Recent Tube

ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও সম্ভাবনা ১০ম পর্ব। ড. ইউসুফ আল কারজাভী।

 
          ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও
       সম্ভাবনা । 
                           ১০ম পর্ব;

তৃতীয় অধ্যায়;
চরমপন্থার প্রতিকার;

    এখন আমরা চরমপন্থার প্রতিকার এবং তার উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথমেই এ বিষয়টি বুঝে নেয়া দরকার যে, প্রতিকার চরমপন্থার কারণ থেকে অবিচ্ছিন্ন। এর কারণগোলো যেমন বিভিন্ন ও জটিল তেমনি এর প্রতিকারগুলোও। বলা বাহুল্য, কোনো যাদুস্পর্শে চরমপন্থার অবসান ঘটানো যাবে না কিংবা তাদেরকে মধ্যপন্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমাদের কাছে চরমপন্থা ও গোঁড়ামি-এর মনস্তাত্ত্বিক, সামজিক ও রাজনৈতিক দিকসহ একটি অদ্ভুত ধর্মীয় সমস্যা। সুতরাং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এর সবগুলো দিক বিবেচনা করতে হবে।

      আমি তাদের সাথে একমত নই যারা কেবল সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাকে এই অদ্ভুত সমস্যার কারণ বলে চিহ্নিত করে যুব সমাজের আচরণ ও পদক্ষেপগুলো উপেক্ষা করতে চান। আবার সমাজ, সরকার, সরকারী বিভাগ, বিশেষত শিক্ষা ও প্রচার মাধ্যমকে সকল দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে কেবর যুব সমাজকে দোষ দেয়া অন্যায়। দায়িত্বটা আসলে পারস্পরিক এবং প্রতিটি পক্ষের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমরা সকলে তোমাদের সন্তান-সন্ততি ও অধীনস্থ ব্যক্তিদের অভিভাবক এবং দায়িত্বশীল।” (বুখারী)

       আমরা এখন চরমপন্থা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সমাজের পরিপূরক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো। আমি আগেই বলেছি, বর্তমান যুগের অন্তর্গত পরস্পর বিরোধিতা ও অরাজক অবস্থা এবং ইসলাম থেকে মুসলমানদের বিচ্যুতি চরমপন্থা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অতএব, এই সামজকেই এর প্রতিকারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে, ইসলামের প্রতি তাদের আন্তরিক, সুদৃঢ় ও সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার নবায়ন করা। এটা কেবল মৌখিক ঘোষণা, কিছু মনোহর শ্লোগান অথবা সংবিধানে ‘ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করে নয়, বরং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ঘনিষ্ঠ অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব।

     আমরা জানি, ইসলাম এমন একটি সার্বিক জীবন বিধান যা মানুষের মধ্যে ঐশী বৈশিষ্ট্যকে বিকশিত করতে চায়। এ জন্যে ইসলাম জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষার লক্ষ্যে আদর্শিক কাঠামো, পথ-নির্দেশ ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এর আওতায় থাকলে মানুষের এবাদত-বন্দেগী, মনমানস, আইন-বিধান এক সৌন্দর্যময় রূপ লাভ করে, এক সুবিচারপূর্ণ সমাজ গড়ে ওঠে। তাই প্রকৃত ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন করতে হবে। ইসরাঈলদের মতো খন্ডিতভাবে নয়। আল্লাহ তায়লা কুরআনুল করীমে বলেন:

     “তাহলে তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে জিল্লতি আর কিয়ামতের দিনে তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে।” (২:৮৫)

      সুতরাং ইসলামী চরিত্রের সমাজ কায়েম করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তথা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে আল্লাহ্ র বিধান ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ প্রয়োগ করতে হবে। এটাই ঈমানের প্রকৃত দাবী। কুরআনের ঘোষণা:
“কিন্তু না, তোমার প্রভুর শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।”(২৪:৫১)

     আমরা ইসলামকে ঐশী বিধান হিসেবে মানি। কিন্তু বাস্তব জীবনে শরীয়াহকে প্রয়োগ করি না। তার জায়গায় আমরা পূর্ব ও পশ্চিম থেকে ধার করা ব্যবস্থা চালু করেছি, তবুও আমরা মুসলমান বলে দাবী করি! সমাজ থেকে এই সুষ্পষ্ট পরস্পর বিরোধিতা অবশ্যই দূর করতে হবে।

     সুতরাং আমেদের শাসকদের অনুধাবন করতে হবে যে, তারা মুসলিম ভূখন্ড শাসন করছেন এবং মুসলমানদের তাদের ধর্মীয় বিধান অনুসারে শাসিত হওয়ার অধিকার আছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিবুত্তিক, সাংস্কৃতিক, আন্তর্জাতিক তথা সকল ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

    সকল ও আন্তর্জাতিক নীতি এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রণয়ন করতে হবে। মুসলিম শাসকরা যদি এই ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হন তবে তা হবে চরম ইসলাম বিরোধিতার শামিল। বস্তুত এ বিষয়টির প্রতি মুসলিম শাসকদের উপেক্ষা ও ঔদাসীন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে ইসলামী আন্দোলনকারীদের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন। এই শাসকরা মসজিদকেও তাদের মতলব হাসিলের কাজে লাগান। কেউ এর বিরোধিতা করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। আবার কিছু কিছু শাসক মুসলমান বলে দাবী করেন এবং যা তাদের ধারণা নেহায়েত মনগড়া এবং শয়তানী খেয়ালখুশীর নামান্তর। যা তাদের মতলব হাসিলের অনুকূল তা গৃহণ করেন এবং তাদের পছন্দসই নয় তা নির্দ্বিধায় নাকচ করে দেন। তারা যা বিশ্বাস করেন তাকেই “সত্য” বলে ঘোষণা করেন এবং এর বিপরীত সবকিছু বাতিল। তারা কুরআন ও হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা অস্বীকার করে নিজেরাই এ সবের ব্যাখ্যাতা সাজেন। তারা কোনো বিজ্ঞ আলিম-ওলামার সাথে পরামর্শ করার ধার ধারেন না। তারা প্রত্যেক নিজেকে একেকজন ফকীহ, মুফাসসির, মুতাকাল্লিম ও দার্শনিক ভেবে বসেন।

    এ ধরনের মুসলমান শাসক মনে করেন তাদের বিকল্প দ্বীতিয় ব্যক্তি নেই। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা) থেকেও কিছু শেখার প্রয়োজন অনিভব করেন না। কুরআন ব্যাখ্যার জন্যে তিনি নিজেকেই যথেষ্ট মনে করেন। অথচ আল্লাহ্ বলেন: “রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে।” (৪:৮০)

    অবশ্য এসব শাসক ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী শরীয়াহ প্রয়েগের অনুমতি দেন। রেডিও-টেলিভিশনে ইসলাম সম্পর্কে আলোচনার কিঞ্চিত সুযোগ দিয়ে থাকেন আর সংবাদপত্রে শুক্রবারের জন্যে একটি কালাম বরাদ্দ করেন। এখানে অলোচ্য বিষয় হচ্ছে ধর্ম কেবল ব্যক্তি সত্তা ও স্রষ্টার সম্পর্কের মধ্যে সীমিত। সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই হচ্ছে অধুনা মুসলিম শাসকদের বিশ্বাস অথাৎ আইন ছাড়া ঈমান, রাষ্ট্র ছাড়া দ্বীন, দাওয়াত ছাড়া ইবাদত এবং সত্যের আদেশ ও মিথ্যার নিষেধ ছাড়া জিহাদের ডাক। এখন কোনো নাগরিক যদি এদের বিরোধিতা কের ইসলামী জীবন বিধান চালুর ডাক দেয় তবে তার বিরুদ্ধে ধর্ম ও রাজনীতি সংমিশ্রণের অভিযোগ আনা হয়। মোটকথা, শাসকদের কর্যকলাপ আল্লাহ্ , আল্লাহ্ র রাসূর ও তাঁর সাহাবীদের পথের বিপরীত। মুসলিম বিশ্ব এক চরম সন্ধিক্ষণে। অতএব, প্রকৃত ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে তা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সমাজে স্থিতিশীলতা আসতে পারে না. পারে না জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে। উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেন, “আমরা নিকৃষ্টতম জাতি ছিলাম। কিন্তু ইসলাম দিয়ে আল্লাহ আমাদেরকে স্মানিত করেছেন। যদি আমরা ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য পন্থায় মর্যাদা হাসিল করতে চাই তবে আল্লাহ্ আমাদের গোড়া কেটে দেবেন।” সুতরাং শারীয়াহ প্রয়োগ না করা পর্যন্ত আমাদের সমাজে চরমপন্থার বিস্তার ঘটবেই।

     দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে, তরুণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আইভরি টাওয়ার থেকে তাদের উদ্দেশ্যে মুরব্বীসুলভ ভাষণ দিলে চলবে না। তাদের মনমানসিকতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করে কথা বলতে হয়। নইলে তারা কথা শুনতেই অস্বীকার করবে। তাদের শুধু দোষ দিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, তাদের গুণগুলো উপেক্ষা করে দোষগুলোই প্রচার করা হয়।

     তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে আরেকটি প্রবণতা রয়েছে। একটা গোষ্ঠীর কেউ একজন দোষ করলে তা সাধারণভাবে সকলের ওপর চাপানো হয়। তরুণদের বেলায় এটি আরো বেশী প্রযোজ্য। একজন তরুণ করলো কী করলো না, অমনি তা সকল তরুণদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া ঘটনা ভাল করে না জেনে হুট করে রায় দেয়ারও প্রবণতা আমাদের রয়েছে। ভাল করে না জেনে না শুনে সংখ্যালঘৃর দোষ সংখ্যাগুরুর ওপর চাপিয়ে দেয়া ন্যায় বিচার নয়। এজন্যে মুসলিম ফকীহরা রায় দিয়েছেন, সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে যে রায় দেয়া হয় তা সার্বিকভাবে প্রযোজ্য, কিন্তু এর বিপরীতটা নয় অর্থাৎ মুষ্টিময়ের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে প্রযোজ্য হতে পারে না। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজনের সামগ্রিক কর্মকান্ডের বিচার হতে পারে না। তার সামগ্রিক আচরণের মূল্যায়ন করেই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। কারণ কুরআন বলছে: “যার (সৎকর্মের) পাল্লা ভারী, সেই মুক্তি পাবে।” (২৩:১০২)

      চতুর্থ, নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে তরুণদের বিচার করা ঠিক নয়। তাদেরকে অনেক মানসিক রোগজনিত খামখেয়ালি বলে ভাবেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা সত্য হতে পারে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে সন্দেহাতীত। আসলেই তাদের ঈমান ও আচরণে কোনো দ্বৈততা নেই। আমি অনেক মুসলিম দেশের অনেক তরুণের কথা জানি, তারা ঈমানী জযবায় সুদৃঢ় এবং আমলে-আচরণে সত্যনিষ্ঠ। সত্যের প্রতি তাদের নিষ্ঠা ও মিথ্যার প্রতি তাদের র্ঘণাকে আমি প্রশংসাকরি। তারা সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ ও শারীয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্যে কঠোর জিহাদে নিমগ্ন। এই তরুণদের সাথে মেলামেশা করে আমার স্থির বিশ্বাস জম্মেছে যে, আমাদের পোচলিত ইসলামী ধ্যান-ধারণার সাথে তাদের চিন্তাধারার মৌলিক পার্থক্য আছে। তারা এক নতুন উদ্দীপ্ত ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ যে ইসলাম আমাদের মতো জরাজীর্ণ নয়; তাদের ঈমান সতেজ, আমাদেরটা ঠন্ডা; তাদের সাধুতা সুদৃঢ়, আমাদেরটা করুণ। তাদের হৃদয়ে আল্লাহ্ র ভয় সদাজাগ্রত- তাদের হৃদয় কুরআনের তিলাওয়াতে সদা স্পন্দিত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সারা রাত ইবাদতে মগ্ন থাকে, দিনে রোযা রাখে, প্রত্যুষে আল্লহ্ র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এসব দেখে আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছে যে, ইনশাআল্লাহ্ ইসলাম আবার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্যেই আমি মিসরে বিভিন্ন উপলক্ষে ঘোষনা করেছি, এই তরুণ গোষ্টীই মিসরের প্রকৃত আশার আলো। যে কোনো বৈষয়িক সম্পদের চেয়ে এরা অধিক মূল্যবান।

     তাই আমি বিশ্বাস করি, চরমপন্থার প্রতিকার অন্বেষণে আমাদের কথাবার্তায় আচরণে বারসাম্য, সুবিবেচনা ও উদারতা থাকতে হবে। এলোপাথাড়ি অতশয়োক্তি এই অদ্ভুত সমাধানের সহায়ক হবে না, করং এই প্রকণদা ত্রাস সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বড় কথা, সত্য ও প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত, বিচারের মানদন্ডকে দোদুল্যমান এবং সুস্থ চিন্তাকে দূষিত করে। ফলত কনো, তা অন্যায় কিংবা অন্তত অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য।

      তাথাকথিত “ধর্মীয় চরমপন্থা” এবং সরকার ও তরুণদের মধ্যে সংঘাতের ফলে উদ্ভুত সংকট মুকাবিলার প্রক্ষিতে যা কিছু বলা বা লেখা হচ্ছে তা বাড়াবাড়ি ও অতিশয়োক্তি মুক্ত নয়। তরুণদের বিরুদ্ধে অনেক মানুষ অসদুদ্দেশ্য-প্রণোদিত মনোভাব পোষন করে। ঐসব বক্তব্যে এর প্রভাব লক্ষণীয়। এই প্রসঙ্গ নিয়ে একজন সমাজবিজ্ঞানী ড. সাদ আল দ্বীন ইবরাহীম ‘আল-আহরাম’ পত্রিকায় লিখেছেন: যারা এই প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন তারা আসল সত্যের ধারে কাছেও নেই। তাদের যুক্তির কোনো সুনিদৃষ্ট ভিত্তিও নেই। তাদের বক্তব্যে অজ্ঞতা ও চরম অবিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট। প্রকৃতপক্ষে এই সমস্যার প্রশ্নে এদের নিশ্চুপ থাকাই শ্রয় ছিলো, নতুবা বাস্তব দৃষ্টিকোন থেকে সমস্যার বিশ্লেষণ করা উচিত ছিলো। কিন্তু এই গুণ বৈশিষ্ট্য তো এদের মধ্যে নেই। এ ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ধর্মীয় ব্যাপারে এসব লোকের মুক্তকচ্ছ, শিথিল ও ঔদাসীন্যের চরমপন্থী মনোভাবই ধর্মীয চরমপন্থা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। মোটকথা, এক শ্রেনির লোকের চরম বিরাগ আরেক শ্রণিকে চরম অনুরাগী করেছে। যদা কোনো বিজ্ঞ প্রচেষ্টা উভয়পক্ষের মতভেদ দূর করে তাদেরকে একত্র করতে ব্যর্ত হয় তাহলে এটাই প্রমানিত হয় যে, সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টর জন্যে এক চরমপন্থা নির্মূলে আরেক চরমপন্থারই প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে একটি ধারণা পাওয়া যায়:

    “যদি আল্লাহ্ তায়ালা একটি জনগোষ্টী দিয়ে আরেকটি জনগোষ্টিকে প্রতিহত না করতেন তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো; কিন্তু আল্লাহ্ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল।” (২ : ২৫১)

    সুতরাং তরুণ মুসলমানদের প্রতি অভিযোগ অযৌক্তিক, যখন প্রতিপক্ষ চরমপন্থীরা ধর্ম ও নৈতিকতা বিগর্হিত জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে । যেসব তরুণ ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী তাদের জীবন গড়ে তুলতে প্রয়াসী তাদেরকে হেয় করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ অযৌক্তক ও অন্যায়। যেসব তরুণ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে, রোযা রাখছে, দাড়ি রাখছে, গিরার উপর কাপড় পরছে, হালাল হারাম বিবেচনা করছে, ধুমপান থেকে বিরত থাকছে তাদেরকে দোষ দেয়ার বা নিন্দা করার কী যুক্তি থাকতে পারে। অথচ আমরা নীরবে চোখের সামনে দেখি একদল লোক জীবনকে উপভোগ করে চলেছে নির্বিচারে। নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে পাশ্চাত্যের এই মানসপুত্ররা সম্পূর্ণ উচ্ছন্নে গেছে। অতএব ধর্মীয় “চরমপন্থার” বিরুদ্ধে “গেলো গেলো রব” তোলা আর “ধর্মহীন চরমপন্থা” র পক্ষে চোখ কান বুজে থাকা যুক্তির কোন্ মানদন্ডে সঙ্গত? মেয়েরা পর্দা করে চলাফেরা করলে উপহাসের পাত্রী হতে হয়; কিন্তু যখন আরেক দল মেয়ে রাস্তাঘাচে, সৈকতে, থিয়েটারে, সিনেমায় প্রায় উলঙ্গভাবে নিজেকে প্রদর্শন করে তখন তাকে “সংবিধানসম্মত ব্যক্তি স্বাধীনতা” ভোগ বলে পার পাওয়া কী উচিত? তাহলে কী ধরে নিতে হবে, সংবিধানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার জন্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আর সতীত্ব ও শালীনতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে? সমাজ যদি অনৈতিক ও ধর্মহীন তৎপরতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতো তাহলে আমাদের দেশে ধর্মীয় চরমপন্থা’র উদ্ভব হতো না, যদিও কোনো না কোনো কারণে চরমপন্থা বিরাজ করতে তাহলে এর প্রবাব হতো নগণ্য । আমাদের এটা স্বীকার করতে হবে ‘চরমপন্থা’ একটি বিশ্বজনীন ঘটনা; কিন্তু মজার ব্যাপার বিভিন্ন দেশে আন্যান্য চরমপন্থী গ্রুপ বা সংগঠন থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে এ রকম চরম পদক্ষেপ নেয়া হয় না। কিন্তু যত দোষ কেবল মুসলমানদের বেলায়। তারা চরমপন্থী হলে তাদের বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে চরম নির্যাতনের পথ বেছে নেয়া হয়। ইসরাঈলের চরমপন্থী ইহুদীরা মনে করে ঐ ভূমিতে তাদের ঈশী অধিকার রয়েছে এবং এই লক্ষ্যে তারা সকল রকম হিংস্র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ খোদ ইসরাঈলের সৃষ্টিটাই অবৈধ এবং সন্ত্রাসী কাজ। লেবাননে খ্রীস্টান ফালাজির চরম সহিংস পন্থায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলমানদের যবাই করছে, তাদের লাশ ক্ষতবিক্ষত করছে, গুপ্ত অঙ্গ কেটে তাদেরই মুখে পুরে দিচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মীয় বইপুস্তক পুড়িয়ে ফেলছে। খ্রীস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থে বলা হয়েছে, “তোমার শত্রুকে ভালবাসো, তোমাকে যারা ঘৃণাকরে তাদের ভাল করো, কেউ তোমার ডান গালে চড় মারলে বাম গালও পেতে দাও।” (লুক ৬ : ২৭-২৯)।

      এছাড়া আমরা অন্যান্য দেশ, যেমন সাইপ্রাস, ফিলিপাইন ও হিন্দুস্থানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্তাসী তৎপরতা দেখতে পাই। মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক খ্রীস্টানী সন্ত্রাস শুরু হয়েছে যাকে বলা যায় নতুন ক্রুসেড। প্রতি বছর হিন্দু চরমপন্থীরা মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। পরিহাসের বিষয়, হিন্দুরা প্রাণী হত্যাকে নির্দয় নিষ্ঠুর কাজ বলে মনে করে। এ জন্যে তাদের ধর্মে গরু যবাই নিষিদ্ধ। কিন্তু এরাই আবার ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করে চলেছে বেধড়ক! একই কারণে তারা আবাদী জমিতে নাকি কীটনাশক ব্যবহার করে না। লাখ লাখ একর জমির ফসল তাই ইঁদুরের পেটে চলে যায়। তাদের দৃষ্টিতে এসব প্রাণীরও আত্মা আছে, তাই তাদের আঘাত করা যাবে না । তাদের দৃষ্টিতে বোধ হয় একমাত্র মুসলমান নামক প্রাণীরই আত্মা নেই!

    একথাও আমাদের স্বীকার করতে হবে, বস্তুবাদ মানুষের চিন্তাও আচরণকে বিকৃত করে ছেলেছে। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উন্নতি হয়েছে, মানুষ চাঁদেও গেছে, গ্রহান্তরে আধিপত্য বিস্তার করছে। কিন্তু এসব বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি আত্মার উন্নতি হয়নি। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উন্নতি হয়েছে, মানুষ চাঁদেও গেছে, গ্রহান্তরে আধিপত্য বিস্তার করছে। কিন্তু এসব বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি আত্মার উন্নতি হয়নি। ফলে মানুষ আজ মনের সুখ পাচ্ছে না। এক সমায় তারা মনে করেছিলো বস্তুগত আরাম-আয়েশ লাভ করতে পারলে মনের শান্তিও পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের সে আশার গুড়ে বালি! তাদের মধ্যে চরম নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। হিপ্পি জাতীয় নানা গ্রুপ নিত্য নতুন গজাচ্ছে তাদের কাছে আধুনিক সভ্যতা অর্থহীন হয়ে পড়েছে, তারা এখন প্রকৃতিতে ফিরে যেতে চায়। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে : আমি কে? আমার লক্ষ্য কি? আমি কোথা থেকে এসেছি? এখন থেকে আমাকে কোথায় যেতে হবে? কিন্তু পাশ্চাত্যের কাছে এসব প্রশ্নের জবাব নেই । এমনি নৈরাজ্যের প্রতিধ্বনি আমাদের দেশেও শোনা যায় এই প্রশ্নের জবাব নেই। এই প্রশ্নের জবাব পেতে গিয়ে কেউ চরম বিধর্মি হয়ে গেছে, আবার কেউবা সত্য পথের সন্ধান পেয়ে ইসলামের সুশীতল চায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সুখের বিষয়, বহু মুসলিম তরুণ সকল প্রশ্নের সছিক উত্তর ইসলামের মধৈই খুঁজে পেয়ে নিজেদের জীবনকে ইকামতে দ্বীনের জন্যে কুরবানী করতে প্রস্তুত। 

ইনশাআল্লাহ, চলবে...।

Post a Comment

0 Comments