Recent Tube

মেজর জলিলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জবানবন্দী জিবলু রহমান।


মেজর জলিলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র    
  জবানবন্দী।
মূলঃ জিবলু রহমান।
-----------------------------------------------------------

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সবচেয়ে বড় সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। সেই মেজর জলিলের আরেকটা পরিচয়ও আছে-তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম গৃহবন্দী এবং খুব সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সেনা কর্মকর্তা যাকে হাই কমান্ডের নির্দেশ অমান্য করার অপরাধের সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। একজন সেক্টর কমান্ডারকে কেন গৃহবন্দী করা হল? কেন কেড়ে নেয়া হল তাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়া সম্মানসূচক পদক? কি ছিল মেজর জলিলের অপরাধ?
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে অসুস্থ মাকে দেখতে মেজর জলিল তাঁর কর্মস্থল পাকিস্তানের মুলতান থেকে ছুটি কাটাতে বরিশালে নিজ বাড়িতে আসেন। ছুটি শেষ হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তখন তিনি নিজ কর্মস্থলে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। মার্চের শেষ দিকে জিয়াউর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজর জলিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্য ছিন্ন করে মহান মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত মানুষদের পরাধীনতা থেকে মুক্তির পণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামে।
১৯৭১ সালের গঠিত ১১টি সেক্টরের মধ্যে সাহসী সেনা মেজর জলিলকে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফরিদপুর এবং খুলনার কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। দীর্ঘ নয় মাস তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন যার মধ্যে ৭ এপ্রিল খুলনা রেডিও সেন্টার মুক্ত করার অপারেশন উল্লেখযোগ্য। অত্যন্ত দক্ষতা, সাহসিকতা এবং বীরত্বপূর্ণ অবদানের মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের শেষ দিন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত জীবনপণ যুদ্ধ করেন।
ভৌগোলিক নৈকট্যে আর সব সেক্টর কমান্ডারের চেয়ে জলিলই ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর সবচেয়ে কাছাকাছি। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই তিনি বাড়তি সুবিধাদি পেয়েছেন। এমনকি মে মাসের শুরুতে সুন্দরবনের বুড়ি গোয়ালিনী রেঞ্জে পাক বাহিনীর এমবুশে দুটি লঞ্চ বোঝাই অস্ত্র খোয়ানোর পর কলকাতায় ভারতীয় সেনা সদর ফোর্ট উইলিয়ামে মেজর জলিলকে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও সে দায় থেকে তিনি মুক্তি পান এবং পরবর্তী সময়ে জেনারেল অরোরার আস্থাভাজনদের একজন ছিলেন খুলনা মুক্ত হওয়া পর্যন্ত। তাহলে জলিল পরবর্তীতে কার রোষের শিকার?
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হালকা অস্ত্র, অল্প প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের মতো একটি সুপ্রশিক্ষিত ও ভারি অস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সামনা সামনি লড়াইয়ে নামা ছিল আত্মহত্যারই নামান্তর। গোটা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ভিত্তি ছিল হিট অ্যান্ড রান। গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি এটি। ৯ নম্বর সেক্টর প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাগুলোর একটি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ততদিনে। অল্প দিনের ট্রেনিং নিয়ে গেরিলাদের দেশের ভেতরে অপারেশনের এই পদ্ধতি সামরিক বাহিনীতে ইনডাকশন বলে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর জলিলের অংশগ্রহণের অদ্বিতীয় কারণ ছিল তৎকালীন পাকিস্তানী শোষকদের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণকে মুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি যেমনি ছিলেন আপোষহীন তেমনি স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন বজ্রকণ্ঠ। মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতার নেপথ্যের কারণ জানতে পেরে মেজর জলিলের মধ্যে ক্ষোভের তীব্র আগুন জ্বলতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর পরিবর্তে লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করানো হয় জেনারেল নিয়াজীকে। অনুরূপভাবে ১৭ ডিসেম্বর খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে পাকিস্তানী বাহিনীকে সেক্টর প্রধান হিসেবে মেজর জলিলের কাছে আত্মসমর্পণ না করিয়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল দানবীর সিং এর কাছে আত্মসমর্পণ করানো হয়।
মেজর জলিল ৯ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। দক্ষিণাঞ্চল ছিল তার যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধের শুরু থেকেই নানা বিষয়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সাথে তার মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। অবশ্য শুধু তার সাথে না। প্রায় সব সেক্টর কমান্ডারদের সাথেই ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের বিরোধ চলছিল।
পাকিস্তান আর্মির আত্মসমপর্ণের পর মুক্তবাংলায় ভারতীয় বাহিনী লুটপাটে অংশ নিল। বাংলার সম্পদ পাচার শুরু করলো। এ সময় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্রসহ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এ লুটেরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মেজর জলিল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় বাহিনীর নানা ঘটনাসহ স্বাধীনতা পরবর্তী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বাংলাদেশীদের সম্পদ লুণ্ঠনে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়ায়ই তখনকার সরকার মেজর জলিলের উপর ক্ষিপ্ত হয়। মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর লুণ্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ. জি ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট পত্র লিখেন যা ১৭ ডিসেম্বর তাদেরকে পৌঁছানো হয়। ভারতীয় বাহিনীর বেপরোয়া লুটতরাজের বিরুদ্ধে ক্রমেই ক্রোধে অগ্নিরূপ ধারণ করেন মেজর জলিল। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দানবির সিংকে বলতে বাধ্যে হন, ‘দেখামাত্র গুলীর হুকুম দিয়েছি আমি, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ করা হতে বিরত রাখুন।’
মেজর জলিল পরবর্তী কয়েক দিন জাহাজে চড়ে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর এবং ভোলার বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে জনসাধারণকে ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।
ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে হাতিয়ার, গোলাবারুদ, যুদ্ধ সরঞ্জাম, কলকারখানার মেশিনপত্র সবকিছুই লুট করে ভারতে পাচার করতে থাকে। এ সমস্ত লুটপাটের বিরুদ্ধে মেজর জলিলের বিরোধিতায় ও তার সাহসিকতা অন্যান্য সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদেরও ‘মিত্র বাহিনীর’ লুটপাটে বাধা প্রদানে উৎসাহিত করে তোলে।
কিন্তু মেজর জলিল যদি জানতেন যে দেশের জন্য তিনি রুখে দাঁড়ালেন সেই দেশ তার সাথে কি ব্যবহার করতে যাচ্ছে! এক সময় জরুরি ভিত্তিতে এক মিটিং এ তলব করা হয় সব সেক্টর কমান্ডারদের। সেই মিটিং এ যোগ দেবার পথে গ্রেফতার করা হয় মেজর জলিলকে। এভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক লুণ্ঠনের প্রতিবাদ করায় ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী হিসেবে মেজর জলিলকে বন্দী করে যশোর সেনা ছাউনির একটি নির্জন কক্ষে রাখা হয়।
এ বিষয়ে তিনি এক আত্মকথায় বলেন, ‘আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী।’
২১ ডিসেম্বর বেলা ১০টা সাড়ে দশটায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে আমার তখন আর এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।
১৯৭১ সনের সেই ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটের কথা আমি কোন দিনই ভুলতে পারবো না। যশোর সেনা ছাউনির অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে আমাকে সকাল ১১টায় বন্দী করা হয়। বাড়ি না যেন হানাবাড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশপাশে বেশ কিছু নর-কংকাল পড়ে আছে। ঘরের ভিতর মানুষের রক্তের দাগ। কোন ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল। বাইরে কাক, শকুন, শেয়াল একযোগে ব্যস্ত। ভেতরে মশারা কামান দাগিয়ে আছে। বাথরুমে পানি নেই। ডিসেম্বরের ভিজে শীত। বাইরে সেন্ট্রির বুটের কটমট আওয়াজ। সারাদিন গেল কোন খাওয়া বা খাবার পানি পর্যন্ত এলো না। ৫ রুম বিশিষ্ট বাড়িটির রুমে রুমে যেন কান্না আর হাহাকার। সন্ধ্যা হতেই প্যাটার গোঙ্গানি শুরু হয়। সহযোগী ভুতুকও পেছনে পড়ে নেই। বাড়িটার একটা রুমেও লাইট নেই। একটা খাটের উপর একটা আধছেঁড়া কম্বল এবং তখন সেটাই আমার আপন একমাত্র আশ্রয়স্থল। কোনমতে কম্বলটা জড়িয়ে বসে আছি। রাত ১২টা ১ মিনিটে যশোর সেনাছাউনি নতুন বছরের উজ্জীবনী গীতিতে মুখর হয়ে উঠল। নারী-পুরুষের যৌথ কণ্ঠের মন মাতানো সংগীত নাচ, হাত হালি, ঘুঙুরের ঝনঝনানি, উল্লাস, উন্মাদনা সবই ভেসে আসছিল কর্ণকুহরে। আমার মাটিতে প্রথম নববর্ষেই আমি অনুপস্থিত। এ কথা ভাবতেই আমি কানে আর কিছুই শুনতে পেলাম না। শুনলাম কেবল একটা ব্যঙ্গাত্মক অট্টহাসি-‘‘রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা” যার অর্থ দাঁড়ায় কতকটা এ রকম।
রাতের ঘুটঘুটে সেই অন্ধকারে আমি সেদিন কম্বল জড়িয়েও ঘেমে উঠেছিলাম, শিহরিয়ে উঠেছিলাম পুনঃ পুনঃ। স্বাধীনতার সতের বছর পরেও আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। অন্ধকারে আজো আমি একইভাবে শিহরে উঠি আর যেন শুনতে পাই-“রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা।”
একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন বন্দীদের সঙ্গে পাওয়া জিনিসপত্রের সিজার লিস্ট করতে। সবার ব্যাগেই কাপড় ও গুলী ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। এরপর আসে জলিলের ব্যাগ খোলার পালা। তার অনুপস্থিতিতে এই ব্যাগ খোলার ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদের পরও সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে তালা ভাঙা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাগের ওজন সন্দেহজনক বলে রায় দেন তার আগে। খোলার পর এতে পাওয়া যায় বিখ্যাত সমর নায়কদের লেখা গেরিলা যুদ্ধের মোটা মোটা সব বই, যা কলকাতা থেকে ফেরার পথে বিভিন্ন বুকস্টল থেকে কিনে আনতেন জলিল। মূলত স্বাধীন একটা দেশের সেনা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ করে অফিসারদের আধুনিক রণকৌশল এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানা উচিত বলেই মনে করতেন মেজর জলিল। সে কারণেই ভারত থেকে এই বইগুলো সংগ্রহ করেছিলেন তিনি ।
যাই হোক, হতভম্ব ম্যাজিস্ট্রেট এরপর স্টাফ অফিসার মোস্তফাকে জানান, তাকে বলা হয়েছিল মেজর জলিল ও তাদের সঙ্গীরা খুলনা থেকে লুট করা ব্যাগ ভর্তি সোনাদানা, অলঙ্কার ও টাকা পয়সা নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথ তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে!
ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সমগ্র জাতি সরকারের ঐ ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১১ মার্চ ১৯৭২ বরিশালে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের এক বিশাল সমাবেশে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেবার জোর দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়েছিল সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করে, ‘সেনাবিধি অনুসারে হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য, বিদ্রোহ এবং খুলনা পতনের পর লুটতরাজ পরিচালনার পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তার বিভিন্ন বিরোধিতামূলক বক্তব্য ও পদক্ষেপের অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ কোর্ট মার্শালে বিচার করা হবে।’
সরকারের ঐ ঘোষণার পর বিক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। আর্মি, মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণ ক্ষেপে উঠে। এভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম রাজবন্দী। তাঁর নিজের কথায়, ‘আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী।’ এসব বিষয় স্বাধীনতা অর্জনের পরে তুলেছিল তুমুল ঝড়।
মেজর জলিল গ্রেফতারের পর কোথায় আছেন তা দেশবাসী ও তার পরিবার-পরিজন জানতে পারেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের নীরবতায় জনমনে সন্দিহান সৃষ্টি হলে পত্র-পত্রিকা রহস্য উদঘাটনে এগিয়ে আসে। সেই সময় মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক হককথা ‘মেজর জলিল সমাচার শ্বেতপত্র চাই’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লিখে-
 ‘চুপ চুপ করে বাংলাদেশ সরকার মেজর এম.এ. জলিলের অন্তরীণ সম্পর্কিত নানা প্রশ্নকে চেপে যাচ্ছেন। কিন্তু কি করে সম্ভব একজন দুর্বার স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকে ঢেকে রাখা? স্বাধীনতার ১১ দিন পর গত ২৮ ডিসেম্বর যশোর হতে মেজর জলিলের অন্তর্ধানের পর থেকেই সারা বাংলাদেশে নানা কথার কানাঘুষা চলতে থাকে। মেজর জলিল কোথায় অন্তরীণ হয়ে থাকলে, কেনইবা ইত্যাদি প্রশ্ন জনমনে জেগে উঠতে থাকে। বিশেষ করে বরিশাল, খুলনা ও যশোরে মেজর জলিলের একনিষ্ঠ ভক্তরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বরিশালে তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে রীতিমত ধর্মঘটও পালিত হয়। এমনকি রাজধানী ঢাকার দেয়ালে মেজর জলিলের গ্রেফতার কিংবা অন্তরীণকে চ্যালেঞ্জ করে নানা প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। এই স্বাধীনচেতা মেজরের মা মোসাম্মৎ রাবেয়া খাতুন বরিশালের উজিরপুর থেকে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট একখানা স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। কিন্তু তাঁর তরফ থেকে কোন প্রকার জবাব বা বিধান না পেয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সমীপে এক দুঃখিনী মায়ের ফরিয়াদ-এই শিরোনামে তিন পৃষ্ঠাব্যাপী মুদ্রিত একটি খোলাচিঠি বিলি করেন। তাতে তিনি লিখেছেন, একদিকে তার (মেজর জলিল) বীরত্বের অমর কাহিনী আমার বুকে যেমন আশার সঞ্চার করেছে অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর অকথ্য জিজ্ঞাসাবাদ এমন কি জলিলের মা হওয়ার অপরাধে আমার ও আমার একমাত্র ভাইয়ের উপর শারীরিক নির্যাতন তথা খান সেনাদের ভারি বুটের কাল দাগ আমাদের ততটা দুঃখ ও বেদনা দিতে পারেনি, যতটা দুঃখ আর প্রবঞ্চনা পাচ্ছি দিনের পর দিন বৈধব্য জীবনে আমার আদরের দুলালকে হারিয়ে। হতভাগিনী মা আরও লিখেছেন, ২৫ মার্চ জল্লাদ ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের রক্ত চক্ষুর তথাকথিত সামরিক শাসন সম্পূর্ণ উপক্ষো করে ঐতিহ্যবাহী বাকেরগঞ্জ জেলা সদরে বাংলাদেশ সরকারের গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বেসামরিক সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং হাজার হাজার পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আপনার (শেখ মুজিব) স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে উদ্বুদ্ধ করে অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রচন্ড প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলে। ২২ জুলাই জল্লাদ বাহিনীর বর্বর সেনারা স্থল, জল ও অন্তরীক্ষে হামলা চালিয়ে বরিশাল সদর থেকে জলিলের বাহিনীকে হটিয়ে দিতে সমর্থ হয়......ভারত সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা ও সহানুভূতি পেয়ে মেজর জলিল প্রথমে পশ্চিম বাংলার টারকী ও হাসনাবাদে দফতরসমূহ স্থাপন করে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক সাজে সজ্জিত করে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বর্বর পাক সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য এক বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করে....শুনেছি ৯ নম্বর সেক্টরের দুর্ভেদ্য প্রহরীরা তাদের সীমান্ত এলাকার একচুল পরিমাণ পবিত্র মাটিতে হানাদার অনুপ্রবেশ করতে দেয়নি। আরো শুনেছি বহু বীরত্বের কাহিনী; জলিল মিত্র বাহিনী সমবিভ্যাহারে নিজ হাতে ট্যাঙ্ক-বাহিনী পরিচালনা করে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের বহু আগেই খান সেনাদের সুরক্ষিত যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটায় এবং সপ্তাহধিককাল সশস্ত্র যুদ্ধের পর দক্ষিণ বাংলার সদর দফতর দখল করে।’
মেজর জলিলের মার শেষোক্ত বক্তব্যেই গোটা রহস্যটির রেফারেন্স নিহিত। স্বাধীনচেতা এই মেজরের অপ্রত্যাশিত বীরত্ব ও সাফল্যই তাঁকে ভারতীয় বাহিনীর কোপদৃষ্টিতে ফেলে। তখন থেকেই মেজরকে কোন ছুতায় আটক করবার পাঁয়তারা করা হচ্ছিল। স্নায়ু সংঘর্ষটি চরমে পৌঁছল যখন মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর জিনিসপত্র সংগ্রহ অভিযানে প্রতিবাদ করে বসলেন। এ কথা সর্বজন বিদিত যে গোটা বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী বিশেষ করে ঘড়ি, ট্রানজিস্টার, রেডিও, টেপরেকর্ডার, ফ্রিজ, ক্যামেরা ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকা দখল করার পর কমপক্ষে সপ্তাহ দুই দিবালোকে তারা অনেক কামের মধ্যে পছন্দসই দ্রব্যাদি যা ভারতের খোলাবাজারে সস্তায় কিনতে পাওয়া যায় না, সংগ্রহ করায় অতিশয় ব্যস্ত ছিলেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে দাবি করা হয়েছে যে, পরম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর এহেন লোভাতুর অভিযানে বাধা সৃষ্টি করায় তাঁকে অন্যায় অভিযোগে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় বহুল আলোচিত হবার উপক্রম হলে প্রায় আড়াই মাস চুপচাপ থাকার পর সরকার মেজর জলিলের গ্রেফতারের কথা স্বীকার করে তাঁর বিচার হবে বলে ঘোষণা করেন। মেজর জলিল বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিংবা আইন-শৃঙ্খলার দৃষ্টিতে অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন বলে প্রমাণিত হলে তাকে সমুচিত শাস্তি দেয়া হোক-যে কোন সচেতন নাগরিক তা দাবি করবেন। কিন্তু এর আগে তিনি নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন, দুঃসাহসী ত্যাগী এই স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্যি সত্যিই অপরাধ বলতে কোথায়, কেন এবং কতটুকু করেছেন। তাঁর কাজে এমন কি গলদ হয়ে গেল যে, স্বাধীনতার জন্য নিরলস সংগ্রাম করেও আজ তিনি তার স্বাদ ভোগ করতে পারছেন না। বরং অনিশ্চিত জীবনের পথে ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন। স্বয়ং মেজর জলিল এর জবাব জানেন কিনা জানি না। কিন্তু ভারতীয় সম্মোহনীমুক্ত বাঙ্গালী মাত্রই সঠিক জবাব খুঁজে বেড়াবেন। সকল প্রকার প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে, সব সন্দেহের নিরসন ঘটবে, যাবতীয় অপবাদ দূর হয়ে যাবে যদি বাংলাদেশ সরকার গোটা ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণ করে একটি শ্বেতপত্র জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। কেননা, শত হলেও একজন সম্মানিতা মা প্রধানমন্ত্রী সমীপে ফরিয়াদ জানিয়েছেন, .......আমার জলিলকে গত ২৮ ডিসেম্বর (১৯৭১) হতে কে বা কাহারা ঢাকার পথে যশোর থেকে অন্যায়ভাবে অন্তরীণ করা সংক্রান্ত বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষাপূর্বক সমস্ত সক্রান্তের অবসান ঘটিয়ে আমার নির্দোষ সন্তানকে মুক্ত বাংলার মুক্ত আলোকে ফিরিয়ে দিন।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক হককথা ১৬ এপ্রিল ১৯৭২)
সকল সন্দেহের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে অবশেষে আওয়ামী লীগ সরকার মেজর জলিলের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা ঘোষণা করেন। জলিলের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন সেনাবাহিনীর এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল কর্নেল আবু তাহের। মূলত কর্নেল তাহেরের বাসভবনের সন্নিকটে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল মেজর জলিলকে। এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কর্নেল তাহের অনুজ ড. আনোয়ার হোসেন সাপ্তাহিক সময়ের ২য় বর্ষ, ২৩ সংখ্যার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘....তাহের ভাইয়ের বাসার উল্টো দিকে সিগন্যালস মেসে রাখা হয়েছিল জলিল ভাইকে। প্রায়ই যেতাম সেখানে। জলিলের অনেক সহযোগী, অনুরাগী আসতেন। তিনি ছিলেন একজন আবেগপ্রবণ মানুষ, দুর্ধর্ষ বক্তা। মানুষকে আকৃষ্ট করার চমৎকার ব্যক্তিত্ব ছিল তার। ভারতীয় বাহিনীর অন্যায় আচরণের বিরোধিতা করে একজন সেক্টর কমান্ডারের গ্রেফতার বরণ সে সময় সেনাবাহিনী ও জনমনে বিশেষ আলোড়ন তোলে। দ্রুতই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন জলিল .......।’
মাত্র ছয় মাসের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের দুই বীর যোদ্ধা পরস্পরকে অভিনব অবস্থায় দেখতে পাওয়া সে সময় সর্বমহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আওয়ামী সরকার মেজর জলিলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বিস্তর অভিযোগ আনয়ন করেছিলেন। সরকার যে সকল অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের সামনে পেশ করেছিলেন তা শুধু হাস্যকরই ছিল না বরং প্রমাণের ক্ষেত্রে সরকারি প্রক্রিয়া ছিল সাজানো এক নাটকের মতো। মেজর জলিলের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে যাকে সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থিত করা হয় তিনি ছিলেন স্বাধীনতার বিপক্ষের একজন ব্যক্তি ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন সুপরিচিত সহযোগী এবং খুলনায় কর্মরত সরকারি আমলা। রাজাকার এত তাড়াতাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের বিপরীতে স্বীয় মর্যাদা পাবে এটা তাহের বা জলিলের কাছে ছিল এক মর্মপীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা। তাহের সাক্ষীর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকার কথা জেনে তাকে ট্রাইব্যুনাল কক্ষ থেকে বের করে দেন। এভাবে কিছুদিন বিচারকার্য চলার পর এক সময়ে মেজর জলিল অভিযোগ থেকে রেহাই লাভ করেন। বিচারক হিসেবে তাহের রায়ে মন্তব্য করেন, ‘ট্রাইব্যুনাল মেজর জলিলের বিরুদ্ধে প্রকৃত কোন সাক্ষী বা প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তির নির্দেশ দিচ্ছে।’
মেজর জলিলের বিচার প্রসঙ্গ এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায় ছিল, ‘মেজর জলিলকে যেভাবেই হোক একটা সাজা দেবার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। যাতে করে জলিল পরে সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে পারেন এবং ধারণা হচ্ছিল মুজিব তাকে ক্ষমাও করে দেবেন।’
ট্রাইব্যুনালের রায়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে সত্যিকার অর্থে দোষী সাব্যস্ত হবার মতো কোনো কাজ মেজর জলিল দ্বারা সমাধা হয়নি। তবে এটাও সত্য যে, বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হবার মতো নৈতিক সমর্থনেরও তার কমতি ছিল না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তখন ভারত বিরোধী মনোভাব ছিল প্রবল। ‘শেখ মুজিবেরর’ কাছে মাথানত করা সম্ভব ছিল না বিধায় মেজর জলিল সামরিক জীবন এখানেই সমাপ্ত করে রাজনীতিতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন।
অনেক সাধনার বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী মেজর জলিল দীর্ঘ সাত মাস বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ৪ জুলাই মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পরপরই তখনকার শাসকদের দস্যুপনার বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তুলতে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন আর এ লক্ষ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক জীবনে মেজর জলিল ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের কারণে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হন। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু পূর্ববর্তী রাজনীতিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেন মেজর জলিল। সরকারের ব্যর্থতা এবং কুশাসনের প্রতিবাদে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে দ্বিতীয়বারের মত গ্রেফতার হন তিনি। উল্লেখ্য ঐ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া কয়েকশ’ জাসদ নেতাকর্মীকে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৮ নবেম্বর মুক্তি পেলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তের প্রেক্ষিতে ২৩ নবেম্বর আবারও গ্রেফতার হন জলিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের সাম্প্রতিক প্রকাশিত বইয়ের কিছু অংশ দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়-২০১৪ ‘৭ নবেম্বরের সাত-সতেরো’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক সেখানে উল্লেখ করেছেন-
‘......মেজর জলিল কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকার পিজি হাসপাতালে তার চিকিৎসা হচ্ছিল। তার দেখাশোনা করতেন করপোরাল আবদুল মজিদ। তিনি একই মামলায় সাজা পেয়েছিলেন। তিনি পুরো মেয়াদ জেল খেটে ইতোমধ্যে মুক্তি পেয়েছেন। একদিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পিজি হাসপাতালে এলেন চিকিৎসাধীন স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজকে দেখতে। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। তিনি শাহ আজিজকে নিয়ে জলিলের কেবিনে গেলেন। তাদের দেখে মজিদ পেছনে ব্যালকনির দিকে সরে গেলেন। জিয়া জলিলকে বললেন, ‘ঘর এত অন্ধকার কেন?’ তিনি নিজেই সুইচ অন করে বাতি জ্বালালেন। জলিল শুয়েছিলেন। বললেন, সারা জীবন তো অন্ধকারেই থাকতে হবে। তিনি তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন। জিয়া শাহ আজিজকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘দেখেন দেখেন ও এখনও কেমন রাগী। সব সময় ও এ রকমই ছিল। জলিল হঠাৎ জিয়াকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘হোয়াই ডিড ইউ হ্যাং তাহের?’ জিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘আমার ওপর প্রেশার ছিল। আমার কোন চয়েস ছিল না, সবাই এটা চেয়েছিল।’
৭ নবেম্বরের পরবর্তী সময়ের ঘটনা প্রসঙ্গে এতে আরও বলা হয়েছে-জাসদের নেতাকর্মীদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। গ্রেফতার এড়ানোর জন্য সবাই গা ঢাকা দেন। তবু গ্রেফতার এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। একে একে আখলাকুর রহমান, মোহাম্মদ শাজাহান, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অনেক সংগঠক গ্রেফতার হন। পুলিশের একটি দল বাগেরহাট ও পিরোজপুরের মাঝামাঝি একটি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিনকে ধরে নিয়ে আসে। প্রথমে তাকে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। খুলনা শহরে তখন একটা মেলা চলছিল। মেলা প্রাঙ্গণে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, যাতে সবাই দেখতে পান।
১০ মে রাজশাহী জেল থেকে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে লেখা এক চিঠিতে তাহের ৭ নবেম্বরের সকালে গৃহীত নীতিমালা মেনে চলার আহ্বান জানান। তিনি সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং ১৯৭৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। জাসদ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। এই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’ ও ‘অরাজকতা’ সৃষ্টির অভিযোগ এনে নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। গ্রেফতারকৃত ও পলাতক নেতাদের ‘প্রহসনের’ বিচার ও দলকে বেআইনি ঘোষণার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
২১ জুন সামরিক সরকার জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৩৩ জনের বিরুদ্ধে একটি গোপন বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করে। এদের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন সশস্র বাহিনীতে চাকরিরত। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হয়। মামলার শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল ও অন্যান্য’। অভিযুক্তরা ছিলেন মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, লেঃ কর্নেল আবু তাহের, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন, আবু ইউসুফ খান, রবিউল আলম সরদার, সালেহা বেগম, মোহাম্মদ শাজাহান, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখলাকুর রহমান, কে বি এম মাহমুদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, আনোয়ার সিদ্দিক, মেজর জিয়াউদ্দিন, নায়েক সুবেদার বজলুর রহমান, হাবিলদার মেজর সুলতান আহমদ, নায়েক সুবেদার আবদুল লতিফ আখন্দ, নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট কাজী রোকন উদ্দিন, সার্জেন্ট কাজী আবদুল কাদের, সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, করপোরাল শামসুল হক, করপোরাল আবদুল মজিদ, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, হাবিলদার শামসুদ্দিন, সিরাজুল আলম খান, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মহিউদ্দিন, হাবিলদার বারেক, নায়েক সুবেদার জালাল এবং করপোরাল আলতাফ হোসেন। অভিযুক্তদের মধ্যে সাতজন ছিলেন ‘পলাতক’। নায়েক আবদুল বারী রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। সালেহা বেগম ছিলেন অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র নারী। তিনি যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভানেত্রী ছিলেন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অভিযোগ আনা হয়েছিল।
কর্নেল ডি এস ইউসুফ হায়দারকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের একটি সামরিক আদালত গঠন করা হয়। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন কমান্ডার সিদ্দিক আহমদ, উইং কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল আলী এবং ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসান মোরশেদ। সরকারপক্ষে কৌঁসুলি ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল এ টি এম আফজাল, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল আবদুল ওহাব এবং পিপি আবদুর রাজ্জাক। অভিযুক্তদের পক্ষে ১৬ জন আইনজীবী ছিলেন। তারা হলেন আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী খান, কে জেড আলম, আমিনুল হক, মোঃ জিনাত আলী, এ কে মুজিবুর রহমান, সিরাজুল হক, মহিউদ্দিন আহমেদ, আবদুর রউফ, কাজী শাহাদাত হোসেন, শরফুদ্দিন চাকলাদার, খাদেমুল ইসলাম, আবদুল হাকিম. শামসুর রহমান, শরফুদ্দিন ভূঁইয়া ও এ টি এম কামরুল ইসলাম।
আদালত বসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রথম দিন রোল কল করা হয়। দু’বার নাম ডাকা সত্ত্বেও সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম সাড়া দেননি। তখন একজন তাকে চিনিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘আমার নাম ঠিকভাবে ডাকা হয়নি বলে আমি জবাব দিইনি।’ চেয়ারম্যান বললেন, আপনার নাম তো সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। রফিক জবাবে বলেন, না আমার নাম সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বীর প্রতীক। পুরো নাম না বললে আমি জবাব দেবো না। আদালত তার দাবি মেনে নেন। দ্বিতীয় দিনেও গোলমাল হলো। সার্জেন্ট রফিক এফআইআর দেখতে চাইলেন। যখন আদালত থেকে বলা হলো এটা এখন সরবরাহ করা যাবে না তখন সার্জেন্ট রফিক বললেন, তাহলে আমাকে যেতে দিন, আমি আমার সেলে গিয়ে বিশ্রাম নেবো। চেয়ারম্যান রেগে গিয়ে বললেন, শাট আপ অ্যান্ড সিট ডাউন। সার্জেন্ট রফিক চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে জুতা ছুঁড়ে মারলেন। দেখাদেখি আরও কয়েকজন জুতা ছুঁড়লেন। রব দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করলেন। আদালতের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা দৌড়ে পালালেন। ওই দিনের মতো আদালত পণ্ড হয়ে গেল। পরদিন থেকে তাদের আদালত কক্ষে খালি পায়ে হাতকড়া পরিয়ে আনা হলো। এভাবেই চলতে থাকলো আদালতে আসা-যাওয়া। আদালত চলার সময় অভিযুক্তরা এমন ভাব করতেন, যেন তারা কোন জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এই ‘অবৈধ আদালতের’ ওপর তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। হয়তো কেউ কারও কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকেন, কেউ-বা আপন মনে গলা ছেড়ে গান ধরেনঃ ‘মা, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শক্র এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি।’ ১৫ জুলাই রায় ঘোষণার কথা ছিল। রায় দেয়া হলো ১৭ জুলাই। রায় ঘোষণার সময় অভিযুক্তরা সবাই হইচই, চিৎকার করছিলেন। রায়ে তাহের, জলিল ও আবু ইউসুফের ফাঁসির আদেশ হয়। পরে রায় সংশোধন করে জলিল ও ইউসুফকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আখলাকুর রহমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মোঃ শাজাহান ও কে বি এম মাহমুদসহ ১৫ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২১ জুলাই ভোর চারটায় তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়......।’
সামরিক আদালতে মামলায় জলিলের ফাঁসির হুকুম হলে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ তিনি মুক্তি লাভ করেন। জেলে থাকাকালীন মানব রচিত বিভিন্ন মতবাদ এবং ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করায় ক্রমে ইসলামী আন্দোলনের দিকে ধাবিত হন মেজর জলিল এবং ১৯৮৪ সালের ৩ নবেম্বর জাসদ থেকে পদত্যাগ করে বাম রাজনীতির যাবনিকা টানেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর ‘কৈফিয়ত ও কিছুকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন-
‘আমি দেশ-মাতৃকার একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতির কাছে আমি একজন যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। দেশের জনগণকে শোষণ-জুলুমের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই আমি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীকে পরাভূত করতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম এ কথা সত্য। কিন্তু স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই মিত্র বাহিনী কর্তৃক দেশের সম্পদ লুণ্ঠন এবং শাসক আওয়ামী লীগের সীমাহীন উদাসীনতা, ষড়যন্ত্রমূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করে এ সত্যটি অনুধাবন করতে আমার মোটেও বেগ পেতে হয়নি যে, দেশ ও জাতি এক শোষকের হাত থেকে মুক্ত হলে ও অপর একটি নতুন শোষকগোষ্ঠীর অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। সুতরাং দেশ ও জাতিকে শোষণমুক্ত করার লক্ষ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়নি, বরং মুক্তিযুদ্ধ আরেকটি নতুন স্তরে উপনীত হয়েছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তে ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল আধিপত্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর সহায়তায় দেশীয় নব্য শাসক আওয়ামী লীগই সেই শোষকের স্থানটি দখল করল। তাই নব্য শাসক-শোষকদের মূল্যেৎপাটন ব্যতীত শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করা অসম্ভব। এই লক্ষ্য অব্যাহত রাখতে হবে ‘সীমাহীন সমর’। আমার রচিত প্রথম গ্রন্থ ‘সীমাহীন সমর’ সেই কাক্সিক্ষত যুদ্ধের ইঙ্গিতস্বরূপ আত্মপ্রকাশ করল ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তারিখে। আমি ছিলাম যুদ্ধ ফেরত একজন বিজয়ী সৈনিক। কোন ধরনের পরাজয়বোধ কিংবা ভীতি ছিল আমার অজানা। আমি জনস্বার্থ রক্ষা করার একজন প্রহরী, আমি চেয়েছিলাম শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে। হিসেবি বণিকের পদক্ষেপ আমার হতে পারে না। মুক্ত সাহস-নির্ভর পদক্ষেপই আমার কাম্য। তাই ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর তারিখে সমমনাদের সহকারে গঠন করেছিলাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। এই দলটির লক্ষ্য ছিল সমাজ দেহ থেকে সব রকম শোষণ-জুলুমের অবসান ঘাটিয়ে বাংলাদেশ ‘কৃষক-শ্রমিক রাজ’ প্রতিষ্ঠা করা। এই দলটির দার্শনিক ভিত্তি ছিল ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ এবং রাজনৈতিক দর্শনের নাম ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। বস্তুবাদী এই দর্শনটি শোষিত মেহনতি মানুষের মুক্তির সনদ বলে পরিচিত হলে ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নাস্তিকবাদ ভিত্তিক হওয়াতে এ দেশের তরুণ যুবক যাদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন ধর্মভিত্তিক গঠিত, তাদের মনে ঐ দর্শন জন্ম দেয় এক অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের। দলীয় আচার-আচরণে তার নাস্তিক বাদের চর্চা করলে ও ব্যক্ত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে তারা কখনো ধর্মের প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। ব্যক্তি জীবনে এই দিবসত্তা ধারী পার্টি নেতাকর্মী না হতে পেরেছে সম্পূর্ণভাব বস্তুবাদী, না হতে পেরেছে আস্তিকবাদের অনুসারী। সত্যনিষ্ঠ, নিবেদিত, কর্মঠ এবং লড়াকু হাজার হাজার নেতাকর্মী জাসদের পতাকাতলেই মুক্তির লড়াই আন্তরিকতার সাথেই অব্যাহত রেখে অকাতরে প্রাণও বিলিয়ে দিয়েছে। এ লড়াই মেহনতি মানুষের মুক্তির বিপ্লবী লড়াই-ই ছিল তাতে ও কোন সন্দেহ নেই। এই লড়াইয়ে আমি নিজেও কখনো পেছনের সারিতে ছিলাম না। দীর্ঘদিন কেবল কারাজীবনই ভোগ করিনি, ফাঁসির মঞ্চেরও মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমার ওপর বেশ কয়েকবার গুলীও চলেছে। সংসারহীন, সম্পদহীন ভবঘুরের মত জীবনও কাটিয়েছি। এসব কিছুই সত্য। সত্য জাসদ নেতাকর্মীদের আন্তরিকতা; সত্য তাদের বিপ্লবী চেতনা; সত্য তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা। কিন্তু কেবল ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্তরিকতা কিংবা বিপ্লবী চেতনাই শোষিত মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। এগুলো একজন বিপ্লবী চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং অত্যাবশ্যকীয় গুণ। তবে রাজনৈতিক দর্শনের সঠিকতা এবং বাস্তবতার নিরিখে সেই মনোনীত দর্শনের সঠিক লড়াইয়ে বিজয়ের চাবিকাঠি। এই চাবিকাঠির অনুপস্থিতিতে কোন ত্যাগ কিংবা শ্রমই বিজয়ের পথ প্রশস্ত করবে না। নিরবচ্ছিন্ন এবং নিবেদিত সংগ্রামের মাধ্যমে ত্যাগ এবং আত্মাহুতি সীমাহীন পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে; সংগ্রাম সংঘর্ষমুখর এবং উত্তেজনায় ভরপুর হতে পারে; শোষক শাসককূল ভীত সন্ত্রস্ত এবং নড়বড়েও হতে পারে কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে রাজনৈতিক দর্শনের সঠিক অনুশীলন এবং রণকৌশলের আবর্তন আন্দোলনের ধারা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যায়। জাসদ রাজনীতির মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতির কাছে আমরা নিঃসন্দেহে অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছি এবং জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছি। শুধু কেবল জনপ্রিয়তা লাভই নয়, জাসদ দেশ ও জাতির কাছে একটি সাচ্চা দেশ প্রেমিক বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিল-একথা সত্য। এতকিছু সত্ত্বেও সেই জাসদেরই অবক্ষয়ের ধারা এতো দ্রুত ঘটলো কোন এ প্রশ্নটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের খাতিরেই মূল্যায়নের দাবি রাখে। এ দাবি কেবল আমারই নয়, এ দাবি হাজার হাজার জাসদ নেতাকর্মীর দাবি -এ দাবি ইতিহাসের দাবি। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ ভিত্তিতে গঠিত জাসদের ধর্মধারা অব্যাহত রাখতে গিয়ে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম তা হচ্ছে নিম্নরূপ :
ক) আমাদের লক্ষ্য ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এ বিষয়টি সংগঠনের গঠনতন্ত্র, কর্মসূচি এবং সাংগঠনিক অন্যান্য দলিল পত্রে ঘোষিত এবং লিখিত থাকলেও জাসদের শুরুতে এই দর্শনের জ্ঞান জাসদ নেতাকর্মীদের কারুর মধ্যেই পরিপূর্ণভাবে ছিল না। অধিকাংশেরই ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান পর্যন্ত ছিল না।
খ) জাসদ নেতাকর্মীদের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে  জ্ঞান না থাকার ফলে কেবল বিশ্বাস, অন্ধ আবেগ এবং রোমান্টিসিজম প্রশ্রয় পেয়েছে। আচার-আচরণে বিপ্লবী এবং বিদ্রোহের ভাব ঠিকই ফটে উঠেছে, কিন্তু দর্শনগত জ্ঞানের অভাবে বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটেনি।
গ) বিভিন্ন স্তর, পেশা এবং শ্রেণী থেকে ছুঠে আসা অসংখ্য নেতাকর্মীর সমন্বয়ে জাসদ গড়ে উঠেছিল একটি সার্থক গণসংগঠন হিসেবে। অথচ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ হচ্ছে একটি শ্রেণী সংগঠক গড়ে তোলার রাজনৈতিক দর্শন। এই দর্শন কেবল শ্রেণী সংগঠনেরই দর্শন গণসংগঠনের রাজনৈতিক দর্শন নয়। একটি ‘মাল্টি ক্লাস সংগঠন’ (Multi Class mass organisation).
সর্বহারা শ্রেণীর দর্শনের ভিত্তিতে এগুতে পারে না বলেই পরবর্তীতে জাসদের অনিবার্য কারণেই বিভিন্নমুখী অন্তর্দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
(ঘ) তৃতীয় বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী গণআন্দোলনসমূহ সশস্ত্র না হওয়ার ফলে যেমন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং হয়েছে, তেমনি আবার জনগণ বিচ্ছিন্ন-সশস্ত্র বিপ্লবও ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। সার্থক ‘জন-গণবিপ্লবের’ জন্য প্রয়োজন আন্দোলনরত জনগণকে ঠিক সময়মত সশস্ত্ররূপে সজ্জিত করা। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে এগুতে থেকেও জাসদ সেই নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই আন্দোলনকে সশস্ত্র রূপ প্রদান করে ফলে দলে জন্ম নেয় সন্দেহ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং আরো বিভিন্নমুখী সংকট।
(ঙ) দলীয় জীবনে জাসদের নেতাকর্মীরা ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দেয়ার ফলে নৈতিকতার ক্ষেত্রে অবক্ষয় ঘটে, ব্যক্তিজীবনে আসে বিশৃঙ্খলা এবং ধর্মীয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধে পরিচালিত সমাজদেহ থেকে নিজেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও সমাজে বসবাসরত জনগণকে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সাংস্কৃতি জীবন এবং মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে মোটেও সক্ষম হয়নি। প্রচলিত পারিবারিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনধারা থেকে কেবল নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখলেই বিকল্প সংস্কৃতি জন্ম নেয় না এবং এই ধরনের রণকৌশল অবলম্বন সমাজে প্রচলিত নীতি-নৈতিকতা, আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি তাচ্ছিল্য, উপহাস এবং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, যা প্রকারান্তরে বিপ্লবী আন্দোলনের বিপক্ষে চলে যায়।
(চ) ইসলাম ধর্ম এ দেশের শতকরা ৯০ জন গণমানুষের কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসই নয়, ইসলামভিত্তিক নীতি- নৈতিকতা, আচার, অনুষ্ঠান, উৎসব-পর্ব, সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং এদেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানান ঘটনার সাথে ইসলাম ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িত। জন্ম পর্ব থেকে শুরু করে জানাযা পর্যন্ত ইসলামের নীতি-নির্দেশের আওতায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন। এমন একটি জীবন দর্শনকে অবহেলা, উপেক্ষা কিংবা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে চলার নীতিকে বাস্তবসম্মত কিংবা বিজ্ঞানসম্মত বলা যায় না। প্রগতিশীল আন্দোলনের স্বার্থেই ইসলাম ধর্মের বিজ্ঞান সম্মত মূল্যায়ন অত্যাবশ্যকীয় বলে আমি মনে করি, কারণ ইসলাম শোষণ-জুলুম, অন্যায়, অসুন্দরসহ সবরকম স্বৈরশাসন এবং মানুষের ওপর অবৈধ প্রভুত্বের ঘোর বিরোধী। ইসলাম পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং রাজতন্ত্র উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা ইসলামে নিষিদ্ধ, কারণ সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহরই। মানুষ হচ্ছে তার কেবল প্রয়োজন মেটানোর জন্য আমানতদার বা  কেয়ারটেকার।
ইসলাম ঘোষণা দেয় ‘অন্যায় কর না, অন্যায় করতে দিও না’-এটা অন্যায় বিরোধী চিরন্তন লড়াইয়ের ঘোষণা। ইসলাম ঘোষণা দেয় ‘আল্লাহই কেবল মানুষের একমাত্র প্রভু, মানুষ মানুষের প্রভু হতে পারে না’-এই বিপ্লবী ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্রষ্টা মানুষকে মূলত চিরস্বাধীন হিসেবে অভিহিত করেছেন। ‘তুমি যা আহার করবে, তোমার ভৃত্যকেও তাই আহার করতে দিও। তুমি যা পরিধান করবে, তোমার ভৃত্যকেও তাই পরিধান করতে দাও।’ এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসলাম যে সাম্যের বাণী এবং দৃষ্টান্ত রেখে গেছে, তা মনে রেখেই বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তির লড়াইয়ের জন্য দর্শন নির্ধারণ করা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করাকে আমি এক ধরনের গোঁড়ামি এবং প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ বলে মনে করি। জাসদসহ এদেশের প্রত্যেকটি তথাকথিত বামপন্থী দলের মধ্যে বাস্তবতা অস্বীকার করার প্রবণতা প্রচ-ভাবে বিরাজমান। আমি মনে করি, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অথবা মার্কসবাদ-এর অনুসারীদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যই হচ্ছে, সমাজদেহে বিরাজমান প্রত্যেকটি ঘটনা বা বিষয়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা, যাতে বিপ্লবের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কিংবা বিপ্লবের সহায়ক উপাদানসমূহের প্রকৃতি চিহ্নিতকরণে সম্ভব হয়। জাসদ রাজনীতিতে এ সুযোগের কোন অবকাশই ছিল না।
এখানে চীনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগান্তকারী বিপ্লবী নেতার দু’টি মন্তব্য উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনে। প্রথমটি হচ্ছে: No investigatio, no right to talk অর্থাৎ অনুসন্ধান ব্যতীত কথা বলার অধিকার থাকে না, অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখি ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানঅর্জন কিংবা গভীর অনুসন্ধানের অবর্তমানেই ইসলামকে ঢালাওভাবে প্রতিক্রিয়াশীল বলে অভিহিত করা হয়। এই আচরণকে বিপ্লবী আচরণ বলে আখ্যায়িত করা যায় কিনা তা বিপ্লবের প্রয়োজনেই গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। মাও-সেতুংয়ের ভেবে দেখতে হবে। do not cut the feet to fit the shoes, rather cut the shoes to fit the feet. অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন পা কেটে জুতো মাপসই হয়। এক্ষেত্রে মাও সেতুং দর্শনকে দেশজাতির বিরাজমান বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখেই অনুশীলন করার ইঙ্গিত প্রদান করেছেন, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কিংবা এড়িয়ে নয়।
এক্ষেত্রে মার্কসবাদের উদ্যোক্তা স্বয়ং কার্ল মার্কস নিজেও যে মন্তব্য করেছেন, তা-ও বাস্তবতাকে স্বীকার করেই অগ্রসর হওয়াকে অপরিহার্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি মন্তব্য করেছেন- ‘Concreete analysis of the concerete situation is the essence of Marxisum’ অর্থাৎ বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ হচ্ছে মার্কসবাদের মর্ম কথা। বাংলাদেশের সমাজদেহে অন্যান্য বাস্তবতার সাথে ইসলাম ধর্ম হচ্ছে একটি জাগ্রত এবং জীবন্ত আবেগ। ইসলাম একটি Living and practicing religion অর্থাৎ ইসলাম হচ্ছে জীবন্ত এবং নিয়মিত অনুশীলিত একটি ধর্ম। ইসলাম এদেশের গণমানুষের কাছে একটি সার্বিক জীবনসত্তাবোধ। এই গণমানুষের মুক্তির প্রশ্নটি ঐ সার্বিক জীবন সত্তাবোধকে বাদ দিয়ে মীমাংসিত করার যে কোনো প্রয়াসই অবৈজ্ঞানিক এবং অবাস্তব হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য।

Post a Comment

0 Comments