সাথে সুগভীর সংযােগ রক্ষা করা এবং তার কাছ থেকে সাহায্য ও হেদায়াত প্রার্থনা করা। কেননা মানুষের নিত্যকার কর্মব্যস্ততা, কর্মক্ষেত্রের নানারকম বাধ্যবাধকতা ও বৈষয়িক প্রয়ােজনের নিত্য-নতুন তাগিদ অনেক সময় মানুষকে বাস্তব জীবনে তার আদর্শ ও আকীদা বিশ্বাস থেকে দূরে ঠেলে নিয়ে
যায়। যে নীতি ও বিধানের প্রতি সে অন্যদের ডাকে, নিজের জীবনে তার প্রতিফলনে অনেক সময় হয় তাে অসমর্থ হয়ে পড়ে। ধ্বংসশীল মানুষ ব্যক্তিগভাবে যতাে ক্ষমতাশালীই হােক না কেন, মহাশক্তিধর চিরঞ্জীব সত্তার সাথে গভীর সম্পর্ক না হওয়া পর্যন্ত সে দুর্বল ও অক্ষমই রয়ে যায়। কেননা অন্যায় অসত্যের আগ্রাসী শক্তিসমূহ তার চেয়ে অনেক বড়াে ও পরাক্রমশালী। সে শক্তিগুলােকে সে কখনাে কখনাে পরাজিতও করতে পারে ঠিকই, কিন্তু সহসা একটি দুর্বল মুহূর্তের পদস্খলনে হয় তাে সে আবার পর্যুদস্ত হয়ে পড়তে পারে। ফলে তার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই সে এক নিমিষে হারিয়ে বসতে পারে। সুতরাং সে যদি সকল শক্তিমানের ওপর যিনি পরাক্রান্ত, সেই চির অজেয় ও চির দুর্বার মাবুদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে এবং তার ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে সে নিজের সকল দুর্বলতা, কামনা বাসনা, প্রয়ােজন ও বাধ্যবাধকতা জয় করতে এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে, যেসব শক্তিধর তাগুতেরা তাকে নিরন্তর চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, তাদেরও সে পরাজিত করতে সমর্থ হবে।

ইসলামী আন্দোলন সংকট ও সম্ভাবনা বইয়ের ৩২,৩৩ পৃষ্ঠা,

Post a Comment

0 Comments