Recent Tube

আলোর ফেরিওয়ালা। জিয়াউল হক।

  মুসলিম: এ নেশন অব দ্য বুক (A Nation of the Book) আলোর ফেরিওয়ালা (আমার উনত্রিশতম বই)
 *******
ইসলামের সুতিকাগার মক্কা নগরী। সেই ষষ্ঠ শতাব্দিতে সমকালীন বিশ্বের অন্যন্য উন্নত শহর; আলেকজান্দ্রিয়া, জেরুজালেম, রোম, গ্রিস, কন্সটান্টিনেপল ও পারস্যের চেয়ে কোন অংশেই পিছিয়ে ছিল না । 

এটা ঠিক যে মক্কা মরুময়, বিরাণভূমি, জনবসতিও কম। জীব বৈচিত্র ও আবহাওয়া, জীবন যাপন প্রণালী সম্পূর্ণরুপে ভিন্ন রকমের। চাষাবাদ নেই, কৃষিকাজও অনুপস্থিত একমাত্র খেজুর উৎপাদন ছাড়া। জীবন ও জীবিকার একমাত্র মাধ্যম ছিল ব্যবসা ও পশুপালন। আরও একটা দল ছিল, যাদের উপজীব্য ছিল দস্যুতা বা ডাকাতি করা। তারা মরুর বুকে অচেনা কাফেলার স্বর্বস্ব লুট করে নিতো। 

ষষ্ট শতাব্দির সেই মক্কা ছিল সে যুগের কসমোপলিটন নগরী। সেখানে ভীনদেশিরাও বসবাস করতো। ইয়েমেন, মিশর, পারস্য, বাইজান্টাইন, সিরিয় বা ফিলিস্তিনিরা বাস করতো, আর বিভিন্ন প্রয়োজনে তুর্কি, আফ্রিকান ও গ্রিকরাও মাঝে যাতয়াত করতো।

এরকম আন্তমহাদেশীয় যোগাযোগের বহু প্রমাণ ও দলিল প্রাচিন গ্রিক সাহিত্যে রয়েছে। টলেমি তার লেখায় খৃষ্টপূর্ব যুগেও আরবের মক্কার সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের পাঠকমাত্রই তা জানেন। এতো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও হেলেনিক সভ্যতার জ্ঞানচর্চার ধারা আরবে তৈরি হয়নি। আরবরা সেদিকে ঝুঁকেনি। অথচ বাড়ির পাশে মিশরের কিবত্বিরা গ্রিকদের দর্শন ও সাহিত্যচর্চাকে গ্রহণ করে সহসাই এথেন্সকেও ছাড়িয়ে যায়! 

রোমের কথা বাদ দিলাম। আরবের সাথে হরহামেশাই যোগাযোগ থাকা শহর; জেরুজালেম, নাবাতিয়ান আইলা, আকসুম আবিসিনিয়া, ইয়েমেনের সানা’র মত শহরগুলোও জ্ঞানর্চার জন্য বিখ্যাত ছিল। 

আজকের যুগ বিবেচনায় নগন্য মনে হলেও সেকালে বিশ্বে বিদ্যমান জ্ঞানের অবস্থা ও স্তর বিবেচনায় এটা কথা অনস্বীকার্য যে, সমকালীন বিশ্বে ঐসব শহরগুলোই (প্রাচ্যে চীন ও ভারতের দু’একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র’সহ) ছিল বিশ্বের বুকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেন্দ্র। আরবরা এসব শহরে ব্যবসার জন্য নিয়মিত যাতায়াত করলেও জ্ঞানচর্চায় ঝোঁকেনি। জ্ঞানচর্চা আরবদের টানেনি। 

পুরো মক্কা নগরিতে সপ্তম শতাব্দির শুরুতে (৬১০ খৃষ্টাব্দ) প্রিয় রাসুল সা:’র নবুওয়াত ঘোষণাকালীন লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা মাত্র তেইশজন! একটা কসমোপলিটন নগরীর বুদ্ধিবৃত্তিক চিত্র এটা! এ তথ্যটাই জানান দেয়, জ্ঞানচর্চায় আরবদের অনাগ্রহের মাত্রা কতোটা ব্যাপক ছিল, সেটি।

তবে আরবরা নিজেদের মতো করে জ্ঞানর্চচা করতো। তাদের জ্ঞানর্চা বলতে ছিল কবিতা, কাব্য। কবিতা রচনা আর তা স্মরণে রাখার ক্ষেত্রে আরবরা ছিল বিশ্বের বুকে অপ্রতিদ্বন্দি জাতি। যেটুকুই তারা চর্চা করতো, তার লিখিত রুপ কমই ছিল, চলতো মুখে মুখে। এ অভ্যাসের কারণে তাদের স্মরণশক্তির অবিশ্বাস্য শক্তিশালী একটা ধারা গড়ে উঠে।

সেই নগরীতে প্রিয় নবী আবির্ভূত হলেন সমাজ বদলের মিশন নিয়ে। সাথে একটা আসমানি কিতাব; আল কুরআন। তিনি সেই গ্রন্থের শিক্ষাটা প্রচার করতে লাগলেন। পক্ষ বা বিপক্ষ তৈরি হলো, তর্ক বিতর্কও জমে উঠার ধারাবাহিকতায় যুদ্ধ সংঘাত, দ্বন্দ বিভাজন হলো। দ্বন্দ বিভাজন নতুন ছিল না তাদের কাছে। তবে এর আগে সে সবের কারণ ছিল বৈষয়িক স্বার্থ, অর্থনৈতিক সুবিধা, গোষ্ঠী বা বংশীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা এরকম নানা কারন।

কিন্তু এখন যে সংঘাত শুরু হলো, তা হলো একটা গ্রন্থের শিক্ষা ও আদর্শকে কেন্দ্র করে। কারণ ঐ গ্রন্থের শিক্ষার মধ্যে এমন কিছু তারা দেখতে পেলো, যা তাদের জন্ম জন্মান্তরের স্বার্থকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে বলে আশংকা করলো।

সমাজে মেরুকরণ ঘটতে থাকলো। কেউ দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো আশ্রয়ের সন্ধানে। গড়ে উঠলো একই সমাজের মধ্যে ভিন্ন আরও একটি সমাজ। নতুন এই সমাজটি চিন্তা-চেতনায়, আচারে-আচরণে যেমন ভিন্ন, তেমনই ভিন্ন বোধে আর বিশ্বাসেও। 

একমাত্র কারণ, ঐ গ্রন্থের শিক্ষা ও আদর্শকে ধারণ করা। পরিবর্তনটা উঠে আসতে থাকলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠিীর একেবারে অন্তর থেকে, অন্দরমহল থেকে। অন্তর থেকে উঠে আসা পরিবর্তনটা মেকি ছিল না। সাথে ছিল অন্তরের, আবেগ আর চিন্তার যোগসুত্র। ফলে পরিবর্তনের এই ধারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো। শত বাদ প্রতিবাদ আর বাধা বিপত্তি তার সামনে খাড়া করেও তাকে থামানো গেল না।

বিশ্বের বুকে, ইতিহাসের পাতায় সর্বপ্রথমবারের মতো অপ্রতিরোধ্য একটা জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটলো, যে জাতিকে ডাকা হলো ‘বইপোকা জাতি’ (Nation of Books) হিসেবে! বইপোকা এ জাতিই বিশ্বকে বদলে দিল। বিশ্বটাই বদলে গেল এদের হাতে! শতধাবিভক্ত আরবরাও বিভেদ ভুলে শীশাঢালা প্রাচিরের মতই ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল!

একদিন যে পরিবর্তনটা ‘অশিক্ষিত মক্কা’ থেকে নীরবে গোপনে শুরু হয়েছিল, সেটাই পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল। তৎকালিন বিশ্বের দুই সুপার পাওয়ার বাইজান্টাইন কিংবা পারস্য শক্তিসহ কতো শত রাজ্য তার সামনে এসে লুটিয়ে পড়লো! কতো শক্তি হারিয়ে গেল ইতিহাসের পাতা থেকে!

আমি যখন এই লেখা লিখছি, আপনি যে মহুর্তে এই নিবন্ধটা পড়ছেন ঠিক তখনও  বিশ্বের কোণে কোণে কত শত লোক ঐ কিতাবের অনুসারী আমাকে, আপনাকে গালমন্দ করছে! এই গ্রন্থটির উপরে ক্ষোভ ঝাড়ছে। কেউ তা পায়ে মাড়িয়ে যেতে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে, কেউবা আবার বড় দরদ গলায় (!) তা সংশোধনের কথাও বলছে!

যে গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে এতো কথা, সেই আলকুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক কতোটুকু? আমরা কি ‘এ নেশন অব বুকস’ (Nation of Books) এর গর্বিত উত্তরাধিকারী হতে পেরেছি? আলোর মশাল বইবার ফেরিওয়ালারা কই? কোথায় হাতড়ে মরছে তারা?

(এ কথাগুলোই তুলে ধরা হয়েছে সবিস্তারে এ বইটাতে।)
-----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments