Recent Tube

কালেমা তাইয়্যেবা; ১ম পর্ব; মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম রহঃ।

            
        কালেমা তাইয়্যেবা।
                        ১ম পর্ব;



بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
কালেমা তাইয়্যেবা,
لَا إلَهَ إلاَّ اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ
শুরু কথা,

    কালেমা তাইয়্যেবা ইসলামের মূল ঘােষণা। এই কালেমা না পড়ে কোনাে মানুষই ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। এ জন্যই কোনাে কাফের অথবা মুশরিক ব্যক্তি যখন ইসলাম কবুল করতে চায়, তখন সর্বপ্রথমই তাকে এই কালেমা পড়তে হয়। মুসলমানদের ঘরে কোনাে সন্তানের জন্ম হলে তার কানে সর্বপ্রথম এই কালেমার আওয়াজ শােনানাে হয়। মুসলমানদের মহল্লায় মহল্লায় দিন-রাতের মধ্যে পাঁচ বার মুয়াজ্জিন এই কালেমা উচ্চৈঃস্বরে ঘােষণা করে সকলকে নামাযের দিকে আহ্বান জানায়। নামাযের মধ্যে এই কালেমা বারবার পড়তে হয়। কুরআন শরীফের পাতায় পাতায় এই কালেমার কথা নানাভাবে লেখা আছে। ইসলামে কালেমার গুরুত্ব যে কতখানি, এর দ্বারাই তা বুঝতে পারা যায়। অতএব প্রত্যেকটি মুসলমানের পক্ষেই এই কালেমার অর্থ খুব ভালাে করে জেনে নেওয়া দরকার।

      বীজ বপন না করলে যেমন গাছ হতে পারে না, তেমনি এই কালেমা মানুষের হৃদয়-মনে ভালাে করে শিকড় গাড়তে না পারলে মানুষের জীবন-ক্ষেতে ইসলামের গাছ কিছুতেই জন্মিতে পারে না। বীজ বপন করলেই গাছ হয় এবং সেই গাছের যেমন কাণ্ড, ডাল-পালা এবং ফুল ও ফল হয়ে থাকে, তেমনি মুসলমানগণ এই কালেমার অর্থ খুব ভালাে করে বুঝে-শুনে তা মনে-প্রাণে গ্রহণ করলে ইসলামের এই নামায, রােযা, হজ্জ ও যাকাত আদায় করা, হারাম-হালাল বেছে চলা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাপারে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লক্ষ্য করে কাজ করা প্রভৃতি গুণাবলী মুসলমানদের জীবনে কিছুতেই ফুটে উঠতে পারে না।

      বীজ যদি খারাপ হয়, তবে তা থেকে গাছ অঙ্কুরিত হতে পারে না। অনুরূপভাবে মানুষ যদি এই কালেমাকে বুঝে-শুনে কবুল না করে, কিংবা এর কোনাে ভুল অর্থ গ্রহণ করে, তবে তার জীবনে ইসলামের হুকুম-আহকাম পালন করে চলা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না।

      আপনি যদি অন্য কারাের সহিত কোনাে কারবার করেন তা যে কারবারই হােক না কেন- তবে প্রথমেই আপনাকে তার সহিত একটা কথা পাকাপাকিভাবে ঠিক করে নিতে হয়; নয়তাে আপনার কাজ ভালাে করে চলতে পারে না। আপনি যদি কাউকেও কোনাে টাকা-পয়সা ধার দেন, তবে প্রথমে আপনি তার দ্বারা এ কথা স্বীকার করিয়ে নেন যে, টাকা নিয়ে সে ঠিক সময়মতাে পরিশােধ করবে এবং অমুক তারিখের মধ্যে পরিশােধ করে দেবে। সর্বোপরি, টাকা নিয়ে তা সে কখনাে অস্বীকার করবে না ইত্যাদি। এ সব কথা সে যদি স্বীকার করে তবেই আপনি তাকে টাকা ধার দিয়ে থাকেন; নতুবা আপনি কিছুতেই কাউকেও এক পয়সা ধার দেন না।

      আপনি যদি আপনার জমি কাউকে চাষ করতে দেন, তবে তার সঙ্গেও আপনার দরকারী বন্দোবস্ত আগেই করে নিতে হয়। আপনি নিজে যদি কারাে জমি চাষাবাদ বা ভােগ-ব্যবহার করতে চান, তবে আপনাকে জমির মালিকের শর্ত স্বীকার করে 'কবুলিয়ত-নামা' লিখে দিতে হয় । ঠিক এরূপই, মুসলমানকে সমস্ত জীবনব্যাপী যে আল্লাহর সঙ্গে কারবার করতে হয়, এই কালেমা পড়ে সেই আল্লাহর সঙ্গেই জীবনের সমস্ত কাজের বিষয়ে কথাবার্তা পাকা করে নেওয়া হয় দলিলে কি লেখা হয়েছে, তা না জেনেই যদি আপনি তাতে দস্তখত করে দেন, তবে সে দলিলের শর্ত অনুসারে আপনি কিছুতেই কাজ করতে পারবেন না।
কারণ, দলিলের কোন কোন শর্ত স্বীকার করে আপনি দস্তখত করেছেন, তা আপনি জানেন না। ফলে আপনার কাজকর্ম সেই দলিলের শর্তের বিরুদ্ধে যেতে পারে। এরূপেই, আপনি কালেমা তাইয়্যেবা পড়ে ইসলামের সীমার মধ্যে এলেন, নিজেকে মুসলমান ও আল্লাহর দাস’ বলে মনে করলেন; কিন্তু আপনি জানলেন যে, এই কালেমা পড়ে আপনি কোন কোন কাজ করবেন বলে স্বীকার করেছেন আর কোন কোন কাজ করবেন না বলে ওয়াদা করেছেন। এরূপ না হলে আপনার কালেমা পাঠ করার কোনােই মূল্য থাকে না। আপনার এই কালেমা পড়া আল্লাহর কাছে কবুল হতে পারে না। আপনি প্রকৃত মুসলমান’ ও ‘আল্লাহর বান্দাহ হতে পারেন না। আপনার জীবনের কোনাে কাজই সেই কালেমা অনুসারে সমাধা হতে পারে না।

      বস্তুত এ কালেমাটি সর্বদিক দিয়ে অত্যন্ত বিরাট ও মহান। আল্লাহ্ তা'আলা নিজেই এ কালেমার সাক্ষ্য ঘােষণা করেছেন; এর সত্যতা স্বীকার করেছেন সমস্ত ফেরেশতা এবং সৃষ্টিকুলের মধ্যেকার সমস্ত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ । এ অতীব সত্য ও সঠিক ঘােষণা, ইনসাফ ও ন্যায়পরতার অকাট্য প্রতীক। এই কালেমা দ্বারা যা ঘােষণা করা হয়, তাই সত্য ও যথার্থ, প্রকৃত অবস্থার সহিত পুরােপুরি সামস্যশীল । এটি ইসলামের মূল ঘােষণা। এ কালেমার প্রকৃত মর্মবাণী না জানলে, পরম সত্য বলে অন্তর দিয়ে তা মেনে না নিলে, মুখে স্পষ্টভাবে এর সত্যতা ঘােষণা না করলে এবং একে পুরােপুরিভাবে মেনে চলতে অন্তর দিয়ে রাজি না হলে কৈউই মুসলিম হতে পারে না।

       এই কালেমা তওহীদী আকীদা'র বলিষ্ঠ ঘােষণা এবং শিরকী আকীদা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার ও অমান্য করার ঘােষণা। এ ঘােষণা দ্বারাই একজন মুসলমান শিরকী আকীদার জঞ্জাল ও দুঃখময় পরিণাম থেকে রক্ষা পেতে পারে।

      এ থেকে পুরােপুরি ফায়দা পেতে হলে সাতটি শর্ত পূরণ করতে হবে ।
প্রথমত, জ্ঞান- এর দ্বারা কি অস্বীকার করা হলাে এবং কি স্বীকার করা হলাে তা জানা। দ্বিতীয়ত, যা জানা গেল তা মনে-প্রাণে দৃঢ়রূপে সত্য বলে বিশ্বাস করা; তাতে একবিন্দু সন্দেহ পােষণ না করা। তৃতীয়ত, এর প্রতি পরম নিষ্ঠা বোধ করা শিরকের বিরুদ্ধে কঠোর ও অনমনীয় মনােভাব রাখা। চতুর্থত, এমন সত্যতা সহকারে এর ঘােষণা দেওয়া যেন তাতে মুনাফিকীর লেশমাত্র না থাকে। পঞ্চমত, এ কালেমা'র প্রতি ঐকান্তিক ভালােবাসা ও মনের দরদ পােষণ করা- সেজন্য অন্তরে আনন্দ অনুভব করা। ষষ্ঠত, এর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য পোষণ করা। এর দাবি পূরণে প্রস্তুত হওয়া। যে সব কাজ দ্বারা আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠা প্রমাণিত হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়া যায় তা করতে রাজি হওয়া এবং সপ্তমত, এর বিপরীত সব কিছুকেই অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে মনে-প্রাণে
প্রস্তুত হওয়া।

      এখন আপনারা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে, কালেমা তাইয়্যেবা না পড়ে যেমন কেউ ইসলামের সীমার মধ্যে আসতে পারে না, ঠিক তেমনি এর অর্থ না জেনে, এ শুধু মুখে মুখে উচ্চারণ করেই কেউ খাটি মুসলমান হতে এবং মুসলমানের মতাে কাজ করতে পারে না। বর্তমান দুনিয়ার অধিকাংশ মুসলমান যে ইসলামের হুকুম-আহকাম পালন করে না— 'মুসলমান হয়েও যে তারা
অমুসলমানের মতাে কাজ-কর্ম ও আচরণ করে এর একমাত্র কারণ এই যে, তারা কালেমা পড়ে এবং বিশ্বাসও করে বটে, কিন্তু জানে না যে, তারা কি পড়ে আর কি বিশ্বাস করে। এর ফলে দেখছি, কোটি কোটি মুসলমান দুনিয়ায় বাস করে অথচ ইসলাম পালন করে প্রকৃত মুসলমানের মতাে অধিকাংশই জীবন যাপন করে না; বরং দেখা যাচ্ছে যে, তারা প্রতিটি পদে পদে ইসলামের খেলাফ কাজ করে। এ অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে ?

         কালেমা পড়ে এর অর্থ বুঝি না বলে যেমন আমরা খাটি মুসলমানের ন্যায় কাজ করতে পারি না, ঠিক তেমনি এ কারণেই আমরা আল্লাহ্র রহমতও লাভ করতে পারছি না। ফলে আমরা নানা প্রকার দুঃখ ও মুসীবতে পড়ে গেছি অধঃপতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌছেছি।

       কাজেই এখন যদি আমরা আবার প্রকৃত মুসলমান হতে চাই, দুনিয়ার বুকে যদি আমরা আবার আল্লাহর রহমত পেয়ে উন্নতি করতে ইচ্ছা করি এবং পরকালেও যদি আমরা সত্যিকার মুসলমান হিসাবে আল্লাহর সম্মুখে হাজির হতে ইচ্ছা করি, তা হলে এই কালেমা তাইয়্যেবার অর্থ আমাদের ভালাে করে জেনে ও বুঝে নিতে হবে এবং ধীরে ধীরে তদানুযায়ী নিজেদের জীবনকে ঢেলে গঠন করতে হবে । তাই আমরা এখানে কালেমা তাইয়্যেবার বিস্তারিত অর্থ লিখতে চেষ্টা করছি।

   কালেমা তাইয়্যেবার অর্থ,

    কালেমা তাইয়্যেবা কোনাে লম্বা চওড়া জিনিস নয়, তা আপনারা সকলেই জানেন :

لَا إلَهَ إلاَّ اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ
‘আল্লাহ ছাড়া কোনাে মাবুদ নেই- হযরত মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রাসূল।

 এই কালেমার দুইটি অংশঃ

প্রথম অংশ لَا إلَهَ إلاَّ اللَّهُ

দ্বিতীয় অংশ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ

     প্রথম অংশের অর্থ ও ‘নেই (কোনাে) মাবুদ আল্লাহ ছাড়া।' অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা ছাড়া কোনাে মাবুদ বা প্রভু নেই, যার গােলামী বা দাসত্ব করা যেতে পারে।
আল্লাহ তাআলাই একমাত্র মা'বুদ, প্রভু ও মালিক এবং ভয় করা ও মেনে চলার যােগ্য। তিনি সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা আমরা তাঁর সৃষ্টি। তিনি সকলের প্রভু আমরা তাঁর অধীন দাস। তিনি সারা জাহানের মনিব এবং আমাদেরও মালিক। ভয় একমাত্র তাকেই করতে হবে। তিনিই একমাত্র উপাস্য। আমরা কেবল তারই দাসত্ব স্বীকার করি, কেবল তাঁরই আনুগত্য করি এবং কেবল তারই আইন মেনে চলি।

    আর দ্বিতীয় অংশের অর্থ ও মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রাসূল অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ (স)-কে তার আদর্শের প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতারূপে মানব জাতির নেতা ও পথ-প্রদর্শকরূপে পাঠিয়েছেন।

   আগেই বলেছি, এই কালেমাই হলাে ইসলামের মূল বুনিয়েদ। এর ওপর ইসলামের অন্যান্য বহু হুকুম-আহকামের বিরাট ইমারত’ দাঁড়িয়ে থাকে। এটি হলে সে ‘ইমারত’ এক মুহূর্তের তরেও তৈরি হতে পারে না দাঁড়াতেও পারে না। এই কালেমার মধ্যে আল্লাহর যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, ইসলামে তাই আল্লাহর সঠিক পরিচয়। এসব গুণ-বৈশিষ্ট্য যে সত্তার মধ্যে বর্তমান, ইসলামে তাকেই ‘আল্লাহ’ বলে স্বীকার করা হয়েছে। আবার ঐ সমস্ত গুণ একত্রে যার
মধ্যে বর্তমান নেই, সে কখনাে ‘আল্লাহ্’ হতে পারে না; ইসলাম তাকে আল্লাহ্ বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়।

    আর মুহাম্মাদ (স)-কে আল্লাহর রাসূল বলে এ কথাই ঘােষণা করা হয়েছে যে, তিনি শুধু মুহাম্মাদ (স) নামে একজন মানুষই নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূলও বটে এবং এ-ই হলাে তাঁর আসল পরিচয়। দ্বিতীয়ত, আল্লাহকে সঠিকভাবে মানতে হলে মুহাম্মাদ (স) নামক রাসূলকেও সঠিকরূপে ও পুরােপুরিভাবে মানতে হবে ।

 প্রথম অংশের ব্যাখ্যা;

   এ কালেমার প্রথম অংশকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ হলাে নেতিবাচক, অর্থাৎ কোনাে মাবুদ নেই- প্রভু বা সৃষ্টিকর্তাও কেউ নেই। আমি কাউকেও ভয় করি না, কারাে কাছে নতি স্বীকার করি না, কারাে আইন মানি না, কারাে দয়া-অনুগ্রহ বা সাহায্য আমি চাই না, কাউকেও উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী স্বীকার করি না। কারাে ইবাদত-বন্দেগী করি না। এসব দিক দিয়ে যে-কেহ আমার ওপর কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে, আমি তাকেই অস্বীকার করি । সকলের প্রতি আমি বিদ্রোহী । কারাে সহিত আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। আর দ্বিতীয় অংশ হলাে ইতিবাচক; অর্থাৎ এ সব দিক দিয়ে একমাত্র আল্লাহকেই আমি স্বীকার করি ও মানি।

    একজন মানুষ যখনই এই কালেমা পড়ে, তখন সে এর মধ্য দিয়ে এ কথাই স্বীকার করে যে, এই দুনিয়া এবং এর সমস্ত জীব-জন্তু ও বস্তু-সামগ্রী- এসবের কোনােটিই সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অস্তিত্ব লাভ করতে পারেনি; এর সবই সৃষ্টিকর্তারই সৃষ্টি এবং সে সৃষ্টিকর্তাও বহু নয়, মাত্র একজন । আর সেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ নয় । কুরআন মজীদেরই সুস্পষ্ট ঘােষণায় বলা হয়েছেঃ
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ
তিনিই আল্লাহ্ যিনি আকাশ-রাজ্য ও পৃথিবী এবং এ দু’এর মধ্যে যা কিছু আছে, তা সবই কালের ছয়টি ভাগে সৃষ্টি করেছেন। 
সূরা সাজদাহঃ ৪

وَإِلَـهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ 

     তােমাদের মা'বুদ- তিনি একমাত্র মা'বুদ; তিনি ছাড়া আর কেউ মা'বুদ নেই— তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। (সূরা বাকারা : ১৬৩)

      আল্লাহ্ তা'আলা সারা জাহানকে শুধু সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেন নি বরং একে রীতিমতাে পরিচালনা করা, প্রাণশক্তি ও দরকারী খাদ্য দিয়ে একে এবং এর সমস্ত জীব-জন্তুকে বঁচিয়ে রাখা ও লালন-পালন করা প্রভৃতি কাজও করেন। এ সব ব্যাপারেও তার কেউ শরীক নেই- কেউ সাহায্যকারীও নেই ।
আল্লাহ্ তা'আলা সারা জাহানের অধিবাসীদের পালনকর্তা, মালিক ও
প্রভু (رَبِّ الْعَالَمِينَ ) । আসমান ও জমিন এবং এর মধ্যকার সব জিনিসের, বিত্ত-সম্পত্তি ও ধন-দৌলতের একমাত্র মালিক তিনিই।
وَمَا مِن دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللّهِ رِزْقُهَا
দুনিয়ার সমস্ত জীবকে খাদ্য দান করার দায়িত্ব আল্লাহ্ তা'আলার।( হুদঃ ৬)

ذَلِكُمُ اللّهُ رَبُّكُمْ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوهُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ
তিনিই তােমাদের আল্লাহ, (যার মধ্যে উল্লিখিতরূপ গুণাবলী বর্তমান) তিনি ছাড়া আর কেউ মাবুদ নেই। তিনি প্রত্যেকটি জিনিসের সৃষ্টিকর্তা; অতএব কেবল তাঁরই দাসত্ব করাে- বন্দেগী করাে। তিনি প্রত্যেকটি জিনিসের ব্যাপারেই দায়িত্বশীল ।
(সূরা আন'আমঃ ১০২)

      উল্লিখিত আয়াতগুলাে থেকে একথা পরিষ্কাররূপে প্রমাণ হয়ে গেল যে, সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তিনি আল্লাহ্ তা'আলা ভিন্ন আর কেউ নয় । তিনি এক ও একক; সারা জাহানের পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, রিযিকদাতা ও প্রভু একমাত্র তিনিই । অতএব সেই এক আল্লাহরই দাসত্ব কবুল করা, কেবল তাকেই মা'বুদ ও প্রভু বলে স্বীকার করা এবং অন্য কারাে মধ্যে এসব গুণ আছে বলে মনে করা সমস্ত মানুষের কর্তব্য। কালেমা তাইয়্যেবার এই হলাে গােড়ার কথা। কালেমা তাইয়্যেবার বিস্তারিত অর্থ খােলাখুলিভাবে পাওয়া যায় কুরআন মজীদের নিম্নের আয়াত দুটিতেঃ

أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ. مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِ إِلاَّ أَسْمَاء سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَآؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ أَمَرَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ

     হে মানুষ! ভিন্ন ভিন্ন ও একাধিক মা'বুদ স্বীকার করা ভালাে, না একজন প্রকৃত শক্তিমান এবং সকলের ওপর জয়ী মা'বুদ ভালাে? জেনে রাখাে, এক আল্লাহকে ছেড়ে তােমরা আর যে মা'বুদ নামের জিনিসগুলাের ইবাদত ও বন্দেগী করাে, তা কতকগুলাে অর্থহীন নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সেই নামগুলােও তােমরা নিজেরা এবং তােমাদের বাপ-দাদারা মিলিয়া রেখেছ-- আল্লাহ সে সম্পর্কে কোনাে যুক্তি প্রমাণই নাযিল করেন নাই। অথচ হুকুম দেওয়া ও আইন রচনা করার অধিকার ও ক্ষমতা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারাে নেই। তিনি সকলের প্রতি এ আদেশ করেছেন যে, কেবল আল্লাহ ছাড়া আর কারাে দাসত্ব ও বন্দেগী করাে না। এ একমাত্র সত্য ও মজবুত দ্বীন’ জীবন যাপনের নিখুঁত সূদৃঢ় ব্যবস্থা। কিন্তু অনেক মানুষই তা জানে না।
(সূরা ইউসুফঃ ৩৯-৪০)

     কুরআনের এ আয়াত দুটিতেই কালেমা তাইয়্যেবার অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। এ আয়াত দুটির সারাংশকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

     প্রথমত ও আল্লাহর একত্ব। এক আল্লাহকে স্বীকার করায় মানুষের ইহকাল ও পরকাল উভয় জীবনেরই সুখ-শান্তি লাভ হওয়া সম্ভব। একাধিক খােদা স্বীকার করায় মানুষের জীবন নানাবিধ দুঃখ ও অশান্তিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

     দ্বিতীয়ত ও মুশরিকগণ আল্লাহকে ছেড়ে যে সব দেব-দেবী ও মানুষ-প্রভুর পূজা, উপাসনা ও দাসত্ব করে, তা সর্বতােভাবে অমূলক ও ভিত্তিহীন; তা কতগুলাে নামের সমষ্টি মাত্র। আসলে তাদের কোনােই অস্তিত্ব নেই আর সেসব নামও আল্লাহ তা'আলা রাখেননি মুশরেকগণ নিজেরাই তা রেখেছেন। মানুষের ক্ষতি বা উপকার করবার একবিন্দু ক্ষমতা তাদের নেই। আর সেই ক্ষমতা না থাকলে কাউকেও ইবাদত বা বন্দেগীর যােগ্য বলে মেনে নেওয়া যায় না।

     তৃতীয়ত ও মানুষের কর্মজীবনের জন্য আইন-বিধান রচনা করা কোনাে কিছুর আদেশ করা ও নিষেধ করার ক্ষমতা এবং অধিকার এক আল্লাহ ছাড়া আর কারাে নেই। যারা এক আল্লাহকে স্বীকার করবে, তারা সেই এক আল্লাহর দেওয়া আইন ও বিধান ছাড়া আর কিছুই মানতে পারবে না। তারা নিজেদের ব্যক্তি জীবনে, সমাজে ও রাষ্ট্রে এবং তাদের ধন-সম্পদে ভােগ-ব্যবহার ওব্যয়-বন্টনে কেবলমাত্র আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধানই মেনে চলতে বাধ্য হবে।
  কেননা আল্লাহ্ তা'আলাই সার্বভৌমত তথা সর্বোচ্চ ক্ষমতার নিরংকুশ মালিক।
এটি অন্য কাউকেও দেওয়া যেতে পারে না।

     চতুর্থতঃ আল্লাহ্ তা'আলাই সকলেরই মা'বুদ; মানুষ কেবল তাঁরই দাস- তারই বান্দা। মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারাে অধীনতা ও আনুগত্য স্বীকার করতে পারে না অন্য কারাে পূজা-উপাসনাও (এবাদত-বন্দেগী) করতে পারে না।

    পঞ্চমতঃ এবং শেষ কথা এই যে, উল্লিখিত চারটি বুনিয়েদী আকীদার সমন্বয়ে মানুষের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে যে জীবন বিধান রচনা করে দেওয়া হয়েছে তাই একমাত্র অক্ষয় ও মজবুত ব্যবস্থা। এ ছাড়া অন্য কোনাে মতের ধর্ম বা নীতি কিংবা আদর্শ অথবা জীবন বিধান মানুষের জন্য গ্রহণযােগ্য ও চিরস্থায়ী হতে পারে না— তা শান্তি ও সুখেরও ধর্ম হতে পারে না। এর কোনাে একটি কথাও যদি কেউ বদলাতে চেষ্টা করে, তবে সে এ ধর্মের প্রকাশ্য দুশমন। বলা বাহুল্য, সেই মজবুত ধর্ম হলাে একমাত্র ইসলাম ।
   হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর পিতা ও জনগণকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ
إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ. إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ
তােমরা যাদের দাসত্ব ও পূজা-উপাসনা করাে, আমি তাদের সবকিছু থেকে নিঃসম্পর্ক হওয়ার ঘােষণা দিচ্ছি আর স্বীকার করে নিয়েছি কেবল সেই।
মহান সত্তাকে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে পথ দেখাবেন। (সূরা আহ্ -যুখরুফঃ ২৬ ও ২৭)

  এর পরই আল্লাহ বলেছেনঃ--
وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
তিনি উক্ত কালেমা (ঘােষণা)-টিকে তার পিছনে স্থায়ী করে রেখে গেলেন, যেন সেই লােকেরা এ দিকে ফিরে আসতে পারে।
(সূরা আয-যুখরুফঃ ২৮)

    হযরত ইবরাহীম (আ) প্রথম ঘােষণা দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্য সব মাবুদকেই অস্বীকার করলেন এবং কেবল মহান সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব স্বীকার করার কথাকেই বহাল রাখলেন। এরূপ ঘােষণা দ্বারা আসলে তিনি ভিন্নতর ভাষায় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এরই ঘােষণা দিলেন এবং এ কালেমাটিকেই সমস্ত মানুষের জন্য স্থায়ী ঘােষণা বানিয়ে দিলেন। বস্তুত এ কালেমা দ্বারা একদিকে যেমন দাসত্ব-আনুগত্য, ভয়-ভীতি পােষণ, রহমতের প্রত্যাশা এবং আইন পালনের দিক দিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়, তেমনি সেই সঙ্গেই এ সব দিক দিয়ে আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকেও স্বীকার করার শিককে পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করা হয়। এ হলাে ইসলামের খালেস তওহীদী আকীদা। এই আকীদা সুস্পষ্ট ও অকুণ্ঠভাবে স্বীকার ও গ্রহণ করা ছাড়া কারাে পক্ষে মুসলিম হওয়া সম্ভব নয়।
আল্লাহ্ তা'আলা এরূপ আকীদা গ্রহণেরই নির্দেশ দিয়েছেনঃ

قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللّهَ وَلا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآبِ

বলাে হে নবী! আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আমি একান্তভাবে বান্দা হবাে দাসত্ব করব কেবলমাত্র আল্লাহর; তার সহিত কোনােক্রমেই শিরক করব না। আমি তারই দিকে আহ্বান জানাচ্ছি এবং তাঁরই কাছে আমার আশ্রয়-চূড়ান্ত পরিণতি।
(সূরা রা'দ : ৩৬)

     প্রত্যেকটি মানুষকে যেমন একটি নিজস্ব আকীদা গ্রহণ করতে হয়, তেমনি নিজের গৃহীত ও নিজের কাছে একমাত্র সত্য বলে বিবেচিত আকীদাটি গ্রহণের জন্য সমাজের অন্যান্য লােককেও আহ্বান জানাতে হয়। কিন্তু এ আহ্বান হতে পারে পুরােপুরিভাবে আল্লাহর বন্দেগী কবুল করার আহবান । এ আহবান ছাড়া অন্য কোনাে আহবান- আল্লাহকে অস্বীকার বা তার সহিত শির্ক করার কোনাে আহবান জানানাের কারাে একবিন্দু অধিকার থাকতে পারে না। নবী-রাসূলগণ এ দাওয়াত দেওয়ার জন্যই প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তাঁরা জীবনভর এ দাওয়াত দিয়ে গেছেন দুনিয়ার মানুষকে।

ইনশাআল্লাহ চলবে........

Post a Comment

0 Comments