Recent Tube

মনোকথন-৪; জিয়াউল হক।



  মনোকথন-৪

--------------------------------- 
  অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানী, বিশেষ করে যাদের হাত ধরে আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও মানসিক চিকিৎসা বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে, তাদের মনে আল্লাহ, ইশ্বর, গড বা সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে এ ধরনের নেতিবাচক চিন্তা ও বিশ্বসের কারণে ফল এই হয়েছে যে, তারা মানুষের মনোজগতকে নিয়ে এমনভাবে চিন্তা ভাবনা করেছেন যে, মনের ঠিকানা, উৎস, তার কর্মপদ্ধতি ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ব্যাপারে নিজেরা যেমন কোন সঠিক ধারনা লাভ করতে পারেন নি, তেমনি বিশ্ববাসীর সামনেও কোন সঠিক চিত্র তুলে ধরেতে পারনি নি।
 
   মানসিক রোগের কারণ, উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, বিস্তার, ধরন ও তার চিকিৎসা এবং পূনর্বাসন নিয়ে বিশ্বব্যাপী নিরন্তর গবেষণা পরিচালনা করেছেন তারা, মানুষের মস্তিস্কের কর্মকান্ড নিয়ে অসাধারণ সব আবিস্কার করেছেন, বিষ্ময়কর সব ব্যাখা ও তথ্য হাজির করেছেন যা নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। 

    কিন্তু সেই সব উদ্ভাবন ও আবিস্কার, নতুন নতুন সেই সব জ্ঞান ও তথ্য-উপাত্ত মানসিক রোগের প্রকোপ কমাতে পারেনি, বরং সারা বিশ্বজুড়ে, বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও জনপদে অনেকটা অপ্রতিরোধ্যভাবে মানসিক রোগের ক্রমবিস্তার ঘটেই চলেছে। এক পরিসংখানে দেখা গেছে, বিগত দশ বসরে বিশ্বজুড়ে মানসিক রোগের প্রকোপ দ্বিগুন বেড়ে গেছে।১
 
     এ চিত্র সারা বিশ্বজুড়ে। আমাদের দেশের মতো তৃতিয়বিশ্বের দেশেই কেবল নয়, সারা বিশ্বের উন্নত দেশসমূহেও সেই একই চিত্র। এরকম দু:খজনক চিত্র আমাদের সামনে এটা দ্ব্যার্থহীনভাবে প্রমাণ করে দেয় যে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নিরলস গবেষণা ও চমৎকার সব উদ্ভাবন, বিষ্ময়কর সব জ্ঞান লাভ করা এবং অনেক দামী দামী ঔষধ উদ্ভাবন, উৎপাদন  ও সহজলভ্য করা সত্তেও মানসিক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কার্যকর কোন সফলতা আসেনি। বরং সমস্যার বিস্তৃতি ঘটেছে বহুগুনে এবং তা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। 

     বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাোষ্ট্রর এক গবেষণা জরিপের রিপোর্ট আমাদের সামনে রয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে সে দেশের সরকার চিকিৎসা পূনর্বসান ও গবেষণাখাতে বিলিয়ন বিলিয়ন  ডলার  অর্থ খরচ করার পরেও জাতির মানসিক স্বাস্থ্যের এক শোচনীয় অধোপতন ঘটেছে। 

      আমেরিকার কিশোরদের মধ্যে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৫২ জন, যুবকদের মধ্যে এই হার শতকরা ৬৩ জন। ১৮ বসর থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে জটিল মানসিক রোগের লক্ষণ (Serious Psychological Distress) এর হার হলো শতকরা ৭১ জন, আর কুড়ি থেকে একুশ বসর বয়সীদের মধ্যে এই হার শতকরা ৭৮ জন।  

       মানসিক রোগের কোন যথোপযুক্ত চিকিৎসা বা নিরাময় না পেয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষ হতাশায় আত্মহত্যাও করছে। ২০০৮ সালে যেখানে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চিন্তার (Suicidal Thoughts) হার ছিল শতকরা ৭ জন (৭%), মাত্র দশটি বসরে তা বেড়ে  ২০১৭ সালে হয়েছে শতকরা ১৩ জন (১৩%)!২ 

      আমরা নতুন করে কোন দেশের উপাত্ত ও জরিপচিত্র না দিয়েও বলতে পারি যে, পুরো বিশ্বের বুকে মানসিক রোগের এক নীরব মহামারী চলছে। উন্নত বা অনুন্নত, ধনী বা গরিব প্রতিটি শহর ও জনপদে এ মহামারী আজ এক তিক্ত বাস্তবতা। বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগের মহামারী নিয়ে সময় সময় বিশ্বসমাজ যথাযথ সোচ্চার হয়, সেসবের চিকিৎসা ও নিরাময় এবং তা ঠেকানোর জন্য বিশ্বজুড়ে সুপরকিল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়ে যায়। 

       খুব সাম্প্রতিককালে করোনা মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রতিটি দেশ, সমাজ ও সংস্থার পক্ষ থেকে অশ্রুতপূর্ব তোড়জোড়, প্রচার প্রচারণাই তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ঠ উদাহারণ হিসেবে আমাদের সামনেই বিদ্যমান রয়েছে।

    তবে দু:খজনকভাবে বলতেই হয় যে, মানসিক রোগের চিকিৎসা ও তার প্রকোপ ঠেকানোর ক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরিত চিত্রই আমারা দেখতে পাই। জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সময় সময় মানসিক রোগের ব্যাপারে বিশ্ববাসী, বিশেষ করে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেও তাতে খুব একটা সাড়া মেলেনি। কাজের কাজও তেন কিছু একটা হয়নি। 

     এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো, মানসিক স্বাস্থ্য সন্মন্ধ্যে সচেতনতার অভাব।  সাধারণ জনগোষ্ঠীর মনে সচেতনতার অভাব তো রয়েছেই, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানসিক রোগের উৎপত্তি, উদ্ভব ও বিকাশ এবং যথার্থ কারণ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে সঠিক জ্ঞানের অভাব। এই জ্ঞান হলো, মনের প্রকৃত চিত্র, তার রুপ ও প্রকৃতি এবং কর্মপরিধি, মনের সাথে মানুষের কর্মজগত, বোধ-বিশ্বাসের জগত, তার ভালো মন্দের সম্পৃক্ততার বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান।  

      বিদ্যমান বাস্তবতার সকল দিকগুলোকে মাথায় রেখে আমাদের এর সঠিক, সময়োচিত সমাধান খুঁজতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। এর মানে এই নয় যে, মানসিক রোগ নির্ণয়, পরিক্ষা নিরিক্ষা, তার চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া ঔষধ পথ্য, জ্ঞান, প্রযুক্তি, তথ্য উপাত্ত এবং বিদ্যমান জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এসবকে বর্জন করতে হবে।   

     বরং আমরা বিজ্ঞানের সকল অর্জনকে সাদরে গ্রহণ করবো এবং একইসাথে মানসিক রোগ সনাক্ত করণ থেকে শুরু করে এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আরও কার্যকর, আরও ফলপ্রসু পথ ও পদ্ধতিকে প্রয়োগ করবো। আমাদের পরবর্তি সকল আলোচনা পর্যালোচনা পরিচালিত হবে এই একটি মাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে।
--------------------------------- 
লেখকঃ  ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments