Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস - ৪৫ ; জিয়াউল হক।

     
       দ্যা চয়েস ইজ ইউরস ;
                          ★★★★★

  শিশু; মুহাম্মদ সা. এঁর সাথে সময়ের পরিক্রমায় এই সমাজ ও সমাজবাসীর যে সম্পর্ক গড়ে উঠবে, তার পক্ষ বিপক্ষের প্রত্যেককে তাদের নিজ নিজ স্বার্থ, মন ও মানসসহ বুঝতেই আমরা মক্কার সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে বুঝার চেষ্টা করবো।

সমকালীন বিশ্ববাণিজ্যে আরব বণিকদের প্রভাব, প্রতিপত্তি, দক্ষতা এবং গুরুত্ব বজায় ছিল। প্রাচীন যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থাটি পুরোটাই ছিল নৌ রুটে নৌকা এবং সড়কপথে উঁট, ঘোড়া, খচ্চর, হাতি ইত্যাদি নির্ভর। 
সঙ্গত কারণেই আঞ্চলিক কিছু রুট গড়ে উঠেছিল। রোমানরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শহরের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় এইসব রুট সমূহকে উন্নত করেছিল এবং বিভিন্ন বন্দর ও সীমান্ত শহরগুলোকে এইসব সড়কের সাথে সম্পৃক্ত করেছিল ব্যবসায়ীক ও সামরিক কারণে। 

এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল সিল্ক রোড। খৃষ্টপূর্ব ২০৭-২২০ সালের দিকে প্রাচিন চীনের হান রাজবংশীয় শাসনামল হতে পথটি গড়ে উঠতে থাকে। প্রাচিন চীনের লাইফলাইন, প্রাণ! 

এই পথেই চীনের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা হতে মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ও উত্তর চীন, এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল হয়ে বাণিজ্যবহর চলে যেতো পারস্যের ভেতর দিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরসমূহে, সেখান থেকে গ্রিস রোম এবং আশপাশ এলাকায়। এরই একটা অংশ মধ্য পশ্চিম এশিয়া থেকে বর্তমান করাচির পশ্চিমে গাওয়াদার বন্দরে। সেখান থেকে নৌ পথে এডেনে।

এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস ও রোমে, জেরুজালেমের রোমান অন্দরমহল, আলেকজান্দ্রিয়ার অভিজাত রাজমহলে সে যুগে দূর্লভ সিল্ক, ভারতবর্ষের মসলিন, মিশরীয় ফারওদের মমি সংরক্ষণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান া মশলা, সুগন্ধীসহ অন্যান্য রসদ, আনা নেয়া করা হতো। চীনা ছাড়াও ভারতীয়, তাতার, তূর্কি, মোঙ্গল, আরব, পারসিক, গ্রিক, রোমান, সিরিয়, জর্জীয়, আর্মেনীয়, সোমালী ও উত্তর আফ্রিকার বণিকরাও এ পথে বাণিজ্য করেছে। 

লোহিত সাগর তীরে ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূলে খৃষ্টপূর্ব ৫ম থেকে ৭ম শতাব্দির মাঝামাঝি গড়ে উঠা এডেন বন্দর সে যুগে আন্তর্জািতিক নৌ বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠে। প্রাচ্যের জাভা বালি দ্বীপ, চীন, কম্বোডিয়া, সিংহল, ভারত, আরাকান, স্বন্দীপ, চট্টগ্রাম, ভিসাগাপট্টম, কোচিন থেকে মালামাল ভিড়তো এখানে। অপরদিকে আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দর, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া হতে কার্পাস তুলো’সহ দাসদাসী এবং অন্যান্য পণ্য আসতো এবং হাতবদল হতো।  

রোম, গ্রিস, আর্মেনিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া, সিরিয়া, পেট্রা (বর্তমান জর্ডান), মক্কা, জেদ্দা, পারস্য, তূরস্ক, ভারত, সিংহল, জাভা ও চীন প্রমূখ দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা সারা বৎসর আনাগোণা ও মাসের পর মাস সস্তা পণ্যের আশায় বসে থাকতেন, নিজেদের জন্য স্থায়ী -অস্থায়ী বাসস্থান/বাণিজ্য কেন্দ্রও বানিয়ে নিয়েছিলেন। 

এভাবেই এডেন হয়ে উঠেছিল সে যুগে বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক বন্দর। সন্নিকটে হওয়াতে এই বন্দরের সাথে মক্কার আরবদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল, আরবরাও এ এলাকায় নিজেদের বাণিজ্য বহর নিয়ে আসনতেন এবং এডেন বন্দর থেকে রসদবহর নিয়ে উত্তর পশ্চিমে দীর্ঘ মরুপথ পাড়ী দিয়ে সিরিয়ার বাজারে তা পৌছে দিতেন। 

সেখান থেকে তা আবার নৌকা বোঝাই হয়ে গ্রিস, রোম, সিসিলি, সাইপ্রাস, কন্সটান্টিনেপল’সহ (তুরস্কের বিভিন্ন বন্দরে গিয়ে উঠতো। তৎকালীন বিশ্বের সুপার পাওয়ার গ্রিস বা রোমের বাজারে সুগন্ধী, সিল্কসহ অন্যান্য রসদের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখতে এটাই ছিল একমাত্র কার্যকর ও প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক সিস্টেম।  

আরবদের জীবিকার একমাত্র সম্মানজনক উপায় ছিল ব্যবসা। তারা ছিল ব্যবসায় অত্যন্ত দক্ষ। তৎকালীণ বিশ্ববাণিজ্যেও আরবরা জড়িয়ে পড়েছিলেন ওতপ্রোতভাবে। সমকালীন প্রায় প্রতিটি ব্যবসাকেন্দ্রে আরবদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। অর্থাৎ সেকালের বিশ্বেও আরব বণিকরা ছিলেন বৈশ্বিক নাগরিক! ফলে বিশ্বের নানা নানা জনপদের সংস্কৃতি মক্কায় অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। এখানকার জীবন যাত্রা ও অধিবাসীদের মন মগজ ইতিবাচক বা নেতিবচাকভাবে প্রভাবিত হয়েছে।

যে মক্কাকে কেন্দ্র করে এতো শক্তিশালী এবং এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা সমাজ গড়ে উঠছে, সেখানে আদতে কোন সমাজ, কোন মানব বসতিই ছিল না। নিরেট সেই বিরাণভূমি জনমানবহীন পাহাড়ি প্রান্তরেই মেসোপটোমিয়া থেকে পৌত্তলিকতার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্ঠিবশত জন্মভূমি ত্যাগ করে বেরিয়ে আসা ইব্রাহিম আ: একটা সমাজ গড়ে তুললেন। 

নতুন এই সমাজকে তিনি তাঁর আদর্শকে ভিত্তি করেই গড়েছেন। সেখানে মুর্তিপূজার কোন ঠাঁই ছিল না। মৌলিক এই বিষয়টা মাথায় রাখা উচিৎ ভবিষ্যৎ আলোচনাকে সঠিক অবয়বে উপলব্ধীর জন্য। একটা সভ্যতা নির্মাণ কি এতোই সহজ! রুুক্ষ পাথরের গায়ে পায়ের ছাপ পড়ার মতো শ্রম দিতে হয় সভ্যতা নির্মাণকারীকে। পাথরও গলাতে হয় মাথার ঘামে! 

সভ্যতা নির্মাণের কাজটা শুরু হয় পরিবার নির্মাণ শুরুর মাধ্যমে। নিজের ঘর থেকে যদি সহায়তা, সাহায্য না আসে, তা হলে সমাজ ও সভ্যতা পরিবর্তন অসম্ভব। এ জন্য আগে নিজের পরিবার, নিজের ঘর নির্মাণ করতে হয় কাংক্ষিত মান ও ধাঁচে। ঠিক এক কাজটাই করেছেন ইব্রাহিম আ: মক্কায়, পরিবার ও সমাজ গড়েছেন তাওহিদকে ভিত্তি করে। সেই তাওহিদবাদী সমাজ কি করে পৌত্তলিক সমাজে পরিণত হলো? কি করে সেখানকার অধিকাংশ মানুষজনই নিখাঁদ পৌত্তলিক হলো? 

মৌলিক এ প্রশ্নটাই আমাদেরকে ভাবতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। নিজেদের মনোজগতে তাওহিদের অবস্থানকে সুসংহত রাখতে। মনোজগতে অবিশ্বাসের অনুপ্রবেশ, আক্রমণ ও সংক্রামণের গতি প্রকৃতি না জানলে, এসবের চোরাপথগুলোকে না চিনলে মক্কার সেই সমাজের মতো আমাদের মন, মানস আর পরিবার এবং সমাজও একদিন হারিয়ে যাবে পৌত্তলিকতার ভয়াল ছোবলে। 

যারা ইব্রাহিম ও তাঁর সন্তান; মুহাম্মদ সা. এঁর ইতিহাস পড়ে কেঁদে আবেগ ভেসে যেতে চান, তাদের জন্য ইতিহাসটাই যথেষ্ঠ। কিন্তু যারা আরও কিছু চান, চান নিজেদের সমাজটাকে বদলে দিতে, তাদের জন্য ইতিহাসের এ পাঠের সাথে সাথে প্রয়োজন পুরো ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ও উপলব্ধী করা। 

আপনি এই চিন্তাভাবনাটুকু করবেন কি না, সে ব্যাপারে স্বিদ্ধান্ত নেবার দায়ও আপনারই। দ্যা চয়েস ইজ ইউরস্্।
----------------------------------------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments