Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস্- ৪২, জিয়াউল হক।

      দ্যা চয়েস ইজ ইউরস্- ৪২,


    আগেই বলেছি, সেই রাত ছিল এক ঘোর আঁধারে ভরা আমাবশ্যার রাত। এতিম শিশু মুহাম্মদের জীবনে কালো আঁধার নেমে এলো। জন্মের আগে বাবা হারানো শিশুটা মাত্র ছয় বছর বয়সে এসে এবারে তাঁর মাকেও হারালো! পৃথিবীতে প্রকৃত অর্থেই একজন এতিম হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো এই জনমানবহীন প্রান্তরে!
জনমানবহীন প্রান্তরে পথের ধারঘেঁেষ ঘন আঁধার রাতে এক নারী ও শিশুর কান্না শুনে পথচলা অন্যান্য কাফেলার (সম্ভবত) কয়েকজন এগিয়ে এলে তাদের সহায়তায় উম্মে আইমান বিবি আমিনাকে ঐ পাহাড়ের উপরেই কবর দেন।

  দাফন শেষে নিজেদের রসদ, শিশু মুহাম্মদ’সহ অন্যান্য জিনিস গুছিয়ে নিয়ে মক্কায় ফেরার যাত্রা শুরু করতে পাহাড় থেকে নীচে উটের কাছে নেমে এসে উম্মে আইমান দেখেন পেছনে শিশু মুহাম্মদ নেই। তিনি আবার ছুটলেন পাহাড়ের উপরে। গিয়ে দেখেন, এতিম শিশুটি, (আমার প্রিয় মুহাম্মদ সা.) দু’হাত এলিয়ে দিয়ে মায়ের কবরটাকে আঁকড়ে ধরে তার উপরে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন!
অর্থাৎ দাফন শেষে উম্মে আইমান যখন নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে পাহাড় থেকে নীচে আসর সময় শিশু মুহাম্মদ উম্মে আইমানের লক্ষ্যেই চুপিসারে পেছন থেকে আবারও উঠে গেছেন পাহাড়ে। মাকে সেখানে পাথর চাপা দিয়ে রেখে যেতে তার মন সায় দেয়নি, কিংবা তিনি আরও একবার মায়ের কবরটাকে দেখে যেতে চেয়েছেন! আহা মাত্র ছয়বসরের বাবা হারা শিশুটি, তার সবচেয়ে আপন আশ্রয়স্থল মাকেও হারালো চিরদিনের জন্যই!!

   আসুন আরও একবার কল্পনার চোখে দেখে নেই এতিম সেই শিশু প্রিয় মুহাম্মদ সা, এঁর করুণ সেই মুখখানা। মৃত্যুর কথা তিনি ততোদিনে কতোবার যে শুনেছেন, তার কি ইয়াত্তা আছে? বাবার ইন্তেকালের খবরটা ততোদিনে নানা সুত্র থেকে জেনেছেন, শুনেছেন নিজের মায়ের মুখেও।

   বাবা ইন্তেকাল করেছেন, তাই তিনি নেই। যিনি ইন্তেকাল করেন তিনি আর এ দুনিয়ায় থাকেন না, তাই তাকে দেখাও যায় না! আজ মাও ইন্তেকাল করলেন? তার মানে মাকেও আর দেখা যাবে না! মা’ও চলে গেলেন! ছয় বছর বয়সী বাচ্চার ভাবনা এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে?
 তাঁর কাছ থেকেই আমরা জানি, মা আমিনার যখন শেষ সময়টুকু ঘনিয়ে এলো, তিনি উম্মে আইমানের কানের কাছে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসা শক্তির সবটুকু গলায় তুলে এনে ফিস ফিস করে বলতে পেরেছিলেন তাঁর ছেলেটাকে যেন তিনি দেখে রাখেন! তাকেই ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন, তিনিই যেন তাঁর এতিম ছেলেটার মা হয়ে থাকেন।

   পাশ থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা শিশুটি আছড়ে পড়েছিলেন মায়ের বুকে, কচি দু’টো হাত দিয়ে  ‘ইয়া উম্মি’ বলে মায়ের গলা আঁকড়ে পড়েছিলেন শিশু মুহাম্মদ! গর্ভজাত সন্তানকে বুকের উপরে নিয়েই মা ঠিক ঐ মহুর্তে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন জোরের সাথে একটা নি:শ্বাস টেনে; শেষ নি:শ্বাস! কচি বাচ্চাটা তখনও অঝোরে কেঁদে চলেছে মৃতা মায়ের বুকে!
 হৃদয়চূর্ণ করা এ দৃশ্য উম্মে আইমানকে কতোটা তাড়িত ও প্রভাবিত করেছে, সেটা পরবর্তিতে তাঁর সারা জীবনের ঘটনাপ্রবাহ ও এই এতিম শিশুটির জন্য তার মায়া ও ত্যাগের মধ্যেই ফুটে উঠে। এর আলাদা কোন ব্যখা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না।
উম্মে আইমান শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে আবার রওয়ানা হলেন মক্কার পথে। যে উটের হাওদায় একটু আগেও মা আমিনা আর দাসী উম্মে আইমানের সাথে শিশুটি ছিল, সেই উটের পিঠে এখন কেবলই উম্মে আইমান আর সে, মা নেই!
চলমান উটের পিঠে হাওদার ভেতর থেকে পাথরচাপা কবরের দিকে তাকিয়ে এতিম শিশুটির সজল চোখজোড়া আর কচি হাতে উম্মে আইমানের কামিজের কোণ ধরে রাখা তার ব্যাথাতুর মুখ যেন আমাদের কল্পনায় ভেঁসে উঠে! দেড় হাজার বছর পরেও আমরা আহত হই, ব্যাথায় আমাদের নিজেদের চোখই ভিজে আসে!
 করুণ এ ঘটনাটি ছোট এ শিশুর মনে গভীর রেখাপাত করে রেখেছে এর পরে সারাটা জীবন। এমনকি, তিনি পরিণত বয়সে এই পথে যাবার সময় একবার মায়ের কবরের পাশে এসে হাঁটু গেড়ে, তাঁর পা জোড়াকে একত্রে টেনে, দুই হাঁটুর মধ্যে নিজের মাথাটা লুকিয়ে অঝোরে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন দীর্ঘক্ষণ!

  যা হোক, সেই রাতের করুণ এ দৃশ্যটি উম্মে আইমানের মনে তাৎক্ষণিকভাবে এতোটাই দাগ কেটে যায় যে, তাঁর বাঁকি জীবনটাকে তা এক বিশেষ ধাঁচে ঢেলে সাঁজাতে শুরু করে ঐ মহুর্ত থেকেই। তিনি হয়ে উঠেন এই এতিম শিশুটির মা, মায়ের পরে মা। পরবর্তিতে নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা প্রিয় মুহাম্মদের ভাষায়; ‘উম্মি বা’দা উম্মি’ (আমার মায়ের পরে মা) হিসেবে!
মা আমিনার অসুখটা কেমন ছিল? হঠাৎ করেই তিনি কি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার কোন তথ্য আমাদের কাছে না থাকলেও পুরোনো ইতিহাস ঘেঁটে বিশিষ্ঠ মুসলিম মার্কিন গবেষক ও পন্ডিত উৎ ঝযধননরৎ অযসবফ জানাচ্ছেন; মা আমিনা সম্ভবত হিটষ্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
  তাঁর এ গবেষণা যদি যথার্থ হয়ে থাকে, তা হলে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, মা আমিনা ও উম্মে আইমান এবং শিশু মুহাম্মদের এই সফরটা হয়েছিল গ্রীষ্মকালে, তথা, মে মাস থেকে আগষ্ট মাসের মধ্যে কোন এক সময়কালে (৫৭৬ খৃষ্টাব্দ)।
এ মতের সাথে আমরাও একমত, এই কারণে যে, আমরা ইতোপূর্বেই জেনেছি যে, আব্দুল মুত্তালিব বারণ করেও যখন আমিনা বিবিকে ইয়াসরিবে যাওয়া থেকে নিবৃত করতে পারলেন না, তখন তিনি সফরের সকল আয়োজন সম্পন্ন করে সিরিয়াগামী একটা কাফেলার সাথে তাদের ইয়াসরিবের পথে পাঠিয়ে দেন। আর আমরা এটাও জানি যে, মক্কা থেকে সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা আসা যাওয়া করতো গ্রীষ্মকালে (সংক্ষেপকৃত)।
---------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments