Recent Tube

মূর্তি ও ভাস্কর্য কী এক?

        
          মূর্তি ও ভাস্কর্য কী এক?

   স্ত্রী আর বউয়ের মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য নেই, লাউ আর কদু যেমন এক, জাহান্নাম আর দোযখের মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য নেই তেমনি মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

    আভিধানিক অর্থে মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী ‘মূর্তি’ বা ‘মূরতি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে— দেহ, আকৃতি, রূপ, প্রতিমা। ইংরেজিতে মূর্তি শব্দের প্রতিশব্দ— Statue। ভাস্কর্য শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, প্রস্তরাদি থেকে মূর্তি/প্রতিকৃতি নির্মাণ করা। ইংরেজি ভাষায় ভাস্কর্য শব্দের প্রতিশব্দ— Sculptor।
মোটকথা, প্রস্তরাদি খোদাই করে যে মূর্তি তৈরি করা হয় সেটিই ভাস্কর্য। প্রস্তরাদি খোদাই না করে অন্যভাবে মূর্তি বানানো হলে তা ভাস্কর্য নয়,বরং সেটি মূর্তি বা প্রতিমা। মূর্তি ও ভাস্কর্য উভয়টিতেই প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। এটি হচ্ছে আভিধানিক দিক। ইংরেজিতে statue এবং sculpture সমার্থক। বাংলা ভাষায় আভিধানিক অর্থ বিবেচনায় মূর্তি ও ভাস্কর্য অভিন্ন অর্থ দ্যোতিত করে। অর্থাৎ মূর্তি ও ভাস্কর্য সমার্থক।
পূজা/উপাসনার জন্য মূর্তি তৈরী হলেও পূজা বা উপাসনার উদ্দেশ্যে ভাস্কর্য তৈরী হয় না, এমন কথার যৌক্তিকতা কতোটুকু??

৷ মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে পার্থক্য দেখাতে গিয়ে এমন কথা যারা বলেন, প্রকৃতপক্ষে তারা ইতিহাস সম্পর্কে অত্যন্ত অজ্ঞ। পৃথিবীতে ভাস্কর্যের মাধ্যমে মূর্তিপূজা শুরু হয়েছিলো বলে ইসলাম ভাস্কর্যকে শিরকের উপকরণ হিসেবে গণ্য করেছে। আর তাই ইসলাম মূর্তি ও ভাস্কর্য বিরোধী।
ভাস্কর্যের মাধ্যমে পৃথিবীতে কিভাবে মূর্তিপূজা শুরু হয়েছিলো?পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মানব ভাস্কর্য বানিয়েছিলো নূহ (আ)-এর জাতির লোকেরা। নূহ (আ)-এর আগমণের পূর্বে তার জাতির মধ্যে ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক্ব ও নাসর নামে ৫ জন লোক অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত ছিলেন।তাদের অনেক অনুসারী ছিলো। তাদের মৃত্যুর পর সে জাতির লোকেরা তাদেরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের প্রতিকৃতি স্থাপনের মাধ্যমে ৫টি মানব ভাস্কর্য বানিয়েছিলো। তারা উক্ত ৫ জনের প্রতিকৃতি/ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সম্মান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করতো। ভাস্কর্য নির্মাণকারী লোকেদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদেরকে শয়তান প্ররোচিত করলো এভাবে- মূলত তোমাদের পূর্বপুরুষরা এসব সম্মানিত ভাস্কর্য গুলোকেই তাদের মূর্তি/দেবতা হিসেবেই গণ্য করতো। সুতরাং তোমরাও এগুলোকে তোমাদের মা'বুদ হিসেবে গণ্য করো (নাউজুবিল্লাহ)।
শয়তানের প্ররোচণায় তারা তখন এই ভাস্কর্যগুলোকে মূর্তি/দেবতা হিসেবে গ্রহণ করে আল্লাহর ইবাদাতের পরিবর্তে এসবের ইবাদাত শুরু করে দিলো। অতঃপর নূহ (আ) যখন তাদের কাছে একত্ববাদী রবের দাওয়াত পেশ করলেন তখন তারা নূহ (আ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখান করে বলেছিলো--
وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا
আর তারা বলে, ‘তোমরা তোমাদের উপাস্যদের বর্জন করো না; বর্জন করো না ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে’। (৭১ঃসূরা নূহঃ ২৩)
একবার ভাবুন তো- ৫ জন মানুষের ভাস্কর্য কিভাবে প্রজন্ম পরম্পরায় ৫টি দেবতা হিসেবে পরিগণিত হয়ে গেলো। এভাবেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আল্লাহর সাথে শিরক শুরু হয়েছিলো। [বিস্তারিত জানতে সূরা নূহ-এর ২৩ নং আয়াতের তাফসীর অধ্যয়ন করুন]
শুধু পূজার জন্য নয়, মৃত ব্যক্তির স্মারক হিসেবেও মূর্তি নির্মাণ আরব জাহেলী সংস্কৃতির একটা অংশ ছিল। মৃত ব্যক্তির কবরের উপর তারা স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ করত। কোনো কোনোটাতে মৃত ব্যক্তির ছবিও অঙ্কন করা হত। আবার কিছু কিছু স্মারক ভাস্কর্য আকারেও তৈরি করা হত। সেই সব স্তম্ভের গায়ে মৃতের নামধাম ইত্যাদি লিখিত থাকত। আধুনিক প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধানে যে নিদর্শনগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে দেখা যায়, কোনো কোনো স্মারকের গায়ে ‘ছলম’ বা ‘ছনম’ শব্দও খোদিত থাকত। -ড. জাওয়াদ আলী, আল মুফাসসাল ফী তারীখিল আরব দ্বিতীয় সংস্করণ খন্ড : ৮ পৃষ্ঠা : ৫৪
আরবের অন্ধকার যুগের বিখ্যাত একটি মূর্তি হল ‘লাত’। এই মূর্তি ও তার মন্দির তায়েফ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, যে স্থানে মূর্তি ও মন্দির স্থাপিত হয় সেটা মূলত এক ব্যক্তির সমাধি। ধর্মীয়ভাবে তার গুরুত্ব ছিল। ‘লাত’ তারই উপাধী। মৃত্যুর পর তার সমাধির উপর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয় এবং ধীরে ধীরে সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। – আদ্দুররুল মানছূর : ৬/১২৬; তাফসীরে আবুস সাউদ : ৬/১৫৫; রূহুল মাআনী : ২৭/৫৫
ভাস্কর্য জায়েজকারী লোকদের ৩টি দলীলের যুক্তি খণ্ডণঃভাস্কর্য জায়েজকারী লোকেরা ভাস্কর্যের পক্ষে ৩টি দলীল দিয়ে থাকে। নিম্নে তাদের প্রদত্ত দলীল ও যুক্তির খণ্ডণ করা হলো--

১ম দলীল

সহীহ বুখারীর ৮ম খণ্ড হাদিস ১৫১:

আয়েশা (রা) বলেছেন, আমি রাসূল (সা.) এর উপস্থিতিতে পুতুল নিয়ে খেলতাম এবং আমার বান্ধবীরাও আমার সাথে খেলতো। যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার খেলাঘরে প্রবেশ করতেন, তারা লুকিয়ে যেতো, কিন্তু রাসুল (সা.) তাদেরকে ডেকে আমার সাথে খেলতে বলতেন।

সহীহ বুখারীসহ অন্যান্য আরো কয়েকটি হাদীসগ্রন্থে আম্মাজান আয়েশা (রা)-এর পুতুল নিয়ে খেলা করার কয়েকটি হাদীস পাওয়া যায়। এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে দ্বীনের জ্ঞানহীন কিছু লোক বলতে চান- ভাস্কর্য জায়েজ। তারা বলতে চান, রাসূল (সা)-এর ঘরে পুতুল ছিলো। রাসূল (সা) তার স্ত্রী আয়েশা (রা) কে যেহেতু এর ব্যাপারে কোনো নিষেধ করেন নি সুতরাং পুতুলের মতোই বড় কোনো কিছুর প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য নির্মাণ অবশ্যই জায়েজ।
জবাব
তাদের প্রদত্ত ১ম দলীলের জবাবে আমরা বলতে চাই-
এটি ছিলো আম্মাজান আয়েশা (রা)-এর ছোটকালের ঘটনা। তখন তার বয়স ৯ বছরেরও কম ছিলো।তখন ইসলামী অনুশাসন তাঁর ওপর বর্তায়নি বলে রাসূল সা. তাঁকে পুতুল খেলতে নিষেধ করেননি। কিন্তু যখন বালেগা হলেন, তখন সামান্য ছবিও তাকে রাখতে নিষেধ করেছেন। আয়েশা রা. এর মুখেই শোনা যাক। তিনি বলেছেন, রাসূল (সা) একদিন সফর থেকে ফিরে আসলেন। আমি একটি পর্দা টানিয়েছিলাম। যাতে খুদে প্রাণীর ছবি ছিল। রাসূল (সা) যখন এটা দেখলেন, ক্রোধে তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল।

তিনি বললেন, হে আয়েশা! কেয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি তার হবে, যে আল্লাহর সৃষ্টির সাদৃশ্য নির্মাণ করে।' অতপর আমি সেটাকে টুকরো করে একটি বা দুটি বালিশ বানালাম।

তাছাড়া গবেষক ইসলামিক স্কলারগণ ও ফোক্বাহায়ে কেরামগণ বলেছেন-
পুতুল নিয়ে খেলা এটা শিশুদের জন্য বৈধ। তাদের জন্য অনেক কিছুই ইসলামে জায়েয রাখা হয়েছে। যেমন নাবালক-নাবালিকাদের জন্য সাওম (রোযা) রাখা ফরয নয়। কিন্তু সাবালক-সাবালিকা হলে তাদের উপর সাওম রাখা ফরয হয়ে যায়। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। এখন কেউ যদি শিশুদের উপর অনুমান করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও সাওম রাখাকে ফরয মনে না করে তবে সেটি হবে তার ভুল কাজ। কাজেই যেটি খাসভাবে শিশুদের জন্য বৈধ সেটিকে পুঁজি করে মূর্তি/ভাস্কর্য ইত্যাদি বানানোকে হালাল বলা ঠিক নয়।-

হাদীস-১ : ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় গৃহে (ক্রুশের বা প্রাণীর) ছবিযুক্ত কোন বস্তুই রাখতেন না। দেখলেই তা ভেঙ্গে চূর্ণ করে দিতেন’। (বুখারী হা/৫৯৫২; মিশকাত হা/৪৪৯১; ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছবি ও মূর্তি পৃঃ ১৮)।

হাদীস-২ : আয়েশা (রাঃ) বলেন, একবার তিনি একটি গদি বা আসন খরিদ করলেন, যাতে প্রাণীর ছবি ছিল। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গৃহে প্রবেশ করতে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন। ঘরে প্রবেশ করলেন না। আমি তাঁর চেহারায় অসন্তুষ্টি লক্ষ্য করলাম। তখন আমি বললাম, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট তাওবাহ করছি। হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি গুনাহ করেছি? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এই গদিটি কেন? আমি বললাম, আপনার বসার জন্য ও বালিশ হিসাবে ব্যবহার করার জন্য আমি ওটি খরিদ করেছি। তখন তিনি বললেন ‘এই সমস্ত ছবি যারা তৈরী করেছে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেওয়া হবে ও তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছ, তাতে জীবন দাও। অতঃপর তিনি বললেন, যে গৃহে (প্রাণীর) ছবিসমূহ থাকে, সে গৃহে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না’ (বুখারী হা/৫৯৬১)।

হাদীস-৩ : আয়েশা (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য বালিশে ঝালর লাগালাম, যাতে ছবি ছিল। অতঃপর রাসূল (সাঃ) এলেন ও দুই দরজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। এ সময় তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হ’তে থাকল। আমি বললাম, আমাদের কি দোষ হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, এই বালিশের কি অবস্থা? আমি বললাম, এটা বানিয়েছি যাতে আপনি এর উপরে ঠেস দিতে পারেন। তিনি বললেন, তুমি কি জানোনা যে, ঐ ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না, যে ঘরে ছবি থাকে? আর যে ব্যক্তি ছবি বানায় তাকে কিবয়ামতের দিন শাস্তি দেওয়া হবে এবং আল্লাহ বলবেন, তুমি যা সৃষ্টি করেছিলে তাতে জীবন দাও’ (বুখারী হা/৩২২৪)।

হাদীস-৪ : আয়েশা (রাঃ) থেকে অপর একটি বর্ণনায় এসেছে যে, একবার তিনি ঘরের জানালায় একটি পর্দা টাঙ্গিয়েছিলেন, যাতে প্রাণীর ছবি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পর্দাটিকে ছিঁড়ে ফেললেন। তখন আয়েশা (রাঃ) সেই কাপড়ের টুকরা দিয়ে বালিশ তৈরী করেন, যা ঘরেই থাকত এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাতে হেলান দিয়ে বসতেন’ (বুখারী হা/২৪৭৯)।উপরোক্ত হাদীসগুলি দ্বারা প্রতীয়মান হল যে- ছবি, ভাস্কর্য, মূর্তি সবই হারাম। আয়েশা (রা)-এর একটি হাদীস গ্রহণ করে তার বাকি হাদীসগুলি বর্জন করে দ্বীনের জ্ঞানহীন এসব লোকেরা ভাস্কর্যের পক্ষে কথা বলে মুসলিম জাতিকে মূলত ধোকা দিতে চায়।
২য় দলীলঃ
বহু মুসলিম দেশে ভাস্কর্য আছে,সুতরাং আমাদের দেশে হলে সমস্যা কী?
জবাবঃ
যেসব মুসলিম দেশগুলোতে ভাস্কর্য আছে সেটা সে দেশের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত। বহু মুসলিম দেশের ভালো অনেক দৃষ্টান্ত আছে সেগুলো আমদানি না করে খারাপ দৃষ্টান্ত আমদানি করবেন কেনো?
কোনো কাজ কোনো মুসলমান বা কোনো দেশ করলেই সেটা জায়েজ হয়ে যায় না।ইসলামী শরীয়তে কোনো কিছু জায়েজ হওয়ার জন্য কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট রেফারেন্স থাকতে হয়।ইসলাম যেহেতু মূর্তি বা ভাস্কর্য বিরোধী সুতরাং কোনো মুসলিম দেশ সেটা করলেও তারা আল্লাহর কাছে অপরাধী হিসেবেই সাব্যস্ত হবেন।
৩য় দলীল
ভাস্কর্য জায়েজকারী লোকেরা বলে- সুলাইমান (আ) জ্বীনদের মাধ্যমে ভাস্কর্য নির্মাণ করাতেন। তিনি একজন নবী হয়ে যেহেতু ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন সেহেতু ভাস্কর্য নির্মাণ অবশ্যই জায়েয। তারা কুরআনুল কারীমের সূরা সাবা এর ১৩ নং আয়াত দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে যাতে বলা হয়েছে-
يَعْمَلُونَ لَهُۥ مَا يَشَآءُ مِن مَّحٰرِيبَ وَتَمٰثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَّاسِيٰتٍ ۚ
তারা তৈরি করত সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ, ভাস্কর্য, সুবিশাল হাউযের মত বড় পাত্র ও স্থির হাড়ি। (সূরা সাবাঃ১৩)
জবাব
প্রথমত : আমরা মুহাম্মাদ (সা)-এর শরীয়াত পালন করতে বাধ্য। তার পূর্বের কোন নবীর আদেশ নিষেধ আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তারা একটি নির্দিষ্ট কালের জন্য এসেছিলেন। তবে তাদেরকে নবী-রাসূল হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা, যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা আমাদের জন্য ফরয।
দ্বিতীয়ত : এখানে যে শব্দটির অর্থে ‘‘ভাস্কর্য’’ করা হয়েছে সেটির আরবী হল تَمَاثِيلَ সউদী আরব হতে প্রকাশিত এবং পরিবেশিত তাফসীরে বলা হয়েছে যে, এর ‘‘অর্থ হল ছবি, নক্সা, আকৃতি। প্রাণী ব্যতিত অন্য বস্তুসমূহের ছবি বানানো হত। কতিপয় বলেছেন যে, নবীগণ, সৎ ব্যক্তিদের ছবিসমূহ বানিয়ে মসজিদে রাখা হত। যেন তাদেরকে দেখে লোকেরাও ইবাদাত করেন। এই মর্মটি তখনই বিশুদ্ধ হবে যখন এটা স্বীকার করা হবে যে, হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের শরীআতের মধ্যে প্রাণীর ছবি বানানোর অনুমিত ছিল। যা বিশুদ্ধ (ভাবে প্রমাণিত) নয়। তদুপরি ইসলামে অত্যন্ত কঠোরতার সাথে এর নিষোধাজ্ঞা তো রয়েছেই।
তাছাড়া বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে বলা হয়েছে- এখানে যে ভাস্কর্যের কথা বলা হয়েছে তা কোনো মানুষ বা প্রাণীর নয়,বরং কোনো বস্তুর হতে পারে।
কাজেই এই আয়াতটি ভাস্কর্য নির্মাণের পক্ষে দলীল হতে পারে না।ব্যাখ্যা না বুঝেই কেবল অনুবাদ দেখেই কুরআনের মর্ম বুঝার চেষ্টা করাও এক প্রকারের গোমরাহী। কুরআনুল কারীমের প্রতিটি আয়াতের অনুবাদ করার সময়ে ব্যাখ্যার দ্বারস্থ হতে হবে যেন বিষয়টি বিশুদ্ধভাবে উপস্থাপিত হতে পারে।ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য
মানুষ বা প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা ইসলামী শরীয়তে কঠিন কবীরা গুনাহ ও হারাম । মানুষ বা প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বেচাকেনা ইসলামী শরীয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের স্পষ্ট নির্দেশ-

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَ اجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِۙ۝۳۰

‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্ত্ত অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ -(সূরা হজ্জ : ৩০)
এই আয়াতে পরিস্কারভাবে সবধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকান্ড বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আরো লক্ষণীয় বিষয় এই যে. উপরের আয়াতে সকল ধরনের মূর্তিকে ‘রিজস’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রিজ্স’ অর্থ নোংরা ও অপবিত্র বস্ত্ত। বোঝা যাচ্ছে যে, মূর্তির সংশ্রব পরিহার করা পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রুচিবোধের পরিচায়ক। রাসূল (সা) বলেছেন-

أرسلني بصلة الأرحام وكسر الأوثان وأن يوحد الله لا يشرك به شيء- رواه مسلم.

অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার, এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরীক না করার বিধান দিয়ে। -(সহীহ মুসলিম)।
عَنْ أَبِي الْهَيَّاجِ الأَسَدِيِّ قَالَ قَالَ لِي عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ أَلاَّ أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ لاَ تَدَعَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلاَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ- رواه مسلم

অর্থাৎ,আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব রা. আমাকে বললেন, ‘আমি কি তোমাকে ঐ কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দিবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে,... এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে।’ -(সহীহ মুসলিম)।আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

إِنَّ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُوْنَ.

প্রতিকৃতি তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণী হল ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে কিয়ামত-দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।’ -সহীহ বুখারী।
এই হাদীসগুলো থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত, মানুষ বা যে কোনোর প্রাণী মূর্তি বা ভাস্কর্য ইসলামে পরিত্যাজ্য এবং তা বিলুপ্ত করাই হল ইসলামের বিধান। আর এগুলো নির্মাণ করা ইসলামকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য।
উলামা-মাশায়েখ কি বঙ্গবন্ধু বিরোধী?
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য পরস্পর ভিন্ন বিষয়। এদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার স্থপতি ও স্বাধীনতার মহানায়ক মরহুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে উলামা-মাশায়েখগণ অত্যন্ত ভালোবাসেন বলেই তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধীতা করছেন।কারণ উলামা-মাশায়েখগণ চান তিনি যেন কবরে শান্তিতে থাকেন।
তিনি একজন মুসলিম নেতা ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি বারবার 'ইন শা আল্লাহ' শব্দ উচ্চারণ করেছেন। ইসলামের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো বলে 'ইসলামিক ফাউন্ডেশন' প্রতিষ্ঠা করেছেন। মৃত্যুর পর মুসলিম হিসেবেই জানাযা করে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। যিনি এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সারাজীবন কাজ করে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছেন সেরকম একজন মহান মুসলিম নেতার (ইসলাম কর্তৃক নিষিদ্ধ) ভাস্কর্য নির্মাণ করে তার কবরের আযাব বাড়ানোর ব্যবস্থা করা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন নয় বরং বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঈমানী ও গাদ্দারীর শামিল।
বঙ্গবন্ধুর নামে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেডিয়াম, স্যাটেলাইট, নভোথিয়েটার, ক্রিকেট-ফুটবল টুর্ণামেন্ট, সেতু, পার্ক হয়েছে এমনকি বঙ্গবন্ধুর ছবি বাংলাদেশের সব জায়গায় অাছে এইসব বিষয় নিয়ে তো কোনো আলেম কোনোদিন প্রতিবাদ করেন নি, করবেন ও না। তাহলে এখন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধীতা কেন করছেন?
কারণ ইসলাম মূর্তি ও ভাস্কর্যকে সমর্থন করে না।উলামা-মাশায়েখগণ বঙ্গবন্ধু বা দেশ বিরোধী নন, বরং তারা বঙ্গবন্ধুর কল্যাণকামী। তারা ইসলাম,মুসলমান ও বাঙালী জাতির অতন্দ্র প্রহরী।
কেউ কেউ বলছেন, দেশে এতো ভাস্কর্য থাকতে শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা কেন?
আমরা বলতে চাই, আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নয় বরং মানুষ ও প্রাণীর প্রতিকৃতি বহণকারী সকল ভাস্কর্য বিরোধী। কারণ ইসলাম এটাকে কোনোভাবে সমর্থন করে না। আপনি সত্যিকার মুসলমান হলে নিশ্চয়ই আপনিও এটা সমর্থন করবেন না।ইতিপূর্বেও উলামা-মাশায়েখগণ মূর্তি ও ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন ও প্রতিবাদ করেছেন এটা বর্তমানে নতুন কোনো বিষয় নয়।ভাস্কর্য না থাকলে স্মৃতি, ইতিহাস/চেতনা কিভাবে সংরক্ষণ হবে?
কেবল কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকেরাই এমন কথা বলতে পারে। কাউকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার ভাস্কর্য নির্মাণ প্রয়োজন নেই। বরং মানুষ তার কর্ম ও অবদানের জন্যই চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন বাংলাদেশের মানুষ মরহুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে স্মরণ করবে। কারণ তিনি স্বাধীন বাংলার স্থপতি।
ফেরাউনের ভাস্কর্য নয় বরং লাশটাই রয়ে গিয়েছে তারপরও কেউ তাকে শ্রদ্ধা করে না।অথচ দুনিয়ার বহু কীর্তিমান মানুষের কোনো ভাস্কর্য নেই তাও তারা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন। বঙ্গবন্ধুও একজন কীর্তিমান মানুষ,তাই ভাস্কর্যবিহীন তিনিও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
কিছু প্রস্তাবনা
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ না করে তার নামে কিছু স্থাপনা করা যায়। এর মাধ্যমে নান্দনিকতার পাশাপাশি পর্যটনের জন্য দেশ যেমন খ্যাতি লাভ করবে তেমনি বঙ্গবন্ধুর নামও গোটা বিশ্বময় ছড়িয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিনার যার উচ্চতা দেশের শীর্ষ বিল্ডিংগুলোর চেয়ে বেশি হবে। মাসজিদে হারামের পাশে অবস্থিত ক্লক টাওয়ারের মতো মিনারের একদম শীর্ষে ঘড়িও সেট করা যায় যাতে অনেক দূর থেকে টাইম দেখা যায়। পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতিতে মিনারে ৫ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আজানের ব্যবস্থা চালু করা যায়।
বঙ্গবন্ধুর নামে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান করুন।
পরিশেষে বলবো, নিরপেক্ষ মন-মগজ ও মানসিকতা নিয়ে পুরো লিখাটি পড়লে ইনশা-আল্লাহ আপনার বিবেকবোধ জাগ্রত হবে বলে আমি আশাবাদী।

Post a Comment

0 Comments