Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৩৯; জিয়াউল হক।

         
          দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৩৯
                    ★★★★★
মক্কায়, এবং বৃহত্তর আরবের বুকে বাণিজ্যবান্ধব একটা পরিবেশ গড়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি, যদিও আবহাওয়া বরাবরই চরম বৈরি ও প্রতিকূল। এই প্রতিকূল ও বৈরি পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার মতো মনোদৈহিক যোগ্যতা ও শক্তিও ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে। 

বাণিজ্যের প্রতি এই যে মানসিক ঝোঁক ও ভিন্ন কিংবা বৈরি পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারার মতো দৈহিক ও আত্মিক শক্তি, দক্ষতা ও যোগ্যতা, তার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে আরবরা আরও বেশি সাহসী ও এ্যডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা তাদের নিজেদের ঘর বাড়ি ও পরিবেশ ছেড়ে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে দূর দূরান্তের জনপদে বাণিজ্যের জন্য পাড়ি দিতে শুরু করেছে, সেরকম মানসিক শক্তি ও দৃড়তার অধিকারী হয়ে উঠেছে। 

অচিরেই এমন একটা সময় এসেছে যখন মরুর আরবরা নানা জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গতকারণেই এটা তাদের মন ও মানসিকতাকে সমৃদ্ধ করেছে। তারা বাইরের জগতের প্রতি উন্মুক্ত হয়েছে, তেমনই বাইরের গণমানসকেও ধারণ করেছে, তা ইতিহাসের নানা ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়।
 
মক্কায় বাইরের জনপদ থেকে নানা বর্ণের, গোত্রের মানুষজন এসে বসবাস করতো। বস্তুত সেই সুদুর সিরিয়া, ফিলিস্তিন আর পুবের মেসোপটেমিয়া, দক্ষিণে ইয়েমেন, আবিসিনিয়া আর সেই সাথে বিখ্যাত সিল্করুটের সংযোগস্থল হবার সুবাদে শক্তিশালী রুম ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে গড়ে উঠা বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে মক্কা সারা বৎসরই দেশি-বিদেশি লোকজনের পদচারণায় মূখর থাকতো। একইভাবে আরবরাও মক্কা ও তার পারিপার্শ্বিক জনপদ ছেড়ে বিভিন্ন জনপদে গিয়ে ব্যবসার প্রয়োজনে বসবাস করতো। 

আরবদের জাতিগত এই বৈশিষ্ঠ, তার উজ্জল প্রমাণ আমরা দেখতে পাই আমাদের ভারতবর্ষ, চীন, সিংহল, কম্বোডিয়া, মালয় এবং আরও পুর্বের দিকে জাভা দ্বীপপুঞ্জে ইসলামপূর্ব সময়কাল থেকেই আরব সম্প্রদায়ের উপস্থিতির ঘটনায়।

আরবদের বাণিজ্য বহর এশিয়া, দক্ষিণ ভারতের কেরালা কোচিন-ভিসাগাপট্টম, সিংহল বা শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়ার জাভা, কম্বোডিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল, চিনের ক্যান্টন (সাংহাই), বাংলাদেশের সন্দীপ, চট্টগ্রাম, বার্মা, তথা, মিয়ানমারের আরাকান (তখনকার স্বাধীন রাষ্ট্র), মেসোপটোমিয়া, দেওল (করাচির কাছের বন্দর), পারস্যের পূর্ব উপকূলীয় বন্দরসমূহ, উত্তর পশ্চিমে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া এবং সিরিয়ার উপকূল ও ভূমধ্যসাগরীয়  নৌবন্দর সমূহে আরব বণিকদের যাতায়াত ও বসতি ছিল। 

বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হলেও এসব কেন্দ্রগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগ ছিল আরবদের মাধ্যমে। এসবের প্রতিটিকে ঘিরে আরব জনবসতি গড়ে উঠে। আরব হতে আগত বণীকদের অনেকেই সেখানে ব্যবসায়ীক স্বার্থ দেখাশোনার জন্য বসবাস করতেন দীর্ঘ মেয়াদে। তারা ছিলেন অত্যন্ত ধনাঢ্য, নিজেদের জীবন ও সংসার পালনার্থে স্থানীয় নারীদের বিবাহ করে সংসারও পাততেন। এদের গর্ভে জন্ম নেয়া পরবর্তি বংশধরদের নিয়েই তাদের বসতি গড়ে উঠতো। 

সমকালীন যুগ ও পরিবেশ বিবেচনায় এরা নিজ এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হতেন অগাধ সম্পদ, যুগোপযোগী জ্ঞান এবং বহির্বিশ্বে যোগাযোগ থাকার কারণে। যাদের ব্যবসার সামর্থ ছিল না, তারা ব্যবসায়ী বহরের প্রতিনিধি গাইড হিসেবেও কাজ করতেন।

এভাবে নানা দিক থেকে আরবের মাটিতে বাইরের দুনিয়া থেকে বিভিন্ন মতবাদ যেমন আসতে থাকে তেমনি এসে জড়ো হতে থাকে ভিন্ন জনপদের সাংস্কৃতিও। এ কথাটাই বিংশ শতাব্দির প্রখ্যাত অমুসলিম আরব ঐতিহাসিক ও গবেষক এডওয়ার্ড হুররানি উল্লেখ করেছেন এভাবে; The people ---- settlers from it. (A History of the Arab Peoples, Albert Hourani, Folio Society, London-2009)

ভাবানূবাদ: এইসব রাজ্যগুলোর (উত্তর ও দক্ষিণ আরবের ছোট ছোট রাজ্য ও গোত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে- লেখক) অধিবাসীরা রাজনৈতিক ও সামরিক জ্ঞান লাভ করার পাশাপাশি তাদের মনোজগত খৃস্টধর্মের কেন্দ্র হিরা’সহ পারিপাশ্বির্ক সাম্রাজ্য থেকে আগত নতুন নতুন দর্শন ও মতবাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এসব অঞ্চল’সহ ইয়েমেন এবং বাণিজ্য পথ ধরে আগত বণিক আর সেই স্থানে বসতী স্থাপনকারীদের মাধ্যমে আরবে বহির্বিশ্বের দর্শন, সংস্কৃতি ও মতবাদ এসে পৌছেছে।

যে সমাজের জীবনাচার ও সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতি, বাণিজ্য ও মুর্তিপুজাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, সেই সমাজকেই কাবা ঘরের মালিক হিসেবে নানা ধরনের মুর্তির নয়, বরং এক আল্লাহর দাসত্ব করার যে আহ্বান জানানো হচ্ছে (সুরা কুরাইশে) তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

মহান আল্লাহপাক কুরআনুল কারিমে ‘কুরাইশ’ বংশের নাম উল্লেখ করে তাদেরকে যে আরবভূমিতে শীত ও গ্রীষ্মকালে কোনরকম যুদ্ধভয়, তথা, আক্রান্ত হবার আশংকা থেকে মুক্ত থেকে বাণিজ্য করার সুযোগ করে দিয়েছেন, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। 

এ আহ্বান জানানোর সাথে সাথে ঐ একই সময় কাবার মালিক হিসেবে একমাত্র এবং কেবলমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করার কথাও বলছেন। কারণ মুশরিক, মুর্তিপুজক আরবরা নিজেরাও জানতো ও মানতো যে, কাবার মালিক হোবল বা লাত কিংবা মানাত নয়, মালিক হলেন আল্লাহ। তারা কাবাকে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর হিসেবে ডাকতো এ কারণেই। 

সেটাই নতুন করে সুরা কুরাইশের মাধ্যমে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে বলাচ্ছেন চেঞ্জমেকার কুসাইয়ের পৌত্র, হাশিমের প্রপৌত্র, তথা, তার (কুসাইয়ের) ষষ্ঠ বংশধর; বংশের সবচেয়ে উত্তম ও চরিত্রবান পুরুষ; মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ’র (প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা.) মুখ দিয়ে।

আরও লক্ষণীয়, কথাটা বলা হচ্ছে প্রাথমকিভাবে কুরাইশ বংশকে ডেকে বা সম্বোধন করে। কেননা এই কুরাইশ বংশ, তাদের সাংস্কৃতি ও জীবানচারই প্রিয় মুহাম্মদ সা. এঁর মিশন, তাঁর দাওয়াতের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধার সৃষ্টি করে রেখেছিল। প্রিয় মুহাম্মদ সা. এঁর পুরো মিশনকে বুঝতে এই ঘটনাক্রম বুঝাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
----------------------------------
লেখকঃ  ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments