Recent Tube

ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও সম্ভাবনা ৷ ড. ইউসুফ আল কারজাভী।


    ইসলামী পুনর্জারণ সমস্যা ও 
    সম্ভাবনা। 
                           ৬ষ্ঠ পর্ব,


১. ছোট খাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা

বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধাত্বের একটি লক্ষন হচ্ছে বড় বড় বিষয় উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেত থাকা। অথচ বৃহৎ বিষয়গুলৌ এতো গুরুত্বপূর্ন যে, এগুলোর প্রতি উদিসীন উম্মাহর অস্তিত্ব, আশা-আকাক্ষা, পরিবেশ তথা সামগ্রিক সত্তাকে বিপন্ন করতে পারেঅ দাড়ি রাখা, গোড়ালীর নিচে পযর্ন্ত কাপড় পরা, তাশাহুদের সময় আঙ্গুল নাড়ানো, আলৌকচিত্র রাখার মতো ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে অবিরাম বাড়াবাড়ি চলছে।এমন এক সময় এসব নিয়ে হৈ চৈ করা হচ্ছে যখন মুসলিম উম্মাহ ধর্ম নিরপেক্ষবাদ , ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের নিরবচ্ছিন্ন বৈরিতা ও অনুপ্রবেশের সম্মুখীন । ক্রীশ্চান মিশনরীরা মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও ইসলামী চরিত্র ক্ষুণ্ণ করার জন্যে নতুন ক্রুসেড শুরু করেছে। দুনিয়ার বিভিন্ন আংশে মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিম ধর্ম প্রচারকরা চরম ভীতি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমি দেখছি, যারা শিক্ষাদীক্ষা আথবা জীবিকা অর্জনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপে এসেছেন, তাঁরাও ছোটখাট বিতর্কিত বিষয়গুলো সাথে নিয়ে এসেছেন এবং এ নিয়ে মাথা ঘামান। এটা এক কথায় র্মমান্তিক! আমি নিজে দেখেছি এবং শুনেছি এসব বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্য অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিষয়গুলো ইজতিহাদ সাপেক্ষ। এগুলো এমন বিষয় যা নিয়ে ফকীহদের মত সর্বস্মত হয় না। আমি নিজেও এগুলের ওপর বক্তব্য রেখেছি। যা হোক এসব নিরর্থক মাসলা-মাসাকয়েল নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ না করে প্রবাসীদের উচিত ইসলামের মূল সত্যকে আঁকড়ে ধরা। বিশেষ করে মুসলিম তরুণদের এদিকে আকৃষ্ট করা, তাদেরকে অবশ্য পালনীয় কাজগুলো করতে এবং কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করা । এই দায়িত্ব পালনে সফল হলে ইসলাম প্রচারে এক নতুন আশার সঞ্চার হেব।

  এটা দুঃখজনক যে, যারা এ ধরনের বিতর্ক ও সংঘাতের সূত্রপাত করেন তারাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিধি পালনে উদাসীন বলে অভিযোগ রয়েছে। মাতা-পিতার প্রতি কতব্য, স্ত্রী ও সন্তান প্রতিপালন, প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব, সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন, বৈধ ও অবৈধ বিচারে সতর্কতা ইত্যাদি প্রশ্নে তাদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু তারা নিজেদের মান উন্নত করার পরিবর্তে বিতর্ক সৃষ্টি করে খুব মজা পান। শেয় পর্যন্ত তাদেরকে এর দরুন বৈরিতা অথবা মুনাফিকীর ন্যায় আচরণ করতে হয়। একটি হাদীসে এরূপ বাক-বিতন্ডার কথা উণ্ণখ করা হয়েছে : “যারা (সঠিক) পথ পেয়েছে তারা কখনো বিভ্রান্ত হবে না যতক্ষন না তারা বাক-বিতন্ডায় নিমজ্জিত হয়।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী) এ রকমও দেখা যায়, কেউ কেউ আহলে কিতাবদের জবাই করা পশুর গোশত মুসলমানদেরকে খেতে নিষেধ করেন যদিও বর্তমান ও অতীতে এর বৈধ হওয়া সম্পর্কে ফতোয়া আছে। অথধচ এ রকম লোকদেরই দেখা যাবে এর চেয়ে বড় বড় নিষিদ্ধ কাজ করতে তারা সিদ্ধহস্ত। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের একটা ঘটনার কথা আমি শুনেছি। এক ব্যক্তি খুব বড় গলায় বলছিল ইহুদী ও খৃষ্টানদের জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া যাবে না। কিন্তু সে নির্লজ্জের মতো অন্যদের সাথে একই টেবিলে বসে মদ সহযোগে ঐ গোশত ভক্ষণ করছিলো। অথচ সে নির্দ্বিধায় একিট অনিশ্চত ও বিতর্কিত বিষয়ে গোঁড়া বক্তব্য রাখছিলো। ঠিক এ রকম পরস্পর বিরোধী আচরণ দেখে একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। হযরত হুসাইনের (রা) শাহাদাতের পর ইরাক থেকে এক ব্যক্তি এসে তাকে মশা মারা হালাল কি হারাম জিজ্ঞেস করলো। ইমাম আহমদ তাঁর মসনদে বর্ণনা করছেন:

    আমি ইবনে উমরের সাথে বসেছিলাম । একিট লোক এসে তাকে মশার রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞস করলো। ইবনে উমর (রা) তাকে বললেন, “তুমি কোত্থেকে এসেছ?” সে জবাব দিল, “ইরাক থেকে।” তখন ইবনে উমর বললেন, “দেখ লোকটির দিকে! সে আমাকে মশার রক্ত সম্পর্কে প্রশ্ন করছে, অথচ তারা (ইরাকিরা) রাসূলুল্লাহ (সা)- এর পৌত্রকে [আল-হুসাইন ইবনে আলী (রা)] হত্যা করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) - কে বলতে শুনেছি : “তারা (হাসান ও হুসাইন) এই জগতে আমার দু’টি মিষ্টি মধুর সুরবিত ফুল।” (আহমাদ)
২.নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাড়াবাড়ি

   ইসলামী আইনশাস্র ও শরীয়াহর জ্ঞানের অবাবে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্র নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি দেখা যায়। কুরআন ও সুন্নায় এর বিরুদ্ধে পরিস্কার সতর্ক বাণী রয়েছে। কুরআন বলছে :

    “তোমাদের মুখ থেকে যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে তেমনি করে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটি হালাল এবং ওটি হারাম।” (১৬: ১১৬)

    রাসূলুল্লাহ (সা) - এর সাহাবী এবং প্রাথমিক যুগোর বুজর্গানে দ্বীন নিশ্চত না হওয়া পর্যন্ত কনো জিনিসকে নিষিদ্ধ বা হারাম বলে ফতোয়া দিতেন না। কিন্তু চরমপন্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে হারাম ফতোয়া দিতে যেন এক পায়ে খাড়া থাকে। ইসলামী আইনশাস্ত্রে কোন বিষয়ে যদি দুটো মত থাকে যদি এক পক্ষ বলে মুবাহ, আন্য পক্ষ বলে মাকরূহ; চরমপন্থীরা এক্ষেত্রে মাকরূহকে সমর্থন করে পরহেযগারী যাহির করে। এক পক্ষ যদি একটি বিষয়কে মাকরূহ এবং অন্য পক্ষ হারাম বলে ঘোষণা করে সে ক্ষেত্রে গোঁড়া ব্যক্তিরা হারামের পক্ষ নিয়ে সাধুতার প্রমাণ রাখতে চায় অর্থাৎ সহজ ও কঠিনের মধ্যে তারা শেষোক্তটাকে বেছে নেয়াই অধিকতর তাকওয়ার লক্ষণ বলে মনে করে। তারা ইবনে আব্বাসের (রা) কঠোর মত গ্রহণে বেশি আগ্রহী। বস্তুত এই প্রবণতা মধ্যমপন্থার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই ফসল। বিষয়টি বোঝায় সুবিধার্থে আমি একটি প্রত্যক্ষ ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
একদিন এক গোঁড়া লোক অপর এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে দেখে তার পাক সাফ হওয়ার

      জন্যে তৎক্ষণাৎ বমি করতে বলল। আমি তখন গোঁড়া লোকটিকে নম্রবাবে বললাম, “এজন্য এতো কঠোর ব্যবস্থার দরকার পড়ে না। এটা একটা চোট ব্যাপার।” সে বলল, হাদীসে এটা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। আর কেউ যদি ভুলক্রমে করে বসে তবে সহীহ হাদীসে বমির বিধান আছে।” আমি জবাব দিলাম, “কিন্তু দাঁড়িয়ে পানি খাওয়ার পক্ষে যে হাদীস আছে তা অধিক প্রমাণিত এবং বুখারীর একটি অধ্যায় আছে যার শিরোনাম হলো, “দাড়িয়ে পানি পান করা।” ঐ ব্যক্তি নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে কোনো হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে পারলো না । অথচ এটা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জের সময় দাঁড়িয়ে পানি পান করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম)

       এছাড়া একবার হযরত আলী (রা) দাঁড়িয়ে পানি পান করতে করতে বলেছিলেন, “এটা অনেকেই পছন্দ করে না, কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এরূপ করতে দেখেছি যেমন তোমরা আমাকে দেখছ।” (বুখারী, মুসলিম)

       ইবনে উমরের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে ইমাম তিরমিযী বলছেন, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগে আমরা চলন্ত অবস্থায় খাবার খেতাম এবং দাঁড়িয়ে পানি পান করতাম।” কাবশাহ (রা) বলেন, “আমি একবার রাসূলুল্লাহ (সা) -কে ঝুলন্ত মশক থেকে পানি পান করতে দেখেছি।”

     মোটকথা নির্ভরযোগ্য হাদীস বিশারদদের ব্যাখ্যা থেকে আমরা দেখতে পাই বসে পানি পান করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ নেই। আর দু’টো ব্যাপারই প্রমাণিত। অতএব, কেউ দাঁড়িয়ে পান করলেও নিষেধ নেই। কেউ দাঁড়িয়ে পানি পান করলেই বমির বিধান জারি করাটা সম্পুর্ণ ভুল।

     একইভাবে, আজকাল অনেক তরুণ ইসলামী পোশাক নিয়ে জল্পনা কল্পনায় লিপ্ত। হাদীসে এর দৃঢ় ভিত্তি আছে: “(পোশাকের) যে অংশ গোঁড়ালির নিচে (ঝুলে থাকে) তা আগুনে (পুড়বে)।” (বুখারী)

    এ জন্য অনেক তরুণকে গোঁড়ালির উপরে পোশাক পরতে দেখা যায় এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের উপরেও এটা চাপাতে চায়। কিন্তু এরূপ চাপাচাপির ফলটা এই হবে যে, একপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই গোঁড়ামির অভিযোগ আনবে। এটা সত্য যে, কিছু হাদীসে গোড়ালির নিচে কাপড় পরিধানের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আবার অন্য হাদীসে এই নিষেধাজ্ঞার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। একদা এভাবে কাপড় পরাকে অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও অপচয়ের লক্ষণ মনে করা হতো। দৃষ্টান্তস্বরুপ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সেই ব্যক্তির দিকে থাকবেন না যে অহঙ্কারবশত তার কাপড়কে (পেছনে) টেনে নিয়ে যায়।” (মুসলিম)

     হযরত আবু বকর (রা) রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, “আমার ইজার অসাবধানতাবশত নিচে নেমে যায়।” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন “যারা গর্বোদ্ধত হয়ে এরূপ করে তুমি তাদের মধ্যে নও।” (বুখারী) এ কারনে আন-নববী ও অন্যান্য মুসলিম মনীষীরা তম প্রকাশ করেছেন যে, এরূপ কাপড় পরা মাকরূহ। কিন্তু মাকরূহ অনিবার্য কারণে মুবাহ হতে পারে।
৩. ভ্রান্ত ধারণা

     ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অগভীর জ্ঞান থেকেই মূলত বিতর্কের সূত্রপাত। এ জন্যে ইসলাম, ঈমান, কুফর, নিফাক ও জাহিলিয়াত ইত্যাদির সঠিক সংজ্ঞা ও পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ভাষাগত জটিলতা, বিশেষত আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তির অভাব বহুলাংশে বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত ধারণার জন্যে দায়ী। ফলত অনেকেই রূপক ও প্রকৃত অর্থের মধ্যে তারতম্য উপলদ্ধি করতে পারেন না। ঈমান ও পূর্ণ ইমান, ইসলাম ও প্রকৃত ইসলাম, বিশ্বাসে মুনাফেকী ও কর্মে মুনাফিকী, ছোট ছোট শিরক ও বড় বড় শিরকের মধ্যে তারা পার্থক্য করতে অক্ষম । এখন আমি এসব বিষয়ের একিট সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। এতে এ সম্পর্কে আমারা সতর্ক হতে পারব। বস্তুত অনুভূতি, কথা ও কাজের সমন্বয়ে ঈমান পূণৃ রূপ লাভ করে।
কুরআনে এই ঈমান সম্পর্কে বলা হয়েছে :

     “মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি করে দেয়।”(৮:২)
“ সেসব ঈমানদারই সফলকাম হয়েছে যারা বিনয়াবনত চিত্তে নামায আদায় করে।” “তারাই ঈমানদার যারা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তারপর কখনোই সন্দেহ পোষন করেনি এবং আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে লড়াই করেছে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (৪৯: ১৫) নিম্মোক্ত হাদীসেও ঈমানের এই রূপ তুলে ধরা হয়েছে:

    “যারাই আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের ওপর ঈমান এনেছে তাদের উচিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ... যা ভাল তাই তাদের বলা উচিত নতুবা চুপ থাকা (উত্তম)।” (বুখারী)

    আরেকটি হিদীসে ঈমানের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে : “সেই ব্যক্তি ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না সে তার (মুসলমান) ভাইয়ের জন্যে তাই ভাল মনে করবে যা সে তার নিজের জন্য ভাল মনে করেব।” (বুখারী)

    এখানে লক্ষণীয়, শোষোক্ত হাদীসে দু’টিতে ঈমানের নেতিবাচক রূপ তুলে ধরে প্রকুতপক্ষে ঈমানের পূর্ণ রূপ তুলে ধরা হয়েছে।; সেরূপ ঈমান নয় যেমন বলা হয়: “যে তার জ্ঞান কাজে লাগায় না সে বিদ্বান নয়।” এখানে সীমিত জ্ঞান নয়, বরং পূর্ণ জ্ঞানের নেতিবাচক দিকটির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই হাদীসেও পূর্ণ ঈমানের পরিচয় বিধৃত হয়েছে: ঈমানের সত্তরটি শাখা আছে, তার মধ্যে একটি শাখা হচ্ছে লজ্জা বা হায়া। ইমাম আবু বকর আল-বয়হাকী তাঁর ‘আল -জামি’লী শুয়াব আল- ঈমান’ কিতাবে ঈমনকে একটি গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছেন। গাছের কান্ড হচ্ছে ঈমানের মৌলিক অঙ্গের প্রতীক। যেহেতু গাছ এর কিছু শাকা-প্রশাখা নিয়ে ইসলামের আওতায় তাকতে পারে। ফেরেশ্তা ও তকদীরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা।”

  আল-হাফিজ আল-বায়হাকী ফতহুল বারীতে লিখেছেন: “আমাদের বুজর্গ পূর্বপুরুষরা বলেছেন : ঈমান হলো হৃদয়ে বিশ্বাস স্থাপন, মুখে উচ্চারণ ও কর্মে রূপায়ণ। এর অর্থ বাস্তব জীবনে রূপায়ণ ছাড়া ঈমান পূর্ণ হতে পরে না। এ জন্যে তারা মনে করতেন ঈমান বাড়াতে ও কমাতে পারে। আল-মাজিয়াহ মনে করেন, ঈমান শুধু মনে ও উচ্চারণে; আল-করামিয়াহ বিশ্বাস করেন , উচ্চারণই যথেষ্ট; আল-মুতাযিলাহর ধারণা, ঈমান হলো বিশ্বাস, উচ্চারন ও বাস্তাবায়নের সমন্বত রূপ।... এ ব্যাপারে তাঁদের ও পূর্ববতী বুজর্গদের মধ্যে পার্থক্য এটাই যে, পূর্বোক্তরা আমলকে ঈমানের প্রমাণ হিসেবে মনে করেন। আর শেষোক্তরা আমলকে পূর্ণতার শর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু পূর্ণ সত্তা কেবল আল্লাহ তায়ালাই। আমাদের কাছে ঈমানের মৌলিক ঘোষণাই যথেষ্ট। কেননা পরিপূর্ণ পরম সত্তা কেবল আল্লাহ জাল্লা জালালুহু। একবার যে মুখে ঈমানের ঘোষনা দেয় তখন থেকেই আল্লাহ শানুহুর দৃষ্টিতে তাকে মুসলমান হিসেবে গণ্য করা হয। যতোক্ষণ না সে এমন আচরন করে যাতে মনে হয় সে বেঈমান, যেমন মূর্তির কাছে মাথা নত করা। কেউ যখন পাপ কাজ করে তখন তাকে আমরা ঈমন সংক্রান্ত স্ব স্ব ধারণার আলোকে ঈমানদার ভাবতে আবার নাও ভাবতে পারি। পূর্ণ ঈমানদার। কারো বিরুদ্ধে যদি কাফির হওয়ার অভিযোগ ওঠে তবে এ কারণেই যে সে কুফরীর আচরণ করে।’

    একজন কাফির যখন এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল, তখুনি সে মুসলমান হয়ে যায। তৎখণাত সে নামায আদায় করলো কিনা সেটা বড় কথা নয়। যাকাত ইত্যাদি এগুলো সে মেনে নিলো সেটাই বড় কথা। আমল কতটুকু করলো সেটা পরে লক্ষণীয়। কালেমার মৌখিক উচ্চারণের সাথে সাথেই সে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যারা কালেমা (শাহাদাত) উচ্চারণ করলো, তারা আমার কাছ থেকে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেলো... তাদেরকে আল্লাহর কাছেই জবাবদিহি করতে হবে।” (বুখারী)

   ইসলাম শব্দটিও ইবনে উমর (রা) বর্নিত পাঁটি স্তম্ভেকেই বোঝায়: “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত - এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল; নামায আদায় করা যাকাত দেয়া, রোজা রাখা এবং হজ্জ আদায় করা।” হাদীস শাস্ত্রেও জিবরাঈল (আ)-এর মুখে ইসলামের সংঙা দেয়া হয়েছৈ। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন তাঁকে বলেন, “ইসলাম কী?” তখন তিনি বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা, নামায আদায় করা যাকাত দেয়া এবং রমযান মাসে রোজা রাখা।” (বুখারী)

     জিবরাঈল (আ) এর কথা থেকে আমরা ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য বুঝতে পারি। এটাও পিরষ্কার যে, দু’টি শব্দকে এক অর্থেও ব্যবহার করা যায়। দু’টির একত্র সমাহারে দেখা যাবে একটির মধ্যে আরেকটির অর্থ লুক্কায়িত আছে, অথাৎ ঈমান ছাড়া ইসলাম নেই। ইসলাম ছাড়া ঈমান নেই। ঈমনের স্থান হৃদয় কন্দরে আর ইসলামের রূপায়ণ হচ্ছে আবেগ ও আচরণের সংমিশ্রণে। নিম্মোক্ত হাদীস থেকে আমরা এটাই উপলব্ধি করতে পারি: “ইসলাম হচ্ছে প্রকাশ্য আর ঈমান হচ্ছে অন্তরে (বিশ্বাসের বিষর)।”(আহমদ, আলবাজ্জাজ)

    ঈমানের এই সংজ্ঞা আমরা কুরআনেও দেখতে পাই : “বেদুঈনরা বলে, ‘আমরা ঈমান আনলাম; বল, তোমরা ঈমান আননি বরং, তোমরা বল, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি, কেননা তোমাদের হৃদয়ে এখনও ঈমান প্রবেশ করেনি।” (৪৯:১৪)

     আর ইসলামের পূর্ণ পরিচয় দিয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: “ইসলাম হলো (সেই অবস্থা) যখন তোমার হৃদয় (সম্পূর্ণরূপে) আল্লাহ্ র কাছে সমর্পিত হয় এবং যখন তুমি মুসলমানদেরকে তোমার যবান ও হাত দিয়ে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকো।” অন্য দু’টি হাদীসেও বলা হয়েছে: “সেই হচ্ছে মুসলমান যার যবান ও হাত দিয়ে অন্য মুসলমানের ক্ষতি হয় না” এবং তুমি নিজের জন্য যা ইচ্ছে করো অপরের জন্যে তাই করলেই তুমি মুসলমান।”

      ফিকাহর ভাষায় কুফরের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর কালামের প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও অস্বীকৃতি। আল-কুরআনে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়: “কেউ আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল এবং কিয়ামত দিবমকে অস্বীকার করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” (৪:১৩৬)

      কুফর রিদ্দাকেও বোঝায় ফলশ্রুতিতে ঈমান সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়: “কেউ ঈমান ত্যাগ করলে তার আমল নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত হবে।” (৫:৫)

  “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন দ্বীন থকে ফিরে যায় এবং বেঈমান হয়ে মরে যায়, ইহকালে ও পরকালে তাদের আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। তারাই দোযখী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” (২:২১৭) কুফরের অর্থ সীমালংঘনও হয় যা পুরোপুরি ইসলামকে প্রত্যেখানের শামিল নয়, কিংবা আল্লাহ্-রাসূলের অস্বীকৃতিও বোঝায় না।

   মনষী ইবনুল কাইয়েম কুফরকে ছোট ও বড় এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। বড় কুফরের শাস্তি স্থায়ী জাহান্নাম আর ছোট কুফরের শাস্তি জাহান্নমের অস্থায়ী বাস। একটি হাদীস লক্ষণীয় : “আমার উম্মাহর মধ্যে কুফরীর দু’টি (লক্ষণ) প্রচলিত আছে: “বংশ পরিচয় কলংকিত করা এবং মৃত্যে জন্য বিলাপ” এবং কেউ যদি গণকের খৌঁজ করে এবং তাকে বিশ্বাস করে তবে সে মুহাম্মদ (সা)-এর অবতীর্ণ ওহীর সাথে কুফরী করে।” হাদীসে আরো বলা হয়েছে: “(আমার পরে) পরস্পরকে হত্যা করে কুফরীর দিকে ফিরে যেয়ো না।” কুরআনের একটি আয়াতের এটা হচ্ছে ইবনে উমর (রা) ও অনান্য বিশিষ্ট সাহাবীর ব্যাখ্যা, আয়াতটি হচ্ছে: “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অবিশ্বাসী।” (৫:৪৪) আয়তটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: “এটা সেই কুফরী নয় যা একজনকে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত করে, বরং এটি হচ্ছে কুফরীর একটি উপাদান; কারণ যে ব্যক্তি এরূপ করে সে আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে অবিশ্বাস করে না।” তাউস একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। আতা বলেন, এটা হচ্ছে কুফর অথবা অন্যায় অথবা ফিস্ ক যা অপরটির চেয়ে ছোট অথবা বড় হতে পারে। ইকরামার মতো অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন: আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার করে না তারা কুফরী করে। কিন্তু এই যুক্তিটা দুর্বল। কারণ এক ব্যক্তি শরীয়াহর আলোকে বিচার করুক আর নাই করুক, নিরেট অস্বীকৃতিই কুফর। এ প্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়েম বলেন: আল্লাহ্‌র বিধানের পরিপন্থী বিচার বিবেচনার মধ্যে ছোট ও বড় দুই ধরনের কুফরী হয়ে থাকে। আর এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। যদি সে বিশ্বাস করে যে, বিচার আল্লাহ্‌র বিধান অনুযায়ীই হতে হবে এবং শাস্তির সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু তা করা থেকে বিরত খাকলো তাহলে সে ছোট কুফরী করে। কিন্তু যদি কোন বিশ্বাসী মনে করে যে, এটা বাধ্যতামূলক নয় এবং ঈমানের পরিপন্থী যা খুশী তাই করতে পারে তাহলে সে বড় পাপ করে। কিন্তু যদি সে অজ্ঞতা ও অনিচ্ছাবশত ভুল করে বসে তবে তাকে কেবল “ভুল করেছে” এতটুকু বলা যাবে।

    যা হোক বিষয়টির সারাংশ হচ্ছে, সকল সীমালংঘন ছোট কুফরের লক্ষণ, এই অর্থে অকৃতজ্ঞতা; কারণ মান্য করা বা আনুগত্যের মধ্যেই কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। অতএব মানবীয় প্রচেষ্টা কৃতজ্ঞতা অথবা কুফর কিংবা এ দুয়ের মাঝখানে কোনো কিছু দিয়ে প্রকাশ পায়-প্রকৃত সত্য আল্লাহ্ পাকই জানেন।

   শিরকও দু’ভাগে বিভক্ত: ছোট ও বড়। বড় শিরক হলো আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা অথবা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শিরক করা। আল-কুরআনের একটি আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “আল্লাহ্‌র সাথে কাউকে শরীক করলে তিনি মাফ করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ যাকে ইচ্ছা করেন।” (৪:৪৮)

    ছোট শিরক হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা অথবা দুর্ভাগ্য সৌভাগ্য পরিণত করার জন্যে তাবিজ-তুমারের ক্ষমতায় বিশ্বাস করা। এই শিরক সম্পর্কে এক হাদীসে বলা হয়েছে, “যে আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারো নামে শপথ করে সে শীরক করে এবং যে তাবিজ পরে সে শিরক করে।” (আহমাদ, আলহাকিম) এছাড়া “যাদু, তাবিজ ও ম্যাসকট (কোনো কিছু কে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মানা) বিশ্বাস হচ্ছে শিরক।” (ইবনে হাবান, আলহাকিম)

     নিফাকও (মুনাফিকী) ছোট ও বড়-দু’ভাগে বিভক্ত। বড় মুনাফিকী হলো হৃদয়ে কুফরী পোষণ আর বাইরে প্রতারণার উদ্দেশ্যে ঈমানের ভাব করা। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে: “মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করি, কিন্তু তারা বিশ্বসী নয়।আল্লাহ্ ও ঈমানদারদের তারা ভাঁওতা দিতে চায়। তারা নিজেদের ছাড়া কাউকে প্রতারিত করে না এটা তারা বুঝতে পারে না।”(২:১৪)

     এ ধরনের নিফাকের কথা সূরা আল-মুনাফিকুনে এবং কুরআনের অনান্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নিফাকের জন্যে আল্লাহ জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করেছেন।
“মুনাফিকরা তো দোযখের নিকৃষ্টতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্যে তুমি কখনো কোনো সহায় পাবে না।” (৪:১৪৫)
    ছোট নিফাকের লক্ষণ হচ্ছে আল্লাহ্ ও পরকালের প্রকৃতই বিশ্বাস আছে কিন্তু মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যও আছে। ও ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হাদীস হচ্ছে:

    “মুনাফিকীর তিনটি লক্ষণ: সে যখন কথা বলে, (সর্বদা) মিথ্যা বলে; যখন সে প্রতিজ্ঞা করে (সর্বদা) ভঙ্গ করে; যদি তাকে বিশ্বাস করা হয় তবে (সর্বদা) সে অসাধু বলে প্রমাণিত হবে।” (অনুমোদিত হাদীস)

   “যার মধ্যে (৪টি বৈশিষ্ট্য) আছে যে নির্ভেজাল মুনাফিক, যার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে নিকাফের একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে একটি উপাদান আছে যতক্ষণ না সে এটা পরিত্যাগ করে: যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে; বিশ্বাস করা হলে বিশ্বাসঘাতকতা করে; চুক্তি করা হলে খেলাফ করে এবং যদি সে ঝগড়া করে তবে খুব হঠকারী, অশালীন ও অপমানজনক আচরণ করে।”( অনুমোদিত হাদীস)

      রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবাগণ ও বুজুর্গানে দ্বীন এ ধরনের নিফাককে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন। তাঁরা বলতেন, এ ধরনের নিফাক নিফাক নিয়ে কেবল মুনাফিক ছাড়া আর কেউ নিশ্চিত বোধ করবে না, প্রকৃত ঈমানদারই কেবল যার ভয় করে। 

চলবে.....ইনশাআল্লাহ। ..

Post a Comment

0 Comments