Recent Tube

একাত্তরের যুদ্ধঃ ভারতের প্রাপ্তি ; মীর সালমান শামিল।

একাত্তরের যুদ্ধঃ ভারতের প্রাপ্তি 
-----------------------------------
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে একাত্তরের যুদ্ধে ১ হাজার ৯৮৪ জন ভারতীয় নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৭৬৯, নৌবাহিনীর ২০৪ এবং বিমানবাহিনীর ১১ জন। এই সংখ্যা ধরেই তাদেরকে ৫ লাখ রুপি করে সম্মাননা দেয়ার সিদ্ধান্ত  নিয়েছে সরকার। এই জীবন দানের মাধ্যমে ভারত তার চিরশত্রু পাকিস্তানকে দুর্বল করে মানসিক ভাবে, আর্থিকভাবে এবং চেতনার দিক থেকে এবং অর্জন করে বিজয়। এই যুদ্ধে ভারতের আর্থিক প্রাপ্তির কোন বিস্তারিত লেখা নেই। বিভিন্ন জায়গার চম্বুকাংশ উল্লেখ করছি,

#এক,

যুদ্ধের কারনে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরনার্থী, তাঁদের খরচ, ভারতের অন্যান্য সকল প্রকার ক্ষতিপূরনের বিপরীতে আর্থিকভাবে তাঁরা পাকিস্তান থেকে ক্ষতিপূরণ নেয়। এছাড়াও যুদ্ধ গবেষক এ এস এম সামছুল আরেফিন তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ বইয়ে উল্লেখ করেন ভারত সেই সময় বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে ১৬ কোটি ৮১ লক্ষ ৩ হাজার ৭শত ২৭ ডলার সাহায্য পায়।

#দুই,

পাকিস্তান যুদ্ধে হেরে যাবার পর আর্থিকভাবে ভারত সরকার পাকিস্তান থেকে ক্ষতিপূরণ নেয়। ভারতীয় অফিসিয়াল হিসেবে মোতাবেক পাকিস্তানের কাছ থেকে ভারত সর্বমোট ৫৪৩ কোটি ৫১ লাখ ১৪ হাজার দুইশত  চুরানব্বই রুপি ক্ষতিপূরণ আদায় করে।

#তিন- লুটপাট 

স্বাধীনতার পর ভারতীয় বাহিনী ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে। এই সময়ে কি পরিমাণ লুটপাট তাঁরা করে তা বর্ণনাতীত। নিচে একটা নমুনা-

ঢাকা লুট- 

ভারতীয় বাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অস্ত্র ছাড়াও ফ্রিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ ট্রাকে ভর্তি করে ভারতে পাচার করেন। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে এই লুটপাট নিয়ে লিখলেন-
‘ঢাকায় এতসব বিদেশি জিনিস পাওয়া যায়! এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা। রেফ্রিজারেটর, টিভি, টু-ইন-ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার- এসব ভর্তি হতে লাগলো ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে।

যশোর লুট-

যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক যান, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ, প্রাইভেট কার সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই লুণ্ঠন এমন বেপরোয়া আর নির্লজ্জ ছিল যে বাথরুমের আয়না এবং ফিটিংস্ও সেই লুণ্ঠন থেকে রেহাই পায়নি। নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর এই লুটপাটে বাঁধা দেন। এতে ভারতীয় বাহীনি মেজর জলিলকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসের একটা ছোট্ট ঘরে বন্দী করে রাখে। শীতের মধ্যেও তাকে গরম কাপর দেওয়া হয় না। পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারও মেজর জলিলকে বন্দী করে রাখে। ৫ মাস পরে ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই তিনি মুক্তি পান। অন্য সব সেক্টর কমান্ডারদের বীর উত্তম উপাধি দেওয়া হয়৷ তবে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটে বাঁধা দেবার "অপরাধে" অপরাধী মেজর জলিলকে কোন এক অজ্ঞাত কারনে শেখ মুজিব সরকার কোন রকম পদক দেয় না। 

খুলনা লুট- 

খুলনা লুটতরাজ নিয়ে ২১ শে জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ব্রিটেনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাংবাদিক মার্টিন ঊলাকট দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২২ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন করে "ভারতীয়রা পুরো ফ্যাক্টরি লুটপাট করেছে" এই শিরোনামে। এতে তিনি খুলনায় লুটপাট নিয়ে লিখেন ; 

“Systematic Indian army looting of mills, factories and offices in Khulna area has angered and enraged Bangladesh civil officials here. The looting took place in the first few days after the Indian troops arrived in the city on December 17” (Martin Woollacott, Indians ‘loot whole factory, The Guardian, Jan 22, 1972).

সে সময় খুলনার ডিসি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট সচিব ডক্টর কামাল সিদ্দিকী। তিনি সে সময় ভারতীয় বাহিনীর এই লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখে বলেন; কেবল খুলনা থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টাকার পরিমাণ লুটপাট করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। কামাল সিদ্দিকী পরবর্তীতে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে করা তার পিএইচডি থিসিসে বাংলাদেশের দরিদ্রতার কারণ হিসেবে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া সকল অস্ত্র এবং ৮৭ টি ট্যাংক নিয়ে যায় যার মূল্য ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কামাল সিদ্দিকি আরো লিখেন ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটের মধ্যে অস্ত্র ছাড়াও ছিল মজুদকৃত খাদ্য  শস্য, কাঁচা পাট,সুতা, গাড়ি, জাহাজ,শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিন ও যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য।  কামাল সিদ্দিকীর মতে সব মিলিয়ে কম করে ধরলেও এই লুটপাটের পরিমাণ কেবল খুলনা জেলাতে ছিল তৎকালীন হিসেবে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সারা বাংলাদেশের ১৯টি জেলা থেকে লুটাপাটের পরিমাণ কেমন হতে পারে সেটা অনুমান অসম্ভব নয়।

এই লুটপাটের বাহিরেও ছিল চোরাচালান ও কালোবাজারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্পদের পাচার। কামাল সিদ্দিকী তার থিসিসে দেখিয়েছেন কিভাবে বৈদেশিক সাহায্য, আমদানি-রপ্তানিতে, টাকার অবমূল্যায়ন করে ভারত বাংলাদেশকে লুট করে। লুটপাট ভারতীয় সেনাবাহিনী করলেও চোরাচালান ও কালোবাজারিতে যুক্ত ছিল ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেণী এবং তাঁরা বাংলাদেশেরও কিছু দালাল জুটিয়ে নিয়েছিল। 

ভারত ও ভারতীয়দের এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশকে দেখতে হয় একটি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ যেখানে ৫-১০ লক্ষ মানুষ খুন হয়। এরপরও বাংলাদেশীরা আজ ভারতীয় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায্য অধিকারের দাবী জানাতেও শরমিন্দা অনুভব করে। অথচ ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ স্বীকার করে বলেন;

‘……আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিৎ ছিল, কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন’ 
(ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’, স্টেটসম্যান, ২৯ এপ্রিল, ১৯৮৮)
--------------------------------- 
লেখকঃ প্রবন্ধ লেখক কলামিস্ট বিশ্লেষক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments