প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আর অফুরান জলজ ---সম্ভারকে ধারণ করে আছে রত্ন-গর্ভা হাকালুকি ।
বর্ষায় উপচে পড়া জলরাশীর উপরে সূর্যের কিরণ লেগে মনে হয় যেন রূপালী চাদরে অাবৃত হয়ে সাগরসম জৌলুশ নিয়ে অাপন সৌন্দর্যকে মেলে ধরে হাকালুকি হাওর ।
অাবার বর্ষার শেষে পানি যখন নেমে যায় তখন বিস্তীর্ণ প্রান্তর হয়ে উঠে গবাদিপশুর বিচরণ ক্ষেত্র । অার অপেক্ষাকৃত নিচু জলাভূমিতে উৎপাদিত হয় ধান।
ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় সে ।
জীব বৈচিত্র্য,প্রাকৃতিকঐশ্বর্য অার জলজ সম্ভারকে অাবহমান কাল ধরে বিতরণ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির এই হাওর ।
অসংখ্য খাল-বিল অার জলাধারে জলবিন্যাস অার হিজল,তমালসহ প্রায় তিয়াত্তর প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ হাকালুকি হাওরকে করেছে অনিন্দ সূন্দর শুভামন্ডিত। ।
হাওরের নির্জনতার মাঝে পাখিদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠে পরিবেশ । বিশেষ করে শীতকালে অতিথি পাখিরা অাসে ঝাকে ঝাকে ।
প্রায় ২৩৮টি বিল অার দশটি নদী-নালা খাল প্রাণবন্ত রেখেছে এই হাওয়ার কে। নদ-নদীর অার খালের স্রোতধারা যেন বিশালদেহী হাওরের একেকটি শিরা উপশিরা ।
ঘুরতে ঘুরতে দেখা মেলে ছোট ছোট গ্রাম । গাছগাছালি ঘেরা এ গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষই মৎস্যজীবী । হাওরকেন্দ্রিক এই প্রান্তিক জনপদের লোকজন অত্যন্ত সহজ সরল ।
তাদের জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে হাকালুকি। বছরের বেশীর ভাগ সময় মাছ ধরা হলেও দুটি মওসুমে জেলেদের জালে বেশী মাত্রায় মাছ ধরা পড়ে । এপ্রিল,মে থেকে শুরু করে অাগষ্ট,সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সময়টাতে জেলেদের জন্য কোন প্রশাসনিক বিধিনিষেধ থাকেনা।
জাল অার জল এই দুই এ মিলে এদের জীবন । হাওর পারের এই গ্রামগুলোতে রয়েছে একদিকে চিরায়ত বাংলার স্নিগ্ধতা অন্যদিকে ভিন্ন জীবনধারার কর্মচাঞ্চল্য।
বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে হাকালুকি দর্শন করা গেলেও সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে হাকালুকি হাওরকে দেখা যায় অপরূপা মোহনীয় রূপে ।
বৃহত্তর সিলেটের বড়লেখা,কুলাউড়া, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জের এগারোটি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত এশিয়ার সবচাইতে বড় এই হাওর।
ভরা মওসুমে হাকালুকি হাওরের অায়তন দাঁড়ায় প্রায় একশত একাশি বর্গ কিলোমিটারে ।
বর্ষা শেষে যখন পানি নামতে শুরু করে তখন জেগে উঠা চর হয়ে ওঠে গোচারণ ভূমি।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে জেলেরা বছরে প্রায় আড়াই হাজার টন মাছ এই হাওড়া থেকে ছেকে তুলে।।
হাকালুকি হাওরের বিশালতা অার অফুরান রত্ন-সম্ভারের কারণে কারনে স্থানীয় অধিবাসীরা গর্ব করে বলেন বেটা বললে মাখন মনসুর বাকি সব পুয়া,
হাওর বললে হাকালুকি বাকি সব কুয়া ।
হাকালুকি হাওরের নাম নিয়ে রয়েছে চমৎকার কিছু লোককথা ।
প্রায় হাজার বছর আগা নাগাদের রাজা অাকার রাজ্যপাট তলিয়ে গিয়েছিল প্রচন্ড ভূমিকম্পে । অাকার রাজ্য নিম্নভূমিতে লুকিয়েছিল বলে এর নাম হয়েছে ''অাকালুকি''। আকালুকি শব্দের ভিন্ন উচ্ছারণ হাকালুকি ।
আছে ভিন্ন অারেকটি জনশ্রুতি । ত্রিপুরার মহারাজা অমর মানিক্যের ভয়ে বড়লেখার কুকি দম্পতি হাঙ্গর সিং এই এলাকায় লুকিয়েছিল বলেই এর নাম হাঙ্গরলুকি । কালক্রমে এর নাম হয়েছে হাকালুকি। কেউকেউ মনে করেন বড়লেখার হেঙ্গেললুক নৃ-গোষ্ঠীর
নামকরণেে হাওরটির নাম হয়েছে হেঙ্গেললুকি বা হাকালুকি ।
অনেকে মনে করেন এখানে লুকিয়ে আছে অনেক সম্পদ । তাই এই হাওরের নাম হাকালুকি।
বিজ্ঞানীদের ধারণা প্রায় তিনকোটি বছর আগে এই এলাকা ছিল বঙ্গোপসাগরের নিচে । সাগর ধীরে ধীরে সরে গেছে দূরে । রয়ে গেছে স্মৃতি । সাগর থেকে সায়র । সায়র থেকে হাওর ।
যখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সময় অাসে তখন সূর্য তার অালোক রশ্মি হারিয়ে কমলালেবুর রং ধারণ করে। প্রকৃতির সবটুকু রং গায়ে মেখে অনন্যা হয়ে উঠে রূপবতী হাকালুকি । অাস্তে অাস্তে নামতে থাকে সন্ধ্যা । রাখাল ছেলেরা গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফেরে । ফিরে অাসি অামরাও, হাওর দেখার ভিন্ন এক সুখানুভূতি নিয়ে ।
------------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।
0 Comments