Recent Tube

টুকটাক সংলাপ- ৫; জিয়াউল হক।



              টুকটাক সংলাপ- ৫



আপন আলোয় জ্বলে উঠুন।  

আকাশে ভাসতে থাকা পূর্ণিমার চাঁদ পৃথিবীকে জোৎস্না দেয়। আমরা সেই জোৎস্না উপভোগ করি। চাঁদের চেহারা, তার অবয়ব সেই ৩০ লক্ষ মাইল দূর থেকেও কি চমৎকার মনে হয় আমাদের কাছে। কবিরা চাঁদের জোৎস্নালোকে ভাবালুতায় আক্রান্ত হন, কবিতা লেখেন। কবি নজরুল তো তাঁর একটি বিখ্যাত গানে লিখেই ফেলেছেন চাঁদেরে কে চায়? জোৎস্না সবাই যাচে’।

অবুঝ শিশুরা আকাশ পানে দুটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাদা ধবধবে চাঁদটাকে বিষ্ময়ভরা চোখে ডাকতে থাকে। মায়েরা ডাকেন ‘আয় আয় চাঁদ মামা বলে’। ডাকেন আর বলেন; ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’! কতোজন নিজ নিজ প্রিয় ‘চাঁদমুখ’ দেখার জন চাতক চাতকির মতো দিন রাত পথ চেয়ে থাকে! গান, গল্প আর কবিতায়, ছড়ায় আর ছন্দে সর্বত্রই যেন চাঁদের জয়জয়কার।

চমৎকার সব ভাব আর ভঙ্গিমায় চাঁদের প্রতি এই ভালোবাসার প্রকাশ মানব মনের আবেগ, অনুভুতি আর ভালোবাসার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আদিকাল থেকেই তা চলে আসছে।

মৃত আগ্নেয়গীরি, শুকিয়ে যাওয়া লাভার দাগ, খাড়া-খন্দক, গর্ত, গভীর খাদ গহ্বর এসব দিয়ে চাঁদের উপরিভাগ ভরপুর। প্রকৃতপক্ষে চাঁদেও দেহ অত্যন্ত অমসৃণ, অসমতল, দেখতে মোটেও সুশ্রি নয়, যেরকম সুশ্রি চাঁদকে আমরা, এই পৃথিবীবাসী দূর থেকে দেখি আর সুন্দর মোহনীয় হিসেবে তাকে ভাবি, বা কল্পনা করি।  

বড়ো বড়ো পাথরের উপস্থিতি চাঁদের উপরিভাগকে অসমতল, অমসৃণ ও রুক্ষ বানিয়েছে। এখানে না পানি আছে আর না আছে বাতাস। ফলে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই। নিস্প্রাণ একটি উপগ্রহ। অথচ এই নিষ্প্রাণ উপগ্রহই আমাদেরকে তার সৌন্দর্য দিয়ে বিমোহিত করে রাখে।  

বিষয়টা মাথায় রেখে একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করে আসুন। মনোহর ও চিত্তাকর্ষক হলেই তা সুন্দর হয় না। আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় মনে হলেই তা নিরেট খাঁটি ও বিনা প্রশ্নে, বিনা যাচাইয়ে গ্রহণীয় হবে, এমন কোন কথা নয়।  
আমাদের আশে পাশে এমন অনেক ব্যক্তির সন্ধান আমরা পাই, এমন অনেক রথী মহারথীদের দেখতে পাই, যাদের কার্যক্রম, চলা ফেরা, কথা-বার্তা দূর থেকে অনেক চমকপ্রদ বলে মনে হয়। আমাদের মন ও মননের উপরে অতি সহজেই প্রভাববিস্তার করে। আমরা অনেক সময়ই, বলা চলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সব রথী-মহারথীদের জীবনকে, তাদের জীবানাচারকে আমাদের জন্য অনুসরণীয়, অনুকরণীয় হিসেবে গ্রহণ করে নেই। তাদের অনুসরণ করে চলি জেনে বা না জেনে। অন্ধু অনুসরণ।

আধুনিক যুগে ইলেক্ট্রনিক ও মাল্টিমিডিয়ার বদৌলতে এরকম একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে। একে ঘিরে একটা সংস্কৃতিই চালু হয়েছে, আমরা নাম দিয়েছি 'সেলিব্রিটি কালচার'। অদ্ভূত এই প্রবণতার সবচেয়ে সহজ শিকার হলো কিশোর কিশোরি, তরুণ তরুণী এবং দু:খজনকভাবে নারী সমাজ। 

আরও একটা সমাজ রয়েছে যেখানে বয়স কোন বিবেচ্য বিষয় নয়, যে কোন বয়সের নারী পুরুষই এরকম সেলিব্রিটি কালচারের শিকার হয়ে পড়েন। তারা হলেন সেই তারা, যারা জ্ঞানের স¦ল্পতার কারণে নিজেদের আত্মপরিচয়ে নিয়ে সংকটে ভুগেন।

এই সেলিব্রিটি কালচারকে বুঝতে হলে এতোক্ষণ যে চাঁদের কথা বললাম, সেটাকে বুঝতে হবে। চাঁদের গঠন, গড়ন ও জোৎস্না হিসেবে পরিচিত স্নিগ্ধ আলোর উৎসকে যদি কিছুক্ষণের জন্য আমাদের দৃষ্টিসীমায় রেখে এইসব সেলিব্রিটিদের বিচার করি, তা হলে দেখতে পাবো আমাদের চোখে আকর্ষণীয় হিসেবে ধরা দেয়া এই সব সেলিব্রিটিও ঐ চাঁদের মতোই। এদের অনেকেরই নিজস্ব স্বকীয়তা বলে কিছু নেই। 

আমাদেরকে দেবার মতো এদের নিজস্ব তেমন কিছু নেই। দুরে থেকে যতোই আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন, কাছে গেলে দেখবেন তাদের চেহারা কতোই না কদর্যতায় ভরপুর। তাদের জীবনের নানা চোরা গহ্বর আপনাকে ব্যাথিত করবে বিতৃষœ করে তুলবে। 

কাজেই তথাকথিত সেলিব্রিটিদের অন্ধের মতো অনুসরণ না করে নিজের ভেতরের জগতকে আলোকিত করার কাজে মন দিন। একদিন দেখবেন আপনি নিজেই নিজের ভেতরের আলোতে দশদগিন্তকে আলোকিত করেছেন। কাজেই, আপন আলোয় জ্বলে উঠুন।
-------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments